বিশ্বশান্তি ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তুলে ধরতে হবে

কাজী মকুল

কাজী মুকুল


’৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াত-শিবির চক্রের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবিতে ১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। বহু বাধা-বিপত্তি, জেল-জুলুম-হত্যার বন্ধুর পথ অতিক্রম করে গত ২৮ বছরে এই আন্দোলন বিজয়ের প্রথম ধাপ অতিক্রম করেছে, মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৪০ বছর পর ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ হয়েছে। শহীদজননীর জীবদ্দশাতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের এই নাগরিক আন্দোলন তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে এবং দেশের সীমা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।
২০২০ সালের এক ঐতিহাসিক সময়ে আমরা একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ২৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছি। এ বছর ১০ জানুয়ারি থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মুজিববর্ষের কালগণনা আরম্ভ হয়েছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ইতিমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে— যার ভেতর রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর স্মরণে শতবৃক্ষরোপণ, স্কুল কলেজে বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থপাঠ ও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন বিষয়ক রচনা প্রতিযোগিতা এবং বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ভাষায় বিশ্বশান্তি ও মানবকল্যাণে বঙ্গবন্ধুর ব্যবস্থাপত্র তুলে ধরা। যুদ্ধ, সংঘাত ও দারিদ্র্য কবলিত বর্তমান বিশ্বে বিশেষভাবে জঙ্গী মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে আমরা মনে করি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন হতে পারে এর কার্যকরী নিদান। দেশে ও বিদেশে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য শহীদজননী জাহানারা ইমামের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাগরিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই।
গত বছর আমরা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনকে কেন্দ্র করে সরকারের কিছু করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলাম। এর ভেতর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে–

১) ১৯৭১ সালে ভারতের বিভিন্ন পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অজস্র লেখা প্রকাশিত হয়েছে, যার ভেতর বাংলা ও ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য প্রধান ভারতীয় ভাষা— হিন্দি, মারাঠী, গুজরাটি, তামিল, তেলেগু, মালয়ালম, পাঞ্জাবি, উড়িয়া, কত্নড়, মৈথিলী, উর্দু, অহমিয়া প্রভৃতি ভাষায় প্রকাশিত এতদসংক্রান্ত লেখা সম্পর্কে আমাদের কোনও ধারণা নেই। এসব ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা একশ দশ কোটিরও বেশি। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ১৯৭১ সালে যে সব লেখা প্রকাশিত হয়েছিল— মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে এবং ’৭১-এর গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে তা অসামান্য অবদান রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এসব লেখা পুনঃপ্রকাশ এবং বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অনুবাদের উদ্যোগ নেয়া হলে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নতুনভাবে জানতে পারবে একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অনন্যসাধারণ অবদানের পাশাপাশি স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতির অসামান্য বীরত্ব ও আত্মদান সম্পর্কে— যা সেই সময় সমগ্র বিশ্বের স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছিল। বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনেও এই উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

২) আগামী ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০০তম জন্মদিন এবং ২০২০ সালে বাংলাদেশ সহ সমগ্র বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করা হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৮ বছর অতিক্রান্ত হলেও এ পর্যন্ত সরকারিভাবে জাতির পিতার পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়নি। এ বিষয়ে আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে— জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সরকারিভাবে বঙ্গবন্ধুর পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ রচনার জন্য দেশের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষকদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে বিশ্বের ১০০টি ভাষায় এর অনুবাদ প্রকাশ করা প্রয়োজন।

৩) ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর দিল্লী ও ঢাকার জনসভায় বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের কথা বলতে গিয়ে বিশ্বশান্তির উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’য় বিশ্বশান্তির প্রতি বঙ্গবন্ধুর উদ্বেগ ও অঙ্গীকার বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতি বছর বিশ্বশান্তির ক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ অবদানের জন্য বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিদের এক মিলিয়ন ডলারের বঙ্গবন্ধু পদক প্রবর্তনের প্রস্তাব করছি। ভারত (মহাত্মা গান্ধী) ও দক্ষিণ আফ্রিকা (নেলসন মেন্ডেলা) সহ কয়েকটি দেশে রাষ্ট্রনায়কদের নামে এ ধরনের পদক প্রদানের প্রথা রয়েছে।

মুজিববর্ষে দেশে ও বিদেশে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে জানাতে হলে, সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক থেকে বিশ্বনায়কের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার জন্য বিশ্বশান্তি ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় তার অবদান এবং তার রাজনৈতিক দর্শন বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তুলে ধরতে হবে। মুজিববর্ষে দেশের তরুণ প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আলোকিত করার ব্যাপক কর্মসূচি সরকারকেই গ্রহণ করতে হবে। উৎসব নিশ্চয় থাকবে, সেসব উৎসবে বিদেশী অতিথিরাও আসবেন, তবে মুজিববর্ষ উদযাপন যেন শুধু উৎসবসর্বস্ব না হয়, এর সুদূরপ্রসারী কার্যকারিতার কথাও সরকারকে ভাবতে হবে।


লেখক:

সাধারণ সম্পাদক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।