ছোটগল্প: বিনিময় // দিব্যেন্দু দ্বীপ

follow-upnews
0 0

উপার্জন বেশ ভালো, কিন্তু রক্তক্ষয়ে উপার্জন— স্ত্রী সন্তানদের তাতে কল্যাণ হলেও নিজে ফুর্তি করা তো দূরে থাক, প্রয়োজনীয় বিশ্রামের সুযোগটুকুই হয় না। এদেশের কয় জনে জানে এই দু:খের কথা? হয়ত কেউ-ই জানে না, কিন্তু ঠিকই তারা জানে— কী জানে জানেন? তারা জানে যে, আমরা লেখাপড়া জানি না; আমরা ভদ্রভাষায় কথা বলতে জানি না; আমরা সাবধানে গাড়ি চালাতে জানি না; আমরা বেশ্যাপাড়ায় যাই; আমরা মানুষের কাছ থেকে ভাড়া বেশি রাখি— এ সব কিছুই তারা জানে! এবার তাহলে শুনুন— তারা কী কী জানে না— তারা জানে না আমরা কত টাকা বেতন পাই; আমরা কত ঘণ্টা গাড়ি চালাই; সপ্তাহে একদিন বা দিনে এক ঘণ্টা গাড়িতে চড়ে তাদের যদি দুর্ঘটনায় জীবনহানীর এতটাই দুশ্চিন্তা হয়, তাহলে আমরা যারা সবসময়ই রাস্তায় থাকি তাদের কী হয়; আমরা দুপুরে কী খাই; সকালে খাওয়ার সময় পাই কিনা; মালিক আমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করে; বাসায় গেলে পরিবার রাস্তার বাস্তবতা কতটা বোঝে— এর কোনোকিছুই তারা জানে না। শুধু যে জনগণ জানে না তা নয়, এ দেশের হর্তকর্তারাও জানে না! আচ্ছা, আমাকে আপনারা একটু বলুন তো— যার নিজের জীবন সব সময় ঝুঁকিতে সে আপনাকে নিরাপত্তা দেবে কীভাবে?

সাজ্জাদ গত বারো বছর ধরে গাড়ি চালায়। ছোটখাটো দুর্ঘটনা কখনও যে হয় নাই, তা নয়, কিন্তু জীবনহানী ঘটায়নি কখনও। কিন্তু ‍দুর্ঘটনা তো আর রোজ ঘটা লাগে না, জীবনে একবার ঘটলেই যথেষ্ট— হয় জীবনহানী, নয় তো পঙ্গুত্ব। সাজ্জাদ ড্রাইভার দুই বছর ধরে শয্যাশায়ী, মাত্র দুই মাস হলো হুইল চেয়ারে বসতে পারে। ‍দুর্ঘটনাটা খুবই মারাত্মক ছিল, বাঁচার কথা ছিল না, উন্নত চিকিৎসা এবং স্ত্রীর সেবাযত্নে বেঁচে উঠেছে। একটা বেপরোয়া গতির মটর সাইকেল বাঁচাতে গিয়ে সাজ্জাদ বাসটি ঘুরিয়ে নিয়ে গিয়ে একটি তালগাছের সাথে বাড়ি খায়। বাসের বাম পার্শ্বে ধাক্কাটা লেগেছিল, কিন্তু এতটাই জোরে ধাক্কা লেগেছিল যে, সাজ্জাদকে পা সহ বের করা সম্ভব হয়েছিল না— খুবই করুণ ছিল ঘটনাটা, হাটুর উপর থেকে দুই পা-ই কেটে ফেলতে হয়েছিল। দুর্ঘটনার স্থান থেকে হাসপাতাল খুব দূরে ছিল না, তার চেয়ে বড় কথা ঐ রাস্তার কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারটি ছিল খুবই মানবিক। মিঠুনের তৎপরতায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। ফরিদপুর জেলার মধ্যে ঘটেছিল ঘটনাটা। ফরিদপুরের এসপি আলিমুজ্জামান সাহেব দ্রুত সব ব্যবস্থা করেছিলেন। জেলার সবগুলো ইউনিট একযোগে তৎপর হওয়াতে সম্ভব হয় সাজ্জাদকে বাঁচানো। চিকিৎসকদের একটি দল এসে দুর্ঘটনাকবলিত বাসের মধ্যেই ওটি বানিয়ে নেয়, এরপর দুই পা কেটে সাজ্জাদকে বের করা হয়। একইসাথে রক্ত দেওয়ার কাজটিও চলে। মানবিকতার এরকম দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে বিরল হলেও বর্তমানে পুলিশের পক্ষ থেকে অনেক ভালো কাজের নজির স্থাপিত হচ্ছে। এজন্যই বলা হয়ে থাকে যে, দরিদ্র-পীড়িত দেশে সবার আগে ভালো হওয়া লাগে পুলিশ ও প্রশাসনের, তাহলে অন্য সবাইও ভালো হতে বাধ্য হয়। 

