খুব সহজ ভাষায় বললে, এ দেশের সবকিছু দুর্বৃত্তের হাতে চলে গিয়েছে। শুধুমাত্র ‘জঙ্গী দমন’ বা ‘জঙ্গীবাদ’ ই একমাত্র সমস্যা ভাবলে মূল সমস্যা আড়ালেই থেকে যাবে। জঙ্গীবাদ অনেক বড় সমস্যা, কিন্তু একমাত্র বড় সমস্যা নয়।
একজন ‘জঙ্গী’ সাইফুলকে মারলে তাতে শুধু একজন মায়ের বুকই খালি হয়, দেশ বদলায় না মোটেও। যাকে গোয়েন্দাগিরি করে বাগে রাখা যায়, হত্যাকাণ্ড ঘটানোর আগেই ঘিরে ফেলা যায়, তাকে কৌশলে ধরে ফেলা যেত না, এটা ভাবা কঠিন।
যেহেতু সে হোটেল রুম ভাড়া নিয়েছিল, তাই বিভিন্ন ছদ্মবেশে তার কাছে পৌঁছানো সম্ভব ছিল এবং তাকে ধরে ফেলা যেত, সম্ভব ছিল কিনা? জঙ্গীদের কোনো বক্তব্য এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমে সরাসরি প্রকাশ করা হয়েছে? কোনো গণমাধ্যম কর্মী কখনো তাদের মুখোমুখি হতে পেরেছে?
ফলে আমাদের দেশের জঙ্গীবাদ শুধু সমস্যা না, একটি সন্দেহজনক সমস্যা হিসেবে স্বীকৃত ইতোমধ্যে। মৌলবাদ আছে, জঙ্গীবাদও ভয়াবহভাবে বিস্তার লাভ করেছে এদেশে, এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, কিন্তু এই জঙ্গীবাদের কোনো আগাপাশতলা নেই!
যাগগে, যেহেতু কোনো ক্লু নেই, তাই জঙ্গীবাদ নিয়ে বিশেষ কোনো আলোচনারও সুযোগ নেই। সমাজের যেসব ‘মূল’ সমস্যার কথা বলছিলাম, সেদিকে একটু আলোকপাত করাটাই মূলত এই লেখার উদ্দেশ্য।
‘সিম্বলিক ইন্টারকসানিজম’ নামে বিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সমাজ বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা আছে। অর্থাৎ, ব্যক্তি মানুষ কেমন আচরণ করবে সেটি অবচেতনে সমাজই ঠিক করে দেয় এবং এটি বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়।
আমাদের সমাজের “মড অব একশন এন্ড রিঅ্যাকশন” দুর্বৃত্তের আচরণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এখন, সেটি ধার্মিক দুর্বৃত্তও হতে পারে, ধর্মহীন দুর্বৃত্তও হতে পারে, তাতে কিছু যায় আসে না।
ধার্মিক আমাদের দেশে প্রায় সবাই, আবার আপাতভাবে মনে হয় দুর্বৃত্তও প্রায় সবাই। এটা মনে হওয়ার কারণ ঐ ‘সিম্বলিক ইনটারএকশন’।
আমি ধমক খেয়েছি, অপমানিত হয়েছি বা ঠকেছি, সেটি আবার আমি অন্যের উপর প্রয়োগ করছি। যে দিনরাত পা ধরছে সে অন্যকে পা ধরাতেই চাইবে। ডমিনো ইফেক্ট, ঢাকার আচরণ বেয়ে বেয়ে পৌঁছে যাচ্ছে পঞ্চগড়।
