বাড়িয়া গণহত্যাঃ পাঁচ শতাধিক শহীদের মধ্যে ছিলেন অনেক নারী ও শিশু

গাজীপুর

বড়িয়া গণহত্যাটি সংগঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৪ মে (২৯ শে বৈশাখ ১৩৭৮) গাজিপুর সদর উপজেরার বাড়িয়া ইউনিয়নের বাড়িয়া গ্রামে। ১৯৭১ সালে বাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন মো. আজাহার খাঁ। ঐ সময় ঢাকা থেকে জাতিগত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক লোক বাড়িয়া গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। ফলে বাড়িয়া সহ কয়েকটি গ্রামে তখন অনেক লোক।

জয়দেবপুরের ভাওয়াল স্টেট (ভাওয়াল রাজবাড়ীতে স্থাপিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট) এবং কালিগঞ্জ থানায় পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করেছিল— ওখান থেকেই তারা বিশেষ করে হিন্দু গ্রামগুলোর ওপর নজর রাখতো। 

স্থানীয় স্কুলে বিকেলে ফুটবল খেলা হত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে স্থানীয় রাজাকারেরা জানায় যে, মুক্তিযোদ্ধারা এই মাঠে ট্রেনিং নেয়। প্রমাণ হিসেবে একদিন তারা মাঠের খেলোয়াড়দের দেখায়। এমনিতেই হিন্দু সম্প্রদায়কে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় দোসর জামায়াতে ইসলামী, নেজামি ইসলামী এবং অন্যান্য জঙ্গিবাদী রাজনৈদিক দলের সদস্যরা গণহত্যার লক্ষবস্তুতে পরিণত করেছিল। পাশাপাশি স্থানীয় হিন্দুরা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে— একথা শোনার সাথে সাথে গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়তে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আর কোনো বাধা থাকে না।

দিনটি ছিল শুক্রবার— মুসলিম সম্প্রদায়ের জুম্মার নামাজের দিন। নামাজের পরপরই পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামটিতে প্রবেশ করে। রেওয়া ব্রিজ (তখন ছিল বাঁশের পুল) পার হয়ে এসে প্রথমে ফ্যালাইনা মুচির বাড়িতে বেঁধে রাখা একটা শুকরকে তারা গুলি করে। এই গুলির শব্দ শুনে গ্রামবাসী পালাতে শুরু করে।

গ্রামের প্রবেশ পথে বাঁশ এবং কাঠ দিয়ে তৈরি একটি পুল ছিল— যেটিকে বলা হত ‘রেওলা ব্রিজ’। সেখান থেকেই গুলি করতে করতে পাকিস্তানী সৈন্যরা  গ্রামের ভেতর ঢুকতে থাকে। গ্রামটির তিনদিকে ছিল বেলাই বিল, তাই বিল না পেরিয়ে নিরাপদ স্থানে পালানোর কোনও পথ ছিল না।

তিনশো থেকে চারশো সদস্যের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল দুপুরে গ্রামগুলিতে প্রবেশ করে এবং নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এসময় হরর সিনেমাতে যেমনটি দেখা যায় ঠিক সেভাবে নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পালাতে থাকে। স্থানীয়রা বিলে পানির গভীরতা সম্পর্কে জনালেও যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারা জানত না যে, বিলের কোথায় কতটুকু পানি, ফলে অনেকে বিলের পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল। কোলের শিশু পানিতে পড়ে ডুবে মরেছিল— দুই শিশু দুই বোগলে নিয়ে বিল পার হওয়ার সময় মা একজন শিশু নিয়ে তীরে ফিরতে পারলেও, আরেকজন ডুবে মরেছে পানিতে, চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না হতভাগ্য মায়ের, একজনকে নিয়ে সে তীরে ফিরেছে। বিলের পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল অনেক বৃদ্ধ মানুষও।

মায়া রাণী রায়, স্বামী: সচীন্দ্র মোহন রায়, সাং: জয়দেবপুর, তিনি বাড়ীয়া গ্রামে আশ্রীত ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামটিতে হামলা করার পর অন্য সবার মতো মায়া রাণীও তার কোলের দুই শিশু নিয়ে বিলাই বিল সাঁতরে পার হতে চাচ্ছিলেন। শিশু দুটি তার হাত হতে ছুটে গিয়ে ডুবে মারা যায়।

ঘরের বারান্দায় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো একজন অপ্রকৃতস্থ যুবককে। বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলে ওই যুবককও জ্যান্ত পুড়ি মারা যায়, একইভাবে কয়েকজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাও ঘরের ভেতর পুড়ে মারা গিয়েছিল বলে জানা যায়। পলায়নপর মানুষদের ওপর চলেছে নির্বিচার গুলি, পাখির মতো পথের পাশে, খালে-ব্যাড়ে-বিলের পানিতে লুটিয়ে পড়েছে গুলিবিদ্ধ মানুষ।