সাজ্জাদের স্পাইনাল কর্ডও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল, ফলে দীর্ঘদিন শরীরের নিচের অংশ অবশ ছিল। এরকম একটা মানুষ নিয়ে রাহেলা যে কী করেছে সেটি না দেখলে কারও বিশ্বাস হবে না! জমানো টাকা, জমি যাতিও সব গিয়েছে চিকিৎসায়। সাতশো টাকা পঙ্গু ভাতা, আর কিছুদিন হলো একটি সংস্থা থেকে মাসে পাঁচ হাজার টাকা পাচ্ছে, এই দিয়েই কোনোমতে সংসার চলছে। সন্তান একজন এখনও ছোট, মেয়েটি এবার এইসএসসি পরীক্ষা দেওয়া কথা ছিল, কিন্তু একরকম বাধ্য হয়েই বিয়ে দিতে হয়েছে। ছেলেটি সেভেনে পড়ে। বাপ-মা হারা এতিম সন্তানদের মতো সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ায় সজল। মা থাকেন বাপের শুশ্রুষায় ব্যস্ত, এই সুযোগে ও হয়েছে বাউণ্ডুলের চূড়ান্ত। লেখাপড়া খুব একটা আর এগোবে বলে মনে হয় না। 

দিন কতক ধরে সাজ্জাদ একটা বিষয খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছে— স্ত্রী যেন তার খুব নব-যৌবন প্রাপ্ত হয়েছে! পুরুষ মানুষ কেউ বাসায় আসলে আর লড়তে চায় না। সাজ্জাদ বুঝতে পারে যে, তার স্ত্রীর দিকে তার প্রতি সহানুভূতিশীলরা চোখ দিতে শুরু করেছে। সাজ্জাদ মনে মনে ভাবে— “আমার তো আজীবন-ই এরকম হুইল চেয়ারে থাকতে হইব, তাই বলে এমন জ্বলজ্যান্ত একটা বেডি তাগড়া গতর নিয়ে আমার পাশে দিনরাত পড়ে থাকব? এডা সম্ভব না, এর একটা বিহীত বের করন লাগব।” ইদানিং সাজ্জাদ খেয়াল করছে— রাহেলা খুব নির্জীব, দুই বছর ধরে লাগাতার খাটতে খাটতে মনের দিক থেকে একেবারে নেতিয়ে গিয়েছে। তার ওপর শরীরটা সত্যিই লাউয়ের ডগার মতো লক-লকাচ্ছে! সেই শরীরে পঙ্গু সাজ্জাদ মাঝে মাঝে আগুন ধরিয়ে দিয়ে শিশুর মতো ফ্যালফ্যাল করে তকিয়ে থাকা ছাড়া আর কী-বা করতে পারে! রাহেলা দম বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে, কোনো কোনো দিন সারারাত না ঘুমিয়েই কাটে। সবকিছু মিলিয়ে নৈতিকতায় দায়িত্ব পালনে বেশ কিছুটা ভাটা সত্যি-ই পড়েছে। সাজ্জাদও আজকাল অনুভব করতে পারছে তা।

অনেক ভেবেচিন্তে সাজ্জাদ একটা উপায় বের করেছে— রাহেলাকে বলে, “তুমি একটা চাকরি নাও। এইভাবে তো সংসার চালানো যাইব না। কী কও?” রাহেলা কোনো উত্তর খুঁজে পায় না— বলে, “আমি পড়াশুনা কিছু জানি? আমারে চাকরি দিব কেডায়!” “ছত্তার সাহেবকে ধরলে ব্যবস্থা একটা কিছু হইবই। ধরবনি?” রাহেলা উদাসীন ভঙ্গিমায় বলে, “দরকার মনে করলে কইয়া দ্যাহো।”