বড় দেশ হিসেবে ভারতের মানুষের আচরণ দ্বারাও আমাদের দেশের মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়। কেউ হয়ত ভারতে গিয়ে দেখে এসেছে যে সেখানে কোনো এক বাথরুমেও দেবদেবীর ছবি, সেও দেশে এসে “উন্নত দেশের উন্নত কালচার” ফলো করবে, বাথারুমে অনুরূপ কিছু বসিয়ে আত্মতুষ্টিতে নিমগ্ন হবে। পাল্টাপাল্টি, এটা এক ধরনের প্রতিশোধও। সাধারণ মানুষের প্রতিশোধের এই মানসিকতাটা তৈরি করে দিয়েছে শীর্ষে বসে থাকা দুর্বৃত্তরা।
সমাজে প্রকৃতপক্ষে খুব খারাপ মানুষ খুব বেশি থাকে না, আবার খুব ভালো মানুষও খুব বেশি থাকে না, কিন্তু সমাজে এদের প্রভাবই মূল প্রভাব এবং সেটিই সাধরণ মানুষের মধ্যে দৃশ্যমান থকে।
যেহেতু এদেশে খুব খারাপরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শাসক হয়েছে, আবার তারা ধর্মের ছত্রছায়ায়ও গিয়েছে, তাই তাদের আচারণই এখন সমাজের সাধারণ আচরণে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষও ধর্মের বাতাবরণে থেকে যেকোনো কাজ করতে চায় তাদের প্রভাবের কারণেই।
ফলে সামান্য রেস্টুরেন্ট দোকানেও শোভা পায় মন্দির বা মসজিদের টাইলস্ ছবি। আগে বাস বা ট্রাকের পিছনে-পাশে লেখা থাকত, “আপনার শিশুকে শিক্ষা দিন”। এখন লেখা থাকে- “আপনার শিশুকে কুরআন শিক্ষা দিন”।
রাস্তার পাশে একটি নতুন দোকান হয়েছে, চিকন একটি ঘর (আনুমানিক তিন হাত/ছয় হাত) নিয়ে বিরানীর দোকান দিয়েছে একজনে। দোকান ভাড়া আট হাজার টাকা, অগ্রীম দিতে হয়েছে তিন লক্ষ টাকা! ঢাকা শহরে ঘর ভাড়ার এটি একটি ভয়াবহ দিক, এবং ভিন্ন আলোচনার বিষয়।
কেন ঐ দোকানটির ভাড়া আট হাজার টাকা হবে? কেন অগ্রীম তিন লক্ষ টাকা দিতে হবে? এটা ফ্রি-স্টাইলে হতে পারে না। পারে কি?
সে আলোচনায় না যাই। তবে রাষ্ট্রের উচিৎ বড় বড় শহরে বাড়ি-দোকান-অফিশ ভাড়ার বিষয়টি পরিকল্পনা এবং আইনের মধ্যে আনা।
ঐ ব্যক্তি দোকানটির নাম দিয়েছে ‘আল্লার দান’। নামটি দেখে আপনার মনে হতে পারে, লোকটি খুব কনজারভেটিভ, খুব ধার্মিক বা কেউ কেউ মনে করবেন যে সে একজন ধর্মব্যবসায়ী। আসলে এসব কিছুই না, ঐ নামের জন্য তার এক টাকাও বেশি ব্যবসা হবে না, মানুষ যেখানে ভালো খাবার পাবে, তুলনামূলক কম দামে বা একই দামে পাবে সেখানে যাবে। কাস্টমার শুধু দাম, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি দেখবে।
নামটি নিয়ে কারো কারো স্বস্তি-অস্বস্তি থাকতে পারে, কিন্তু তার টার্গেট কাস্টমারের ওপর নামের কোনো প্রভাব পড়বে না। তাহলে এদেশে লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের বেঁচাকেনা এত বেশি হত না। মুসলিম সুইটস থেকেই নব্বইভাগ মানুষ মিষ্টি কিনত। তাই না?
