কাদের, তুই কাদের ? আওয়ামী লীগের না বি.এন.পি.-এর? যাদেরই হবি হ, তবে জামায়াতী ইসলাম হোস না। আমার মতো মানুষদেরও হোস না। আমরা গোলমরিচের দামে জীবন পরিমাপ করি। তবে তুই কাদের যাদেরই হোস না কেন তোর জীবনের দাম আমার মতো এত কম না।
নে, এই ব্যাগটা খোল।
কাদের ব্যাগটা হাতে তুলে নেয়। চেন আটকানো বিশাল একটা ব্যাগ, খোলার আগে সে ওজনটা দেখে নেয়। ব্যাগ যত বড় ওজন তেমন নেই। শফিক সাহেবকে সে বারো বছর ধরে চেনে, তার কোনো কথায় বা কাজে কাদের এখন আর বিস্মিত হয় না, ভয়ও তেমন পায় না।
– তোরে ব্যাগটা খুলতে কইছি, মাপতে কই নাই। খোল।
কাদের যতটা সম্ভব সময় নিয়ে আস্তে আস্তে ব্যাগটা খোলে। ব্যাগের মধ্যে যা আছে তা দেখে একজন দারোয়ানের চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবার কথা, কিন্তু কাদের সেরকম দারোয়ান নয়। সে এসব অনেকদিন ধরেই দেখছে। ব্যাগের মধ্যে একগাদা পাঁচশ টাকার নোট।
শফিক সাহেব : এইগুলো কী?
কাদের : টাকা।
শফিক সাহেব : ভালো করে দেখ ক … ও।
কাদের : এইগুলো তো টাকা, সব পাঁচশ টাকার নোট।
শফিক সাহেব : এগুলো টাকা না, এগুলো হচ্ছে কাগজ। এই কাগজগুলোর কোন বাপ-মা নেই। এগুলো সব জারজ সন্তান। যা তুই এই ব্যাগটা নিয়ে যা।
কাদের আর কথা বাড়ায় না। ব্যাগটা নিয়ে আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসে। শফিক সাহেব লাইসেন্স করা পিস্তলটা টেবিলের উপর লাটিমের মতো ঘুরাতে থাকে। জোরে চিৎকার দেয়, কার বাপের কত টাকা আছে? সাহস থাকলে আমার কাছে আয়।
আমি শফিক দিনে পাঁচ হাজার টাকার মাল খাই, তাই বলে কোনো মাগির কাছে যাই না। ইচ্ছা থাকলেও যাই না। এই ঢাকা শহরের কোনো শালা হোটেল ম্যানেজার এই কথা কইতে পারবে না।
শফিক বেইমানি করে না। তোরা আমার বউয়ের কাছে শুনে দেখিস, শফিকের শরীর থেকে কোনোদিন কোনো বেশ্যার গন্ধ পাইছে নাকি? মাল খাই এই একটাই আমার অপরাধ। তোরা যারা ভদ্রলোক তোদের আমি চিনি। তোরা মাল খাস না, তোরা মালের ব্যবসা করিস। তোরা বেশ্যা পাড়ায় যাস না, তোরা বেশ্যা পাড়া বানাস।
এই মাতাল শফিক জীবনে বহুত মানুষের উপকার করছে। কী লাভ হইছে তাতে? কোনো লাভ হয় নাই। তোরা যারা ভদ্র, তোরা যারা মদ খাস না; তোদের জন্য এক একজন শফিক দিনরাত মদ গেলে। তোদের ফেরেব্বাজিতে সব মানুষ আজ মরতে বসেছে। তোরা শালারা যে যার ইচ্ছামতো টাকা কামাস। তোরা সব ফকিরের দল। তোরা সব নেড়ি কুত্তা। লোভে তোদের লেজ নড়ে সারাক্ষণ।
[ চিৎকার করে নাজনীনকে ডাকে ]
– তোর বাপের কত টাকা?
– আমার বাপের টাকা নেই।
– মাগি, তোর বাপের টাকা না থাকলে কি শেখ হাসিনার বাপের টাকা থাকবো!
– ঐ শালা এলাকায় মসজিদ-মাদ্রাসা বানানোর টাকা পায় কোত্থেকে?
– আমার বাপ তোমার শালা হয় না, শশুর হয়।
– তোর বাপ আমার শালা হয়, আপন শালা। ঐ শালার গার্মেন্টেসে কতজন শ্রমিক কাজ করে?