ছত্তার সাহেব জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি, তার পক্ষে একটা চাকরির ব্যবস্থা করা কঠিন কিছু না। তাছাড়া সে তো সাজ্জাদদের বাড়িতে অনেকবার এসেছে, তাই সাজ্জাদের স্ত্রী তার অচেনা নয়। ঠিকই রাহেলার জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়ে যায়। কাউন্টারে টিকিট বেঁচার কাজ। গত এক সপ্তাহ হলো রাহেলা কাজে যেতে শুরু করেছে। সমস্যা একটাই— ছেলে বুড়ো সবাই একদৃষ্টিতে রাহেলার দিকে তাকিয়ে থাকে! প্রথম প্রথম খুব সমস্যা হলেও রাহেলা এখন মানিয়ে নিতে শিখেছে। বোরকা পরে, তা যেমন সমাজের চাপে আবার রাত বেরাত চলাফেরা করতে বোরকা পরে বেশ সুবিধাও হয়— চোখ মুখ ঢাকে এই রাক্ষুসে সমাজরে একটুখানি ফাঁকি দেওয়া অন্তত যায়। তাছাড়া তলে কাপড় যা-ই থাক, উপরে একটা গাউন চাপিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়া যায়। বোরকা যে সবাই ধর্মীয় কারণে পরে তা অবশ্যই নয়, বোরকার আড়ালে অনেকে দীনতা লুকায়, কষ্ট লুকায়, জীবনও লুকায়। আমরা ভাবি তারা শুধু দেহ লুকায়। 

কাজে মনোযোগ এবং ওভারটাইমের কারণে রাহেলার উপার্জন বেড়েছে। ভাবছে— স্বামীর জন্য একজন কাজের লোক বাড়িতে রাখবে, না হলে খুব অসুবিধা হচ্ছে— নিজে খাওয়ার সময়টুকু পর্যন্ত বের করতে পারে না। সাজ্জাদকে প্রস্তাব করতেই রাজি হয়ে যায়। বলে, “আমি তো তোমারে এই কথাডাই কমু ভাবতাছিলাম। কিন্তু বেতন ক্যামনে দিব, এর লাইগা দোনামনা করতেছিলাম। তুমি নিজেই চাইতাছো তয় আর অসুবিধাডা কী!” তিন হাজার টাকায় এক জনের সাথে রফা হয়, রাহেলা গোপনে আরও এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে লাইলির মাকে। উপার্জনের সাথে কর্তৃত্ব সম্পর্কিত— রাহেলার মধ্যেও সে পরিবর্তন এসেছে। মানুষ কর্তৃত্ব-ই সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে। প্রত্যেকের একটা দায়িত্বসুলভ কর্তৃত্বের জায়গা থাকতে হয়, নারী-ই বোধহয় এক্ষত্রে বেশি যোগ্য। অন্যের ওপর নারী কর্তৃত্ব করে দায়িত্ব নিয়ে, ভালোবেসে। পুরুষ অনেক সময় শুধুই আধিপত্য বিস্তার করতে চায়।

ছত্তার সাহেব অনেকদিন ধরে চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত ভঙ্গ দিয়েছে। রাহেলাকে কব্জা করতে পারেনি। এমন করে যেসব পুরুষেরা শুধু যৌনতাটুকু চায়, নারীরা কিছুতেই তাদের মেনে নিতে পারে না। চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়াতে রাহেলা তার ওপর কৃতজ্ঞ, ছত্তার সাহেবের নাতির জন্মদিনে বড় উপহারও কিনে দিয়েছে সে। দেখা হলেই সাহেবকে এমনভাবে ‘কাকা’ ডাকে, যাতে কোনো ধরনের মতলব আঁটতে না পারে। 

কিন্তু রাহেলার শরীরটাও যেন কিছুতেই আর বাগ মানছে না। তিন পরত কাপড় ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে আগুন, সে আগুনে রোজই পুড়ছে কেউ না কেউ। উঁইপোকার মতো পুরুষ পোড়ে— কিন্তু প্রেমের রাস্তা এতটাই কঠিন যে, বেশিরভাগ পুরুষ সে রাস্তায় শর্টকার্ট-ই খোঁজে। রাহেলাও বর্তমানে কিছু একটা খুঁজছে— এমন কাউকে খুঁজছে যে তাকে বুঝবে, তার জীবনের গল্পটা জানবে, ভাগাভাগি করবে, বন্ধু হবে। 

