বিজ্ঞান ও ধর্মের সীমারেখা // ডক্টর তাপস ঘোষ

ডক্টর তাপস ঘোষ

বিজ্ঞানের ছাত্র বা গবেষক হওয়ার ফলে অনেক সময়েই দেশে বিদেশে বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন আলোচনা চক্রে আমন্ত্রিত হয়েছি এবং আলোচনাতে অংশ গ্রহণ করেছি। আজ আমি দু’টো এরকম বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনার সভার কথা উল্লেখ করব, যা আমাকে বিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে যুগপৎ কৌতূহলী এবং শঙ্কিতও করেছিলো। প্রথমটি ছিল ২০০৪ সালের— খুব সম্ভবত জানুয়ারি মাসে। অটল বিহারি বাজপেয়ী তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং ডক্টর মুরলি মনোহর জোশী ভারতের হিউম্যান রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট মিনিস্টার। ভারতের এলাহাবাদ শহরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইনফরমেশন টেকনোলজি (IIIT) তে এক ইন্দো-ইউএসএ যৌথ কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিলো। দেশ বিদেশের অনেক গণ্যমান্য প্রতিনিধিরা আমন্ত্রিত। কোলকাতা থেকে আমি ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়ন বিভাগের এক অধ্যাপকও আমন্ত্রিত ছিলাম সেই কর্মশালায়। আমরা দু’জনই কর্মশালা শুরুর একদিন আগে এলাহাবাদে পৌঁছেছিলাম। যতদূর মনে পড়ছে আমি কোলকাতা থেকে লখনৌ এয়ারপোর্টে নেমে গাড়িতে এলাহাবাদে পৌঁছেছিলাম। সেটাই ছিলো আমার এলাহাবাদে প্রথম যাওয়া। এলাহাবাদ সম্বন্ধে অনেক পড়েছি। এলাহাবাদ গঙ্গা, যমুনা এবং সরস্বতী— “তিন-নদীর সঙ্গম” স্থলের নিকটে অবস্থিত। এই সঙ্গমস্থলেই প্রতিবছর বিখ্যাত কুম্ভ মেলা হয়ে থাকে। ইতিহাস বলে মোঘল সম্রাট আকবর এলাহাবাদ শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যার ফলেই হয়তো এলাহাবাদের নাম পালটিয়ে ফেলেছে বর্তমান শাসক দল। এই এলাহাবাদেই আমাদের দেশের তিন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহার লাল নেহেরু, লাল বিহারি শাস্ত্রী ও ইন্দিরা গান্ধী জন্মেছিলেন। এই এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়েই ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন খারিজ করে দেওয়া হয়েছিল, যার পরিণতিতে ভারতকে ভারতের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের (ইমার্জেন্সি) মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিলেন। এই এলাহাবাদেই আনন্দভবন, যা ১৯৩০-এর দশকে মতিলাল নেহেরু নির্মাণ করেছিলেন নেহেরু পরিবারের আবাস হিসাবে কাজ করার জন্য। আর এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের চতুর্থতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বন্ধুর থেকে শুনেছি এখানকার লোকজন বেশিরভাগই খুব মামলাবাজ। সে অন্য বিষয়। যাইহোক কর্মশালা উদ্বোধন করার কথা ছিলো ডক্টর মুরলি মনোহর জোশীর। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে, ডক্টর মুরলি মনোহর জোশী এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক ছিলেন। আমাদেরকে সভাস্থলে নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা অপেক্ষা করছিলাম ডক্টর মুরলি মনোহর জোশী আসবার জন্য। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে উনি এলেন। তবে সঙ্গে জনা কুড়ি প্রায় উলঙ্গ সন্ন্যাসী এবং সঙ্গে পুনঃপুনঃ সজোরে “জয় শ্রী রাম ধ্বনী”। মূল মঞ্চে সেই প্রায় উলঙ্গ সন্ন্যাসীরা ডক্টর মুরলি মনোহর জোশীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকলেন যতক্ষণ ডক্টর জোশী মঞ্চে ছিলেন। আমার পাশে কয়েকজন বিদেশি প্রতিনিধি নিজেদের মধ্যে চাওয়া চাওয়ি করতে থাকলেন। আমি লজ্জিত হয়ে গেলাম। বাস্তবিকপক্ষে এ দৃশ্য দেখবার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অধ্যাপকও আমার এক পাশে বসেছিলেন। তিনিও বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন এ দৃশ্য দেখে। আমি ওনাকে বললাম, আমাদের এ ধরনের অনুষ্ঠান না থাকাটাই শ্রেয়। উনি আমাকে বললেন, অনুষ্ঠানের মাঝে চলে যাওয়াটা ঠিক নয়। আমি ওনার কথা মেনে নিয়েছিলাম আমার বিবেকের বিরুদ্ধে গিয়ে। এতদিন বাদে এ কথা লিখতে বসে আমার কোনো দ্বিধা নেই যে, সেদিন সেই অনুষ্ঠান বর্জন না করে আমি ভুল করেছিলাম।

দ্বিতীয় যে ঘটনাটা আমি উল্লেখ করব সেটা ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালযের এক বায়োইনফরম্যাটিকস বিষয়ে এক বিজ্ঞান সভাতে। সেখানেও ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে অনেক বিজ্ঞানী এসেছিলেন। কোলকাতা থেকে আমিও আমন্ত্রিত হয়েছিলাম এবং সঙ্গে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউট কলকাতার বেশ এক ঝাঁক বিজ্ঞানীও ছিলেন এবং সঙ্গে বেঙ্গালুরু একাডেমি অফ সাইন্স-এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সেই সভার অনুষ্ঠানও শুরু হয়েছিলো কোরান ও গীতা পাঠের মধ্যে দিয়ে। অনেকেই হয়তো ভাবছেন তারা কোরান ও গীতা পাঠ করে ঠিকই করেছেন, কারণ, তারা দুই বৃহৎ ধর্মীয় সম্প্রদায়কেই সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। আমি কিন্তু মনে করি— বিজ্ঞানের ঘরে ধর্মীয় অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আমি অনুপ্রবেশ শব্দটি খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি। কোনো বৈজ্ঞানিক সভাতে কোনো রকম ধর্মীয় অনুষ্ঠান অনভিপ্রেত। বিজ্ঞান পরীক্ষামূলক দাবি এবং তার বিশ্লেষণের দিকে মনোনিবেশ করে, আর ধর্ম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশে বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানকে কোনো বিশেষ ধর্মের সঙ্গে মিশিয়ে বিজ্ঞানের আসল সংজ্ঞাকেই ইচ্ছাকৃতভাবে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। আমাদের দেশের সরকারের প্রধান গনেশের মধ্যে প্রাচীন ভারতের প্লাষ্টিক সার্জারির প্রমাণ পেয়েছিলেন। গোমূত্রে করোনা সারানোর ওষুধের সন্ধান দেন বর্তমান শাসক দলের লোকজন ইত্যাদি ইত্যাদি। বিজ্ঞানীকূল এসবের প্রতিবাদ না করলে দেশের সামনে ভয়াবহ বিপদ আসন্ন। এখনই এর প্রতিবাদ না করলে আমরা সেই অন্ধকার গুহ থেকে কি বের হতে পারবো?


লেখক:

প্রাক্তন বরিষ্ঠ অধ্যাপক, বসু বিজ্ঞান মন্দির (বোস ইনস্টিটিউট), কলকাতা, ভারত । বর্তমানে ভিজিটিং প্রফেসর, রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি, পশ্চিম বাংলা ।

ভারত
ডক্টর তাপস ঘোষ, ডান থেকে দ্বিতীয়।