– জানি না, আমি তার ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখি না।
– আমার কোটি কোটি টাকা আছে দেখে আমার মতো অপদার্থ ছেলের সাথে তোর বাপ তোরে আমার সাথে বিয়ের দিছিল। তোর বাপ তো একটা লোভী কুত্তা। মানিস?
– আমার পিতা সম্পর্কে তুমি এভাবে কথা বলো না।
– তোর বাপ গার্মেন্টস শ্রমিকদের রক্ত চুষে খায়, খায় না? ওদের দিয়ে কত টাকার কাজ করায় আর কত টাকা বেতন দেয় তার হিসেব জানিস? তোর বাপ তো একটা দালাল।
– আমি এসব বুঝি না।
– মাগি, তুমি আমি বেশি মদ খাই, মাতাল হই —সেসব বোঝো ,আর তোমার সুস্থ বাপে মাসে কত টাকার শ্রম হজম করে তা জানো না। তুই না এম এ পাশ? খাইদাই, সাজগোজ তো ভালো বোঝো, দুনিয়ার মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে তা নিয়ে তোমাদের কোনো বিকার নেই। তোরা সব বেশ্যা মাগি।
– কী বললে??
– আরে ব্যাটাগো সাথে শুইলে বেশ্যা, না শুইলে বেশ্যা না —এ থিওরি আমি মানি না। যা, তুই আমার মতো অপদার্থের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটা সলিড পুরুষ মাুনষের কাছে যা। একেবারে যেতে না পারিস একটা প্রেম কর, তাতে আমি তোরে বেশ্যা কয়ে গালি দিবো না। কিন্তু তোরা যাদের পরিশ্রমের ওপর ভর করে খাস তাদের থবর রাখিস না —এর নাম হলো আসল বেশ্যাবৃত্তি। তুই পতিতা, তোর বাপ পতিতা, তোর চৌদ্দ পুরুষ পতিতা। তুই মানে তোর মতো সবাই।
– তুমি খুব বাজে কথা বলছো।
[ শফিক সাহেব হঠাৎ রেগে গিয়ে বউকে মারতে শুরু করে, ঘর থেকে বের করে দেয় ]
নাজনীন নীচে নেমে এসে দারোয়ানকে গেট খুলে দিতে বলে। দারোয়ান গেট খুলে দেয় না। নিচ তলায় দারোয়ানের থাকার জন্য একটা রুম আছে। দারোয়ান তাকে এত রাতে বাইরে না যাবার জন্য অনুরোধ করে।
কাদের : ভাবি, কিছু মনে না করলে আমার রুমে রাতটুকু পার করেন। ভাইজানের নেশা কাটলে সব ঠিক হয়ে যাইবো।
নাজনীন একটু দোনোমনা ভাব দেখিয়ে রাজি হয়ে যায়। সে আসলে এটিই চাচ্ছিলো। স্বামী যে দারোয়ানের কাছে এক ব্যাগ টাকা দিয়ে দিছে এটা তার মনে আছে। এখনই অবশ্য কাদেরকে টাকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন সে করেনি। টাকার ব্যাগ না থাকলে সম্ভবত সে দারোয়ানের রুমে ঘুমাতে রাজি হত না।
নাজনীন : কাদের, তুমি চেয়ারে বসে থাকো। তোমার ভাইজান নামলে বলবা, ভাবি চলে গেছে।
কাদের : ঠিক আছে। যদি বলে, আমি ঘুমাই নাই কেন।
নাজনীন : বলবা, ভাবি আজকে ঘুমাতে না করছে।
কাদের : ভাবি, আমার ব্যাগে একটা নতুন চাদর আছে, বিছায়ে দিই?
নাজনীন চাদরটা বুঝে নিয়ে দরজা আটকায়ে দেয়। ছোট্ট একটা রুম। একটা চৌকি রেখেই রুমে আর জায়গা নেই। সে টাকার ব্যাগটা খুঁজতে থাকে। খাটের পাশ দিয়ে হাত দিতেই টের পায়। আশ্বস্ত হয়। দারোয়ান কেন তাকে এতক্ষণ টাকার কথা কিছু বলে নাই —এটা নিয়ে সে চিন্তা করছে। ও কি তাহলে ব্যাগটা নিয়ে নিতে চায়? এই দারোয়ানগুলোর ওপর কোনো বিশ্বাস নেই। কালকে ওকে চোখে চোখে রেখে ব্যাগটা আগে উদ্ধার করতে হবে। তিন-চার ঘন্টা রাত না ঘুমিয়েই কেটে যায়।
এদিকে সকাল না হতেই শফিক সাহেব ‘কাদের কাদের’ বলে চিৎকার শুরু করে দিয়েছে।
শফিক : কাদের, রাতে তোর ভাবি কোথায় গেছে জানিস?
