প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে এভাবে দিনের পর দিন নির্মাণ সামগ্রী রাখা হয়, মেশিনে ইট ভাঙাও হয় স্কুল চলাকালীন সময়ে!

Kachua

স্কুলের সামনে নির্মাণ সামগ্রী রেখে ঠিকাদারী করার এ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের নজরে এসেছে একটি দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তিনি তখন ঐ পথ ধরে ভিন্ন কাজে যাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনার বিষয়টি দেখতে গিয়েই মূলত দৃশ্যমান হয় নির্মাণ সামগ্রী রাখার এবং স্কুলের সামনে ইটভাঙার মতো মারাত্মক বিষয়টি।


স্কুলটির নাম গোপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলটি অবস্থিত বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে। স্কুলটি অবস্থিত বাধাল-গোপালপুর-কচুয়া রাস্তা ঘেষে। রাস্তাটি এখন যথেষ্ট ব্যস্ত,  ফলে স্কুলের বাচ্চারা ছোটোখাটো দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে প্রায়ই, এমনটিই জানালেন স্কুলের দুজন সহকারি শিক্ষক। এই প্রতিবেদনটি তৈরির প্রেক্ষিত তৈরি হয়েছে গত ১৮ মার্চ একটি অপেক্ষাকৃত বড় দুর্ঘটনা ঘটার সময় পত্রিকা সংশ্লিষ্ট একজন প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায়।

দুর্ঘটনা যে মটর সাইকেলটিতে হয়, শুনুন সে চালকের কথা:

এই দুই ইউনিয়নের (বাধাল এবং গোপালপুর) মানুষের যেমন উপজেলায় যাওয়ার রাস্তা এটি, পাশাপাশি গোপালপুর ইউনিয়ন পুরোটাই এই রাস্তাটি ঘেষে, এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত রয়েছে পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষের। অধিকন্তু বাধাল বাজারে বৃহস্পতি এবং রবি বার বড় হাট বসায় ব্যস্ততা অনেক বেড়ে যায়। ফলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটাটা শুধু সময়ের ব্যাপার বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।

এছাড়া এলাকায়, স্কুল শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে বিষয়টি বিস্ময় এবং ভীতির জন্ম দিয়েছে সেটি হচ্ছে স্কুলের সামনে এলাকার উন্নয়ন কাজের নির্মাণ সামগ্রী রাখার জায়গা করায়। স্কুলটির দুজন সহকারি শিক্ষক এবং কয়েকজন শিক্ষার্থী জানালেন, এমনকি স্কুল চলাকালীন সময়ে মেশিন দিয়ে ইট ভাঙাও হয়। কিছুদিন আগে এই স্কুল চত্বরেই চুলা বসিয়ে পিজ গলানো হতো নাকি!

“এভাবে নির্মাণ সামগ্রী রাখা এবং স্কুলের সামনে মেশিন চালিয়ে ইট ভাঙা” বিষয়ে কথা বলেছি গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস, এম, আবু বক্কর সিদ্দিক ‘র সাথে। তিনি বললেন, নির্মাণ সামগ্রী রাখার মতো কোনো জায়গা না পাওয়া যাওয়ায় এখানে হয়ত রাখা হয়েছে। তিনি এলাকার উন্নয়নের জন্য বিষয়টি সহনীয় বলে মনে করেন। গত ১৮ মার্চ সকালে স্কুলের সামনে মটর সাইকেলের সামনে পড়ে স্কুলটির চতুর্থ শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর মারাত্মক আহত হওয়ার খবরটি তিনি জানেন না বলে জানিয়েছেন।  

প্রধান শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে স্কুলের দুজন সহকারি শিক্ষক জানালেন যে তারা অভিযোগ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি। কচুয়া উপজেলার বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে তিনি কোনো অভিযোগ পাননি। হয়ত অভিযোগটি এর পূর্বে যিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন তার কাছে দেওয়া হয়েছিল। এর অর্থ দীর্ঘদিন ধরে স্কুলটি এই ভোগান্তিতে আছে। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা আরও জানিয়েছেন, স্কুলটিতে পড়াশুনার কোনো পরিবেশ দীর্ঘদিন ধরেই নেই।   

