ফরিদপুর জেলার তৎকালীন চরভদ্রাসন থানার গাজিরটেক ইউনিয়নের চরসুলতানপুর গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, রাজনীতিক, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শেখ সৈয়দ আহম্মদকে পাকিস্তানি বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় ফরিদপুরে আটক করে ১৭ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে। এরপর তাকে ক্যাম্পে (ফরিদপুর জেলা স্টেডিয়ামে তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল) আটকে রেখে নির্যাতন করে বিভিন্ন তথ্য বের করার চেষ্টা করা হয়। অতঃপর আনুমানিক ২০ ডিসেম্বর, পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন তাকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়।
শহিদ বুদ্ধিজীবী শেখ সৈয়দ আহম্মদ ১৯৪০ সালে কংগ্রেসের রাজনীতির হাত ধরে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। জনগণ পক্ষে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন সময়ে কারাবরণ করেন। পঞ্চাশের দশকে তিনি একবার গাজিরটেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ’৫২, ’৬২, ’৬৪, ’৬৬, ’৬৯-এর গণআন্দোলন এবং ’৭০-এর নির্বাচনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং নির্দেশে চরভদ্রাসন থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তাানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অনেক হিন্দু বাড়ীর পাশাপাশি আমাদের বাড়ীতেও লুটপাট চালায়।
মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আহম্মদ মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক ছিলেন। তিনি ১৭ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাথে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হবার জন্য তিনজন (১. হালিম কেরানী, পিতা: মৃত শেখ শহর আলী, গ্রাম: চর হরিরামপুর; ২. শেখ নূর মোহাম্মদ (মোহাম্মদ নূর হোসেন), পিতা: মৃত লাক্ষু মাতুব্বর, গ্রাম: এন্তাজ মোল্যারডাঙ্গি; ৩. মৃত শেখ দুদু মিঞা, পিতা: মৃত শেখ হাছেন মিঞা, গ্রাম: সিকদারডাঙ্গি) সফরসঙ্গী সহ আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা সাবেক এমএলএ সামসুদ্দিন মোল্যার বাসায় যাচ্ছিলেন।
তিনি (সৈয়দ আহম্মদ) ফরিদপুর ওয়্যারলেস পাড়ার জুট ব্রোকারেজ থেকে কিছু টাকা তোলেন। পথমধ্যে আলিমুজ্জামান লোহার ব্রিজের নিকট থেকে তাকে ও তার অন্য তিন সফরসঙ্গীকে আলবদর-রাজাকার, শান্তি কমিটির সদস্য আলী আহসান মুজাহিদ, নান্নু চেয়ারম্যান সহ আরো কয়েক জন ধরে নিয়ে যায়। পাকিস্তান আমলের সাবেক তথ্যমন্ত্রী হুমায়ুন কবির সাহেবের বাসা ছিল তখন ফরিদপুরের আলীপুরে। উক্ত বাসার পাশে জনৈক হিন্দু বাবুর বাসা জবরদখল করে মুজাহিদ বাহিনী তখন শান্তি কমিটির ক্যাম্প গঠন করেছিল। এই ক্যাম্পে বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আহম্মদকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা হলেও তিনি কোনো তথ্য দিতে অস্বীকার করেন। পাকিস্তান পিরিয়ডের এমএলএ আদিল উদ্দিন হাওলাদার ছিলেন ফরিদপুর জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। সৈয়দ আহম্মদের তিন তরুণ সফরসঙ্গী মধ্যে দুইজন এখনো বেঁচে আছেন।
নূর মোহাম্মদ (বর্তমানে থানা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি) এবং আব্দুল হালিম মিঞা বলেন, তখন আমাদের নেতা সৈয়দ আহম্মদকে ছাড়িয়ে আনার জন্য আমরা আদিল উদ্দিন এবং জেলা শান্তিকমিটির অন্যান্য কয়েকজন সদস্য আফজাল উকিল, বাকাওল উকিল, আলাউদ্দিন খান, আব্দুল হাই মোখতার প্রমুখের কাছে গিয়েছিলাম। তারা সবাই একবাক্য সৈয়দ আহম্মদকে ছেড়ে দিতে অস্বীকার করে এবং আমাদের গালাগাল করে, নানান ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে বিতাড়িত করে। চরভদ্রাসনের কিছু স্বাধীনতাবিরোধী নেতা তখন ফরিদপুর ঈশান ইনস্টিটিউটের (তখন এটি ছিল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বর্তমানে এটি প্যারামেডিকেল) সামনে একটি দোতালা ভবনের উপর তলায় বসবাস করত। এর মধ্যে চর হরিরামপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই খান, মেম্বার সোনা মিঞা শেখ, সেরজন মৃধা, সোনা মিঞা, শাহ মউরি, কানু মণ্ডল, দেলোয়ার কমান্ডার, কুটি বেপারি প্রমুখের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। সৈয়দ আহমদকে ছাড়িয়ে আনার জন্য তাদের কাছেও আমরা গিয়েছিলাম। তারাও কোনো ধরনের সহযোগিতা করতে অস্বীকার করে।
পরবর্তীতে আলী আহসান মুজাহিদ নিজে এবং তার নির্দেশে অন্যান্য রাজাকাররা সৈয়দ আহম্মদকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী তাকে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে অবস্থিত তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ঈদের দিন পর্যন্ত তিনি ক্যাম্পে বন্দী ছিলেন বলে আমরা জানি। এরপর তার আর কোনো খোঁজ মেলিনি।
মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান এবং কার্যক্রম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের জন্য দফায় দফায় নির্যাতনের পর তাকে আনুমানিক ২০ নভেম্বর তারিখে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বন্দী থাকা অবস্থায় জনাব সৈয়দ আহম্মদের বড় মেয়ের (নূরজাহান বেগম) বড় ছেলে (মোহাম্মদ মজিবুর রহমান) ঈদের দিন খাবার নিয়ে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। মজিবুর রহমান তাঁর সাথে কিছু কথাও বলেছিলেন। সৈয়দ আহম্মদ তাকে বলেছিলেন তার দুই মুক্তিযোদ্ধা সন্তান (বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আজিজুল হক (আজীজ মাস্টার এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান) যেন তাকে দেখতে না যায়, গেলে তাদেরকেও বন্দী করে ফেলবে।
ঐদিন রাতে একজন বিহারী পুলিশ (মৃত সানাউল্যাহ মিঞা) সৈয়দ আহম্মদের বড় মেয়ে নূরজাহান বেগমের কাছে তার ব্যবহৃত লাঠি, পায়ের চটি এবং গায়ের শাল পৌঁছে দেয়। এ থেকে ধারণা করা হয় যে, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বীর সেনানী সৈয়দ আহম্মদকে হত্যা করা হয়েছে।