কাদের : ভাবীতো রাতে আমারে গেট খুলে দিতে বললো, তারপর তো কোথায় যেন চলে গেলো।
শফিক সাহেব : গাড়ি তো নেয়নি।
কাদের : না, গাড়ি নেয়নি।
শফিক সাহেব আর কথা না বাড়িয়ে হন হন করে উপরে উঠে যায়।
সদ্য আমদারি করা আরেক বোতল স্কচের মুখ খুলে চুমুক দিতে দিতে আস্তে আস্তে ব্যালকনির দিকে যায়।
লাইসেন্স করা দুটি পিস্তলের একটি বেশির ভাগ সময় তার হাতেই থাকে।
ব্যালকনিতে পায়চারি করতে করতে নিচে তাকিয়ে গরুগুলো দেখতে পায়। বাসার পাশে বস্তি ঘেষে একটু ফাঁকা জায়গা, ঐ জায়গাটুকু শফিক সাহেবেরই। ঐ জায়গায় সোলায়মান পাঁচ বছর ধরে চার-পাঁচটা গরু পালে। আশেপাশের ফ্লাটগুলোতে সোলায়মান নিজেই দুধ বেঁচে। ঐ দিয়েই তার সংসার চলে। ফ্লাটের বাসিন্দারাও ভালো দুধ পায়। শফিক সাহেব নিচে তাকিয়ে সাত পাঁচ ভাবতে থাকে। সোলায়মান সকালে গরুর জন্য খাবার তৈরি করছিলো। চালের কুড়ায় চিটাগুড় মিশাচ্ছিলো। শফিক সাহেব চোখ বড় বড় করে একবার গরুগুলোকে দেখে একবার সোলায়মানকে দেখে। কেন জানি মনে হয় গরুগুলো তাকে দেখে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। তার মনে হয় সোলামানও বোধ হয় নিচের দিকে চেয়ে মুচকি হাসছে। শফিক ফিসফিসানি শুনতে পায়। “শফিক, এতটাকা দিয়েও তুমি সুখ পাইলে না? সবই আছে তবু তুমি সুখের কাঙ্গাল। শফিক, তোমার জন্য আমার দুঃখ হয়।” ফিসফিসানি বন্ধ হয় না। শফিক সাহেব চিৎকার করে কাদেরকে ডাক দেয়।
শফিক : কাদের, তুই শালা কাদের? তুই ঐ নিচের সোলায়মানের, না আমার?
কাদের : আমি আপনার।
শফিক : তুই আমার তা ঐ সোলায়মানের সাথে গিয়ে কী পরামর্শ করিস?
[কাদেরের গালে আচমকা কষে এক চড় বসায়ে দেয়]
কাদের : স্যার, আমি তো সোলায়মানরে দুই চোখে দেখবার পারিনে, আমি ওর কাছে পরামর্শ করতে যাবো ক্যান?