তারপরেও সে কিন্তু এই নাম দিয়েছে ব্যবসার কথা চিন্তা করেই। কারণ, তার ওপর “সিম্বলিক ইন্টারকসানিজম” কাজ করছে। সমাজে চর্চিত এবং চর্বিত ধর্মের প্রভাব এবং ধর্মীয় দৃশ্যতা দেখে তার মনে হয়েছে নামটি তার ব্যবসায় হেল্প করবে।
পাশাপাশি এসব ক্ষেত্রে এক ধরনের ওনারশিপও কাজ করে, এটা আমার, এই ধর্মটা আমার, তার মানে সকল মন্দির বা মসজিদ আমার, আমার ধর্মের কোনো মানুষের সফলতায়ও আমার অধিকার।
ভিন্নধর্মীর সফলতায় বা কোনো অর্জনে ‘লস’ হয়েছে মনে করার বিষয়টিও সমাজের চাপিয়ে দেওয়া বিষয়। না হলে মানুষ হিসেবে নিজেকে কোনো ধর্মের অধীন ধরে নিয়ে সমগ্র মানব সমাজ হতে কেউ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলত না। কারণ, প্রকৃতিতে এই বিচ্ছিন্নতাবাদ নেই, প্রকৃতি এই বিচ্ছিন্নতাবাদ সহ্য করে না।
এটাকে (আলোচিত লোকটি দোকানের যেভাবে নামকরণ করেছে) কি কোনোভাবেই ধর্ম ব্যবসা বলা যাবে? যাবে না। অর্থাৎ যত সহজে আমরা সবকিছুকে ধর্ম ব্যবসা বলে ফেলি সবকিছু অতটা সরল বিবেচনায় ধর্ম ব্যবসা নয়।
ধরা যাক, একজন লোক অতটা শিক্ষত নয়, ‘মেধাবী’ বা ‘চালাক’ নয়, যতটা থাকলে সমাজের সাথে এঁটে ওঠা যায়, কিন্তু সে তাঁর অধ্যাবসায় এবং শ্রমের কারণে বড় কোনো ব্যবসা দাঁড় করিয়ে ফেলেছে, বা হয়েছে।
এখন কিন্তু ফেউ-এর অভাব নেই, বিভিন্ন জনে বিভিন্নভাবে তাকে নাজেহাল করে টাকায় ভাগ বসাতে চায়, এবং এটা সত্য যে এই দলে ‘শিক্ষিত-বুদ্ধিমান’ লোকের সংখ্যাই বেশি। মনে রাখতে হবে যে এরা কোনো সাম্যবাদী চিন্তা থেকে তাকে নাজেহাল করতে আসে না, অাসে বিনাকষ্টে লাভের জন্য- “বরশি না বেয়ে খালুই থেকে মাছ তুলে নিতে”।
সে দেখেছে, ধর্ম ব্যবসায়ীরা ধর্মের আশ্রয়ে নিজের চারপাশে মোটামুটি একটি নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে, একইসাথে সাধারণ মানুষের জন্যে একটি মরণ-ফাঁদও তৈরি হয়েছে সেখানে, তাতে আবার তাদের আয়ও বাড়ছে।
যেহেতু ঐ ব্যক্তির পক্ষে সৃষ্টিশীলভাবে মোকাবেলা করা বা কোনো নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা সম্ভব নয়, তাই সেও বাধ্য হয় সহজ সামাজিক প্রতিক্রিয়াটা দেখাতে এবং তা ব্যবহার করতে।
কীভাবে আপনি এই লোকটাকে ধর্মদুর্বৃত্ত থেকে আলাদা করবেন? কোনো মানদণ্ড আছে কি? যদি না থাকে তাহলে গড়পড়তা কথা বলায় কোনো লাভ আসলে নেই।
শনির আঁকড়া থেকে নিউ মার্কেট পর্যন্ত ছোট যে গাড়িগুলো ফ্লাইওভার দিয়ে চলে ওগুলো খুব কার্যকরী যানবাহন, খুব সহজে–মাত্র পনেরো মিনিটে পৌঁছে যাবেন গন্তব্যে যেখানে আগে দুই ঘণ্টাও লাগত। ভাড়া একটু বেশি- মাথাপিছু ত্রিশ টাকা।
আজকে একটু ওদের সাথে কথা বললাম, যেহেতু ফাঁকা ছিল, দুপুর বেলা। বললাম, আপনাদের তো দিনে অনেক অায় হওয়ার কথা। জানলাম, অনেক আয় তাদের হয় না। জীবনমান তদের একই থাকে, দিনশেষে ঐ একই জীর্ণতা এবং শীর্ণতা।
তাহলে বাড়তি টাকা গেল কোথায়? যায় তাদের পকেটে যারা কাজ না করে মাতব্বরি করছে, অমিতাচারী করে বেড়াচ্ছে জীবনের সর্বকোণ থেকে। প্রতিদিন ঐ গাড়িগুলো থেকে চাঁদা তোলা হয় ৭০০ টাকা করে! স্বাভাবিক কোনো বিষয় এটি?