চাঁন মোহন রায়, পিতা: মৃত: হরেন্দ্র চন্দ্র দাস, তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। নিজ ঘরের বারান্দায় তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হত। পাকিস্তানি বাহিনী অতর্কিতে হামলা করলে কেউই তার শিকল খুলে দেওয়ার সময় পাননি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘরে আগুন দিলে মানসিক ভারসাম্যহীন চাঁন মোহন রায় শিকল বাঁধা অবস্থায় পুড়ে মারা যান।

ক্লান্ত বিধ্বস্ত পলায়নপর মানুষগুলো আশ্রয় নিয়েছিল বেলাই বিলের পাড়ে। তারা ভেবেছিল এখন আর তাদের ওপর আক্রমণ করা হবে না। কিন্তু তাদেরকে ভুল প্রমাণিত করে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর মেশিনগান আবার গর্জে ওঠে। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসে বিদ্ধ করে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত-ক্ষুধার্ত-সর্বহারা-আশ্রয়হীন জনতাকে। আহত মানুষদের হাসপাতালে নেওয়ার মতো কেউ ছিল না। বেশিরভাগ মানুষ দ্রুত মৃত্যুবরণ করলেও অনেকেই দীর্ঘক্ষণ রক্তক্ষরণের ফলে মারা যায়। অনেকে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ে বিলের পানিতে, সেখানেই তাদের সলীল সমাধি হয়। এই মহাপ্রলয় থেমে থেমে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত চলে। 

গণহত্যার প্রায় এক সপ্তাহ পর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া বাড়িঘরে ফিরে বাড়িয়া গ্রামবাসী দেখতে পায়— বসতবাড়ি, জিনিতপত্র সবকিছু পুড়ে কয়লা হয়ে রয়েছে, চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো পোড়া মানুষের অর্ধগলিত লাস, পথের পাশে এদিকে ওদিকে শুধু লাস আর লাস। কুকুরে খাওয়া লাস, শিয়ালে-শকুনে খাওয়া লাস, মা ও শিশুর লাস— প্রত্যক্ষদর্শী না হয়ে সে দৃশ্যের আবেগময় বর্ণনা সম্ভব নয় কখনও। দূরদূরান্ত থেকে যারা আশ্রয়ের খোঁজে গিয়েছিল তাদের নাম পরিচয় আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বাড়িয়া গ্রাম ছাড়াও পাশ্ববর্তী কামারিয়া এবং পাকুরিয়া গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছিল।

বাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা প্রত্যক্ষদর্শী দুলাল চন্দ্র দাস (৬৬) জানান,

সে সময় তার বয়স ছিল আনুমানিক ১৬ বছর। পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করার পর পরিবার পরিজন নিয়ে বেলাই বিল পাড়ি দিয়ে কালীগঞ্জ রাঙ্গামাটি মিশনারিতে অশ্রয় নিয়েছিলাম। পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামে হত্যাযঞ্জ চালিয়ে এ প্রান্তে পৌঁছাতে যে সময় লেগেছিল এর মধ্যে ভাওয়াল বাড়িয়ার স্থানীয় লোকজন সহ আশ্রিত কয়েক হাজার লোক কেউ নৌকায়, কেউ বা সাঁতার কেটে বেলাই বিল পার হয়ে কালীগঞ্জের দিকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা পিছু ধাওয়া করে এখানে এসেও গুলি চালায়। অনেককে নৌকা থেকে নামিয়ে হত্যা করে। সাত দিন পর গ্রামে ফিরে আসি আমি। দেখি— সব বাড়ি ঘর পাকিস্তানি সৈন্যরা পুড়িয়ে দিয়েছে। এখানে সেখানে, বিলের পানিতে পচা-গলা লাশ আর লাশ।

’৭১ সালে এতবড় একটি হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হলেও বাড়িয়াতে আজ পর্যন্ত কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়নি। শহীদ পরিবারগুলোর খোঁজ খবরও কেউ রাখে না। ‘শহীদস্মৃতি সংরক্ষণ কমিটি’র আহ্বায়ক লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক দিব্যেন্দু দ্বীপ গত ২২ জানুয়ারি (২০২১) এবং ২৮ থেকে ৩০ জানুয়ারি বাড়িয়া গ্রামে গিয়েছিলেন শহীদ পরিবারগুলোর সাথে কথা বলতে। ভুক্তভোগীদের সাথে দীর্ঘ আলাপচারিতায় উঠে আসে তাদের স্বজন হারানোর বেদনা এবং এখনও কীভাবে তারা নানানভাবে নিগৃহীত হচ্ছে সে চিত্রটি। 

আরো পড়ুনঃ

বাড়ীয়া গণহত্যাঃ শহীদ জায়া আরতী রাণী দাস-এর গল্প হারা মানায় সিনেমার দৃশ্যকেও! (ক্লিক)