কাজের মহিলা বাসায় থাকায় রাহেলার রুটিনে বড় পরিবর্তন হয়েছে। তাছাড়া বাড়িতে ফিরে তেমন কিছু করারও থাকে না— সজল সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে, সাজ্জাদও ঘুমানোর ভাণ করে। সাজ্জাদ চায় স্ত্রী তার স্বাধীন-ই থাকুক। কেউ ভালোবাসতে বাধ্য হচ্ছে— সব মানুষ এটা মানতে পারে না। সাজ্জাদও তার স্ত্রীর সেবা-যত্ন আর নিতে চাচ্ছে না— মনে হয় বড্ড অবিচার করা হচ্ছে— একজন সক্ষম মানুষ কেন একজন অক্ষম মানুষের মতো হতে বাধ্য হবে? রাহেলা অবশ্য রোজ সকালে স্বামীকে খাবার দিয়ে বের হয়। দিনে এখন আর ফেরে না। রাতে বেশিরভাগ দিনই দেখা হয় না। অর্থাৎ বলতে গেলে দিনের মধ্যে একবারই দেখা হয় সন্তান এবং স্বামীর সঙ্গে। 

পুরুষদের প্রতি একরকম ঘৃণা ধরে গেছে— একজনও এই এক বছরে মিললো না, যে কোনো বিনিময় ছাড়া একটু সদয় হবে! এক্ষেত্রে পুরুষেরা সবাই এতটাই কাছাকাছি যে, ভালো মন্দের তফাৎ করা যায় না। তাছাড়া স্বামী ঘরে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে জানলে সবাই সাথে সাথে একটা সরল অংক কষে ফেলে। এজন্য রাহেলা নতুন করে কাউকে স্বামীর সমস্যার কথা বলে না, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে, স্বামীর ঢাকায় একটা দোকান আছে। এদিকে সাজ্জাদ আবার খুব নিশ্চিতভাবেই ধরে নিয়েছে যে, তার স্ত্রী ‘পরপুরুষে’র সাথে যথেচ্ছা মেলামেশা করছে। কিন্তু সত্য হলো— রাহেলা এখন পর্যন্ত কারো সাথে কোনো সম্পর্কে জড়ায়নি। 

সাজ্জাদের আচরণে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ইদানিং বেশ খোশ মেজাজে থাকে। চুল আচড়ানো, পরিপাটি জামাকাপড় পরা, হুইল চেয়ারটা বাদ দিয়ে দেখতে পারলে মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে, সে পঙ্গু। মূলত লাইলির মা-ই তাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। ষাটোর্ধ এই নারীর কোনো কূলে কেউ নেই, থাকলেও খোঁজ নেয় না তারা। একাকীত্বের দুর্বিসহ  এ জীবনে একজন অচল মানুষের সেবাযত্নের সুযোগ পেয়ে সে যেন ঈশ্বর প্রদত্ত একটা দায়িত্ব পেয়েছে! নারী যখন ভালোবেশে কাউকে যত্ন করে সে পরশে বিশালতা থাকে, এক ধরনের অক্সিজেন থাকে— সাজ্জাদ সাহেব প্রাণ ভরে সে বাতাস টেনে নিতে পারছে, এবং দীর্ঘঃশ্বাসটাও ক্রমে যেন ছোট হয়ে এসেছে। যতই উদার হতে চাক না কেন স্ত্রীর প্রতি মালিকানার ভাবটা কিছুতেই তার যাচ্ছিল না। অবশেষে বোধহয় কাটিয়ে উঠতে পেরেছে— মুক্তি পেয়েছে সে ‘পুরুষত্ব’ থেকে, যে রোগ পুরুষকে মানুষ হতে দেয় না কিছুতেই।  

রাহেলাও এক ধরনের নিঃস্কৃতি পেয়েছে যেন। বাঁধন হারা হতে আর কোনো বাঁধা নেই— কেউ তো আর পথ চেয়ে থাকে না। স্বামী সন্তান দুজনকেই সে আগের চেয়ে অনেক প্রাণবন্ত দেখছে। এতে মনে মনে সে লাইলির মা’র সাথে এক ধরনের ঝগড়া বাধিয়ে ফেললেও বাস্তবতা সে মেনে নিয়েছে— চতুর্দিক থেকে নতুন নতুন পথ যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। 

