পবা উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার রওশন আরা বেগম অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। নানা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থে তিনি ঢাকা ও রাজশাহীতে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। দামি গাড়ি কিনেছেন। এ ছাড়া তার অফিস সহায়ক আমিনুল হকের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। অবৈধ উপায়ে তাদের কোটি কোটি টাকা অর্জন এবং বিপুল সম্পদ গড়ে তোলার অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়েছে। সোমবার দিনভর সরেজমিন তানোর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার তৌহিদুল ইসলাম তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পবা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের মোহরার সমিতি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুক) রওশন আরা ও আমিনুলের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদক দুজনের দুর্নীতি অনিয়ম ও বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেয়। দুদকের নির্দেশে ও নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শকের আদেশক্রমে তানোর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার তৌহিদুল ইসলাম তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেন। এ বিষয়ে তিনি শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন বলে জানান।
রওশন আরা রাজশাহী সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে টাইপিস্ট পদে কর্মজীবন শুরু করেন। ২০০৭ সালে পদোন্নতি পেয়ে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে উচ্চমান সহকারী পদে যোগ দেন। এরপর বদলি হয়ে তিনি রাজশাহী সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে আসেন। এরপর সাব-রেজিস্ট্রার পদে তিনি পদোন্নতি পান।
মোহরার সমিতির অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে-রওশন আরা সাব-রেজিস্ট্রারের দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকে বেপরোয়া ঘুস, দুর্নীতি-অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি শুরু করেন। এ কাজে তাকে অফিস-সহায়ক আমিনুল সহায়তা করেন। অনিয়ম-দুর্নীতি করে তারা অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। ঢাকার মোহাম্মদপুরে রওশন নিজের নামে একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। এর দাম প্রায় ছয় কোটি টাকা। রাজশাহী মহানগরীর ভেড়িপাড়া পিটিআই স্কুলের ডান পাশে তিনি তিনতলা ভবন নির্মাণ করেছেন। তবে দুই কোটি টাকা দামের ভবনটি তিনি তার ভাই আইয়ুব আলীর নামে করেছেন। ২২ লাখ টাকা দামের গাড়িতে চড়েন রওশন। এ ছাড়া বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে রওশন আরা তার বোনের দুই ছেলের একজনকে রাজশাহীর সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে টিসি মোহরার প্রধান পদে এবং অপরজনকে কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি দিয়েছেন। এতে তিনি ২২ লাখ টাকা খরচ করেছেন।
জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৫ জুলাই ১৮ লাখ টাকা ঘুস (কমিশন) নিয়ে রওশন আরা দুটি জাল দলিল সম্পাদন করেছেন। এ জাল দলিলে তিনজনকে (দাতা) ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন প্রতিবন্ধী। রাজস্ব ফাঁকির জন্য জমির দামও দেখানো হয়েছে। রওশনের ঘুস-দুর্নীতির মূল হাতিয়ার আমিনুল। দলিল নিবন্ধনের পরিচয়পত্র ও প্রত্যয়নপত্র না থাকলেও আমিনুলের মাধ্যমে দলিল গ্রহীতাকে খাস কামরায় ডেকে নিয়ে রওশন মোটা টাকার বিনিময়ে দলিল নিবন্ধন করেন। হাতে টাকা না পেলে তিনি দলিলে স্বাক্ষর করেন না।
ঘুস ছাড়া একটি ছোট কাজও রওশন করেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। ঘুস না পেলে দলিল তিনি দিনের পর দিন ফেলে রাখেন। ফলে দলিল গ্রহীতারা সার্টিফায়েড কপি পেতে চরম ভোগান্তির শিকার হন। এ ছাড়া দাতা ও গ্রহীতা এবং দলিল লেখকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে রওশন আরা প্রায়ই দুর্ব্যবহার করেন। সব সময় তিনি কর্কশ ভাষায় কথা বলেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে পবা উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার রওশন আরা বেগমের সঙ্গে যোগযোগ করা হয়। তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের তদন্ত হওয়ার কথা তিনি অস্বীকার করেন। তবে এ সংক্রান্ত প্রমাণ, অভিযোগ ও নথিপত্র থাকার কথা বলা হলে তিনি ফোন কেটে দেন। এরপর কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি আর রিসিভ করেননি।
মোহরার সমিতির অভিযোগপত্র থেকে অফিস সহায়ক আমিনুল হকের দুর্নীতির ফিরিস্তি ও অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আমিনুল সম্প্রতি নগরীর রায়পাড়ায় ৬০ লাখ টাকা দিয়ে তিন কাঠা জমি এবং কাশিয়াডাঙ্গা থানার কাছে ৮০ লাখ টাকা দিয়ে তিন কাঠা জমি কিনেছেন। এ ছাড়া ডাঙ্গেরহাটে কোটি টাকা দিয়ে তিনি ১০ বিঘা ফসলি জমি কিনেছেন। সম্প্রতি ১৫ লাখ টাকা দিয়ে তিনি নতুন মডেলের গাড়ি কিনেছেন। তার বাড়িতে আড়াই লাখ টাকা দামের চারটি এসি রয়েছে। তার বাড়িতে প্রায় চার লাখ টাকা দামের বিদেশি চার সেট সোফা রয়েছে। নগরীর কাদিরগঞ্জ মহল্লায় ৫০ লাখ টাকা দিয়ে দুইতলা বাড়ি কিনে মেয়েকে দিয়েছেন আমিনুল। এ ছাড়া তার স্ত্রী রিনা হকের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে লাখ লাখ টাকা জমা রেখেছেন। পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ জমিও কিনেছেন।
অভিযোগের ব্যাপারে পবা উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস সহায়ক আমিনুল হক বলেন, আমি পবা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে নেই। আমাকে গোদাগাড়ীতে বদলি করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, তার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ নেই।
নিউজটি যুগান্তর পত্রিকায় ২৬ মে ২০২২ তারিখে প্রকাশিত হয়