আমরা এ বিষয়ে কথা বলেছি কচুয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাসমিন ফারহানা ‘র সাথে। তিনি বললেন, “বিষয়টি তিনি জানতেন না, এখন জেনেছেন, খতিয়ে দেখবেন।”

“প্রতিবাদ কেন করেন না” এলাকাবাসীর কাছে জানতে চাইলে এলাকার কয়েকজন জানালেন, “প্রভাবশালীদের ভয়ে তারা প্রতিবাদ করতে পারেন না। এলাকার সাধারণ মানুষ মনে করেন, যে বা যিনি এখানে মালামাল রেখেছেন, বা এভাবে যারা বিবেচনাহীনভাবে কাজ করেন, স্বার্থ হাসিল করেন, তারা সকল প্রতিবাদ প্রতিরোধের উর্ধ্বে চলে গিয়েছে।”

যদিও এ বিষয়ে (প্রতিবাদহিনতার সংস্কৃতি) জানতে চাইলে মানবিধিকারকর্মী খুশি কবির বললেন, ‍”বিষয়গুলো মোটেও প্রতিবাদ প্রতিরোধের উর্ধ্বে নয়, কিন্তু বিভিন্ন সময়ে সমাজের অবৈধভাবে প্রভাবশালী হওয়া শ্রেণি সাধারণ মানুষকে নাজেহাল করায়, কাউকে কাউকে আঘাত করে উদাহরণ সৃষ্টি করায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন একটা ধারণা হয়েছে যে এগুলো করে তারা (ঐ শ্রেণি) পার পেয়ে যাবেই, কারণ, তারা মনে করে যাদের কাছে গিয়ে বিচার পাওয়ার কথা কোনো না কোনোভাবে তারা এদের দ্বারা ‌ম্যানেজড্’ হয়ে যায়। ফলে এমন একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।”

‍”নির্মাণ সামগ্রী রাখার সেরকম আর কোনো জায়গা নেই” -গোপালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের এরকম বক্তব্যে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। 

আমরা প্রতিনিধি পাঠিয়ে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি—আদৌ নির্মাণ সামগ্রী রাখার মতো সেরকম কোনো জায়গা একটু দূরে হলেও আছে কিনা। জানা গেছে, নির্মাণ সামগ্রী রাখার মতো জায়গা কাছে দূরে আছে। তবে স্কুলের এ জায়গাটি একেবারেই রাস্তার সাথে এবং রাস্তার সমান্তরালে হওয়ায় খরচ বাঁচাতে এটি ব্যবহার করা হতে পারে বলে জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি গুরুত্বপূর্ণ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মালিক।

স্কুলের সামনে এভাবে নির্মাণ সামগ্রী রাখা, মেশিনে ইট ভাঙা, পিচ গলানো ইত্যাদির স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল কচুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সর চিকিতসক ডা: বেলফার হেসেন ‘র কাছে। তিনি জানিয়েছেন, ‍”শব্দ দূষণ তো মারাত্মক হচ্ছে, যেটি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে এত বেশি যাতে শিশুদের শ্রবণশক্তি বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি মানসিকভাবেও তারা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তাছাড়া এভাবে নির্মাণ সামগ্রী রাখা, ইট ভাঙা এবং পিচ গলানোর ফলে যে বায়ু দূষণ তৈরি হচ্ছে তাতে শিশুদের শ্বাস কষ্ট সহ নানাবিধ জটিলতা হতে পারে। বিষয়টি শিক্ষকদের জন্যও একইভাবে ক্ষতিকর।”  

স্কুলটির শিক্ষক এবং এলাকাবাসীর বক্তব্যের ভিডিও:

প্রত্যেকটি মুখের ভাষা খুবই স্পষ্ট, তারা শুধু সঠিক নেতৃত্বের অপেক্ষায়। ভেঙে দিতে প্রস্তুত প্রতিটি দুবৃত্তের আস্তানা।