কিছুদিন হলো বাড়িতে একটি কাজের ছেলেও রেখেছে রাহেলা। বাজার করা, তাকে দুপুরের খাবারটা পৌঁছে দেওয়া, আরও অনেক টুকিটাকি কাজ …। ইতোমধ্যে চাকরিটাও সে পরিবর্তন করে নিয়েছে। রয়েল হোটেলের সামনে একটি বড় বাস কোম্পানির ম্যানেজারের দায়িত্ব পেয়েছে। ব্যস্ততা বেড়েছে নানান দিক থেকে। ইদানিং রাতে মাঝে মাঝে বাসায় ফেরে না। রাতে স্বামী সন্তানের সাথে দেখা করার অভ্যেসটাও তো অনেক দিন ধরেই নেই, ফলে তাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। উঁকি দেওয়ার মতো প্রতিবেশীও কেউ নেই। মাস খানেক হলো সবাই একটা ভাড়া বাসায় উঠেছে। প্রকৃতঅর্থেই এখন স্বাধীনতার স্বাদ পেতে শুরু করেছে রাহেলা। সাজ্জাদও যেন নতুন এক জীবন পেয়েছে। লাইলির মা পেয়েছে একটি কাজ, মাথা গোজার ঠাঁই, এবং শেষ জীবনের সঞ্চিত ভালোবাসাটুকু বিলিয়ে দেবার সুযোগ। 

রাতটা এখন অনেক বেশি, তবুও বাসায় ফিরতে চায় রাহেলা। কেন জানি কিছুই ভালো লাগছে না। খুবই পরিচিত রাত, পরিচিত অনুভূতি— কিন্তু কোথা থেকে যেন একটি কল্পিত চরিত্র এসে তার গলাটা চেপে ধরেছে, খুব কষ্ট হচ্ছে নিঃশ্বাস ছাড়তে। রাগিবুল্লাহ রাহেলার জন্য রয়েল হোটেলে একটা স্যুট নিয়ে রেখেছে। বিশাল বড় একটি রুম— রাহেলা জানালার পাশে রাখা ইজি চেয়ারটায় গিয়ে বসে। খুব শক্ত হয়ে রাগিবুল্লাহকে বলে, “আপনার পাঁচ লক্ষ টাকা দেবার কথা, এক মাস চলে গেলো, তারপরও টাকাটা দিচ্ছেন না কেন?” “তোমার পিছনে এই হোটেলে আমার কত খরচ হয় হিসেব করে দেখেছো, ড্রাইভারের স্ত্রী?” “টাকাটা আপনি আমার পিছনে খরচ করছেন না, খরচ করছেন নিজের পিছনে। টাকাটা কখন দিবেন, বলেন?” “আজকেই দিব, আলবৎ দিব।” ব্যাগ থেকে চেক বই বের করে পাঁচ লক্ষ টাকা লিখে টেবিলের উপর চেকটা রেখে দেয়। বাম হাতে পেগ আর ডান হাতে ওয়াইনের বোতল নিয়ে রাহেলার কাছে যায় রাগিবুল্লাহ। পেগটা পূর্ণ করে রাহেলার দিকে বাড়িয়ে দেয়। রাহেলা উঠে গিয়ে স্বযত্নে চেকটা ব্যাগে রাখে। রাত বারোটা বাজে, সেদিকে হুঁশ নেই, তৎক্ষণাৎ কাকে যেন ফোন করে। বলে, “কালকেই আমরা আসব, সবকিছু ব্যবস্থা করেন।”

দুই ঢোকে পেগটা শেষ করে আবার রাগিবুল্লাহর দিকে বাড়িয়ে দেয়। রাগিবুল্লাহ বোতল উপুড় করে পেগটা ভরে দেয়। রাহেলা মনে মনে ভাবে, “খুব সকালে উঠতে হবে, এখনই এই শুয়োরের বাচ্চাটাকে শায়েস্তা করে ঘুম পাড়াতে হবে।” 

চার বছর পরে আবার সাজ্জাদ হাঁটছে! হাঁটতে হাঁটতেই সে বাড়িতে ঢোকে। পাড়া প্রতিবেশীরা সবাই দেখতে আসে। প্যান্ট, জামা, জুতো— একদম পরিপাটি ভদ্রলোক। সাজ্জাদকে একটা চেয়ার পেতে উঠোনে বসতে দিয়ে রাহেলা ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। 

Next Post

বাড়িয়া গণহত্যাঃ পাঁচ শতাধিক শহীদের মধ্যে ছিলেন অনেক নারী ও শিশু

বড়িয়া গণহত্যাটি সংগঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৪ মে (২৯ শে বৈশাখ ১৩৭৮) গাজিপুর সদর উপজেরার বাড়িয়া ইউনিয়নের বাড়িয়া গ্রামে। ১৯৭১ সালে বাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন মো. আজাহার খাঁ। ঐ সময় ঢাকা থেকে জাতিগত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক লোক বাড়িয়া গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। ফলে বাড়িয়া সহ কয়েকটি গ্রামে তখন অনেক লোক। […]
গাজীপুর