শফিক : ওর খুব সাহস বেড়েছে। শালা ফকিরের বাচ্চা, আমি তোকে জায়গা দিয়েছিলাম, আমিই তোকে গরু পোষার পরামর্শ দিয়েছিলাম। এখন তুই আমার সুখের হিসেব নিচ্ছিস। এই শালা কাদের, তুই নিচে যা তো।
[ শফিক সাহেব তড়িৎ গতিতে পিস্তলটা হাতে তুলে নিয়ে উপর থেকে ঠাস ঠাস গুলি করে তিনটা গরু মেরে ফেলে ]
কাদের নিচে নেমেই দেখে তিনটা গরু চিৎপটাং। সোলায়মান চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। সে বুঝতে পারে না মুহূর্তের মধ্যে কীভাবে এ কাণ্ড হলো। এত সকালে গুলির শব্দে ঢাকা শহরের খুব কম লোকেরই ঘুম ভাঙ্গে। শব্দ শুনলেও শহরের মানুষ খুব একটা আমলে নেয় না। হবে কিছু একটা বলে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। সোলায়মানের চিৎকারে কেউই এগিয়ে আসে না। কাদের গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেয়।
কাদের : দশ বছর ধরে আমি তাকে চিনি। তুমি কোনো চিন্তা করো না, দেখবা সে তোমার গরুর দাম ঠিকই দিয়ে দিবো।
সোলায়মান পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারে না। আহত গরুগুলোকে সে জবাই করার ব্যবস্থা করে। একটা ইতোমধ্যেই স্বর্গ নরকের মাঝামাঝি কোথাও গিয়ে হাজির হয়েছে। গরুর পাপ-পূণ্যের জন্য পরকালের ঠিক কোনো জায়গা বরাদ্দ তা অবশ্য সোলায়মানের জানা নেই। এই মুহূর্তে তা নিয়ে তার কোনো ভাবনাও নেই। মৃত গরু তিনটা তাড়াতাড়ি কাজে লাগাতে হবে। গুলি খেয়ে মরেছে। মাংসের দোকানে চালায়ে দেওয়া যাবে। সোলায়মান আগে মরা গরুটারে জবাই করে পাপমুক্ত হয়, তারপর বাকি দুইটা। কাদের তাকে এতক্ষণ বুঝিয়েছে যাতে সে থানা-পুলিশ না করে, আবার পাড়া প্রতিবেশীকেও যেন না জানায়। বস্তির লোকরে একটা কিছু বুঝ দেওয়া যাবে।
কাদের : অর্ধেক দামে মাংস ছাইড়া দাও। অর্ধেক দামে মাংস পাইলে ওরা আর অতকিছু খোঁজ নিতে আইবো না। মাংস হজম করে তারপরে ওরা খোঁজ লইতে চাইবো, হের মধ্যে একটা কিছু ব্যবস্থা হইবো।
তাছাড়া শফিক সাহেবরে তারা জানে। ব্যাটা মাতাল তাতো এই পাড়ার সবাই জানে। অত চিন্তা কইরো না, তোমার কাম তুমি করো, বাদ বাকি আমি দ্যাখতাছি। সোলায়মান এবার আশ্বস্ত হয়।
নাজনীন কাদেরের কাছ থেকে বিস্তারিত শুনে চিন্তায় পড়ে যায়। উপরে যেতে সাহস হচ্ছে না, কাদেরের কাছে টাকার কথা জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা লাগছে। দোনামনা করে নাজনীন শেষ পর্যন্ত উপরে উঠে যায়। শারীরিক শক্তি কম হলেও প্রাণশক্তি পুরুষের থেকে নারীর কম নয়। মাতাল শফিক তিনটা গরু গুলি করে মেরে ফেলেছে —এ খবরে প্রতিবেশী ঘাবড়ালেও নাজনীন নির্লিপ্তভাবে উপরে গিয়ে ঘরের কাজ করতে শুরু করে দেয়। আচমকা একটা কাণ্ড ঘটিয়ে শফিক সাহেবও খানিকটা দমে গিয়েছে। নাজনীন ভেবেছিলো যাবার সাথে সাথে শফিক তাকে ধমকাবে। সেসব কিছুই হলো না, বরং শফিককেও খানিকটা উদাসীন মনে হরো। জানালা থেকে সে বাইরে তাকিয়ে আছে। বিশাল বিশাল তিনটা গরু ছটফট করতে