সেদিন শাহবাগ থেকে রঙধনু নামক একটি বাসে উঠেছি। দেখলাম, সামনে যতজন মহিলা বসা সবাই মাথা ঢাকা। আজকেও রাস্তাঘাটে খেয়াল করলাম, বেশিরভাগ নারী এখন ‘হিজাব’ করে। কীভাবে দেখবেন বিষয়টা?
মনে করবেন যে ঐ নারীরা সবাই খুব রক্ষণশীল বা তাদের সতীত্বের সুপার গ্লুর মত খুব জোর বা তারা অন্ধধার্মীক? মোটেই তা না, এটা সমাজের চাপিয়ে দেওয়া বিষয় মাত্র এক্ষেত্রেও।
শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের আচরণ হিসেবে (শাসকের আচরণ সংখ্যাগরেষ্টর আচরণে পরিণত হচ্ছে, অর্থাৎ বিষয়টি গণতান্ত্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়) বিষয়টি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যেও একটি আইকনিক ভ্যালু তৈরি করে দিচ্ছে সমাজে!
নারীরা যখন দেখছে, আসলেই ‘হিজাব’ করলে কোনো না কোনোদিক থেকে কিছু লাভ আছে, তারা সেটি বেছে নিয়েছে। অনেকে ভয়ে করছে, অনেকে পরিবারের কারণে কারছে, অনেকে সামাজিক বোধটা তার মধ্যে তুলে নিয়ে করছে।
তাতে নারীত্ব কিছু বদলাচ্ছে না, নারী নারীই থাকছে, কিন্তু অকপটতা থাকছে না। সতীত্ব এতে রক্ষা হয় না, ‘সতীত্ব’ জিনিসটাই বা আসলে কী? কিন্তু এতে যেটা হচ্ছে, সততা বলে আর কিছু থাকছে না।
মানুষ সহজাতভাবে তার ভেতরের আকাঙক্ষা থেকে সে কারো জন্য আপ্লুত হলে ‘হিজাব-বোরকা-পালকি’ তাতে বাঁধ সাধতে পারে কি কোনোদিন?
বরং এতে অনেকে সমাজের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পায় শুধু। নিজেকে আড়াল করে লোকালয়ে চলতে পারার বৈধ সুবিধা তো কিছু দেখি না, কিন্তু অবৈধ সুবিধা থাকতে পারে অনেক প্রকার। যে ভয়ে আপনি তাদের আব্রু পরিয়ে দেন, সে চর্চাই এ আব্রুতে সবচে বেশি হয় বর্তমানে। অস্বীকার করতে পারবেন?
শুরুর কথা দিয়ে শেষ করি। সমাজে ‘শাসকের’ অাচরণই সমাজের আচরণ। ‘শাসক’ বুঝতে হবে বিভিন্ন মাত্রা থেকে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে। বিল দিয়ে গ্রামের চায়ের আড্ডার কন্ট্রোল নেওয়া লোকটিও ঐ ছোট্ট বলয়ে একজন শাসক।
সমাজের ছোট থেকে বড় প্রতিটি ক্ষেত্রে শাসক আছে। এখানে একটা গিট্টু আছে, সাধারণ মানুষের আচরণ দ্বারা শাসকের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়, আবার শাসকের আচরণ দ্বারা সাধারণ মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ যে লাউ সেই কঁদু।
এর বাইরে থাকে লেখক সমাজ, প্রকৃতপক্ষে লেখক যারা। তো লেখক সমাজের কোনো কন্ট্রোল যদি সমাজের ওপর না থাকে, অথবা তারাও যদি সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলে বা চলতে বাধ্য হয়, তাহলে সেই সমাজ বিন্দুমাত্র এগোনোর কোনো সম্ভাবনা নেই।
আসল কথা হচ্ছে, ঐ গিটটি খোলা। কীভাবে তা খোলা যাবে? মুক্তির বার্তা দিয়ে, নতুন কথা, নতুন কাজ, পরিকল্পনা-প্রতিবাদ-প্রতিরোধ এবং শেষপর্যন্ত ভালোবাসা দিয়েই সেটি খুলতে হবে। সে ভালোবাসা থেকে সাইফুলরাও যেন বাদ না পড়ে।
সম্পাদকের কলাম