করতে তার চোখের সামনে মরে গেলো! সে নিজেই গরু তিনটি গুলি করে মেরেছে! নেশার ঘোর কাটতেই তার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছে। শফিক সাহেব ডামাডোল করে পাঠা-গরু জবাই করার ঘোর বিরোধী। প্রয়োজনে মানুষ প্রাণী হত্যা করে খায় —এটা মানাই কষ্টকর তার উপর হল্লা করে হত্যা করা, কোনোভাবেই বিষয়টা সে মানতে পারে না। নেশার ঘোরে আজকে সে তিনটা গরু গুলি করে মেরেছে —বিষয়টা তার চরিত্রবিরোধী। পিস্তল দুইটা সে পৈতৃক সূত্রে পেয়েছে। নেশার ঘোরে আজকাল কী করতে কী করে বসে সে নিজেই জানে না। শফিক সাহেব কিছুতেই আর নিজের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না।
[ নাজনীন কে ডাকে ]
শফিক : নাজনীন, তুমি আমার সাথে এখনো কেন আছো বলতো? আমার কাছ থেকে আর কী কিছু তোমার পাবার আছে? তুমি তোমার পিতার কাছে চলে যাও। ছেলেটাও আমাদের ছেড়ে থাকে, ওকে মানুষ করো গিয়ে। মাতাল স্বামীর সাথে থেকে থেকে তুমিও পাগল হয়ে যাবা।
এরকম কথা নাজনীন এর আগেও দু’একবার শুনেছে, শফিক সাহেব নরম হয়ে কিছু বললে নাজনীনের ভালো লাগে না। সে স্বামীর এরকম ব্যবহারে অনভ্যস্থ। বিয়ের পরপর স্বামীকে পেয়েছে প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্নন একজন মানুষ হিসেবে। আস্তে আস্তে দরদী দাপুটে সেই মানুষটা জীবনের যা কিছু আয়োজন সবকিছু বিসর্জন দিয়ে মদের বোতল আঁকড়ে ধরলো। শফিকের বদলে যাওয়াটা নাজনীনের কাছে আজীবন একটা রহস্য হয়েই থাকবে। কিছু একটা ঘটে যেতে পারে ভেবে ছেলেটাকে সে বছর খানিক আগে তার নানীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। নাজনীন কখনই তার পিতা মাতাকে সবকিছু খুলে বলেনি। শফিকের এই অবস্থা প্রায় তিন বছর হলো। একাই সামলাচ্ছে, একাই সইছে।
নেশা কেটে গেলে শফিক সাধারণত ভারী নাস্তা করে। মাংস কষিয়ে দ্রুত চার পাঁচটা পরোটা ভেজে নিয়ে নাজনীন শফিকের সামনে রেখে এসে কাঁদতে বসলো। কিছুক্ষণ চোখের পানি ঝরিয়ে সেও নাস্তা করে নেয়। এভাবেই দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে। রোজকার মতো আজকে আর শফিক খেতে পারছে না। অনেক কষ্টে দু’টো পরোটা সে শেষ করতে পারলো। হাত ধুইয়ে জানালাটা বন্ধ করে দেয়। জানালা থেকে বাইরে তাকালেই গরু তিনটার ছটফট করার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সকালের নাস্তার পরে সাধারণত সে টিভি দেখতে বসে। রিমোটটা হাতে নিয়ে আবার রেখে দিলো। নরম সূরে নাজনীনকে ডাকে।
– ছেলেটাকে আজকে আসতে বলো না? সবাই দুপুরে একসাথে খাই। ও আসে না কত দিন বলোতো?
– ও তো আসতে চায় না। দেখি ফোন করে।
[ রাকিব পুরনো ঢাকায় তার নানা-নানীর কাছে থাকে। নাজনীন প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা ছেলেকে ফোন করে না। ছেলেরও তাতে তেমন কোনো অভিমান নেই। আজকে হঠাৎ মায়ের ফোন পেয়ে তার ভালো লাগে। সে আসতে রাজি হয়। দুপুরের মধ্যে ছেলে এসে পড়বে। ]
– ও কি আসবে? কী বলল?
– দুপুরে আসছে।
– তোমরা কী খেতে চাও বলতো? অনেকদিন বাজারে যাওয়া হয় না। ভাবছি আজকে বাজার করে আনি। কাদেরকে দুপুরে আমাদের সাথে খেতে বলো। সোলায়মানকেও দাওয়াত দিও। আচ্ছা, সোলায়মানকে না হয় কাদেরকে দিয়েই বলাবো। তুমি বরং রান্নার গোছগাছটা করে ফেলো।
– স্বামীর হঠাৎ এরকম ব্যবহারে নাজনীনের ভালো লাগছে। যাবার সময় কাদেরকে বলে যায়— কোনোকিছুই যেন তার ছেলে জানতে না পারে।
দুই তিনটা বাজার ঘুরেও একটা চিতল মাছ মিলাতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত কাপ্তান বাজারে গিয়ে থলথলে পেটের একটা চিতল পেয়েছে। দরদাম না করেই কিনে নেয়। কিচু গলদা চিংড়িও কেনে। মাংস বাসায় আছে। টুকটাক সব বাজার সেরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে বাসায় ফেরে।
এদিকে হঠাৎ আনন্দে নাজনীন মুহূর্তের মধ্যে যতটা সম্ভব রান্নার আয়োজন সব সেরে রেখেছে। রান্নায় তার হাত আছে। বিয়ের পে দুই বছর শশুর বেঁচে ছিলো। খাঁটি মানুষ ছিলো সে। ছেলের বউয়ের রান্নার প্রশংসা করতে করতে খাওয়া শেষ করতে তার দ্বিগুণ সময় লাগতো। হাসপাতালে থাকতে নাজনীন তাকে খাবার পাঠাতো। খেতে না পারলেও ছেলের বউয়ের রান্না জোর করে সে কিছুটা খেত। শশুর মারা যাবার পর অনেকদিন আয়োজন করে রান্না করা হয় না। ঠিক কতদিন আগে শফিক তাকে জানিয়ে এভাবে বাজারে গিয়েছে তা প্রায় সে ভুলতে বসেছে।
শফিক বাজার রেখে গোসল সেরে নেয়। ছেলে তাকে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। বোঝার পর থেকে পিতাকে সে এভাবেই দেখে আসছে। পিতাকে সে শ্রদ্ধাও করে না অশ্রদ্ধাও করে না, তবে ভালোবাসে বলে সম্ভবত দূরে দূরে থাকে। ছেলেকে ডেকে আগে থেকেই শফিক সাহেব আজ একসাথে খাওয়ার কথা বলে রাখে। রাকিব মাথা নেড়ে সায় দেয়।
কাদের এবং সোলায়মানও এসেছে। কাদের আগে থেকেই সোলায়মানকে বুঝিয়ে রেখেছে যাতে সে সকালের ঘটনা নিয়ে ভালো-মন্দ কোনো কথা না তোলে। নাজনীন কাদের এবং সোলায়মানকে খেতে দেয়। ওদের খাওয়া শেষ হলে তারা আজ একসাথে খাবে।
রাকিব বড় হবার পর এমন দিন আগে আর আসেনি। নাজনীন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। অজানা কোনো বিপদের আশঙ্কায় তার বুকের মধ্যে মোচড় দেয়। তিনজনে মুখোমুখি খেতে বসেছে। প্রায় অর্ধেক খাওয়া শেষ হয়েছে। অথচ কারো মুখে এতক্ষণ কোনো কথা নেই। নাজনীন মাঝে মাঝে আঁচল টেনে চোখ মুচছে। শফিক সাহেবও নিজেকে সামলাতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত রাকিব তার মাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলে। এতদিন পরে কেউই খুব বেশি সহজ হতে পারলো না। শফিক সাহেব খাওয়া শেষ করতে করতে বললো, নাজনীন, তোমাদের এতদিন আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি। কথাটা স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেও মনে হলো আজ সে তার সন্তানের কাছে কৈফিয়ত দিচ্ছে। সে কি তাহলে কথাটা বলার জন্যই এতদিন পরে তার ছেলেকে ডেকে এনেছে? নাজনীন ভাবতে থাকে। রাকিব সবার আগে উঠে যায়। শফিকও উঠে পড়ে। টিভিতে ভারত-পাকিস্তান খেলা চলছে। পাকিস্তান আগে ব্যাট করছে। আমির সোহেল এবং সাঈদ আনোয়ার যেভাবে আজ ব্যাট চালাচ্ছে তাতে রান যে আজ কোথায় গিয়ে ঠেকে বলা কঠিন। কাউকে উদ্দেশ্য না করেই শফিক আস্থার সাথে বলে ওঠে, আজকে ভারত জিতবে। সে কখনই পাকিস্তানের সমর্থন করে না। তবে পাকিস্তানের অনেক খেলোয়ারের খেলা সে পছন্দ করে। ওয়াসিম আকরামের সে অন্ধভক্ত। তাই বলে সে পাকিস্তানের সমর্থন করতে পারে না। ২৫ মার্চ, ১৪ ডিসেম্বরের মতো তারিখগুলো তার বুকের মধ্যে শেলের মতো বিঁধে। সব ভুলে পাকিস্তানের সমর্থন করার মতো এতটা অন্ধ সে হতে পারে না। তাছাড়া অপরাধের জন্য পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চায়নি। তারা ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত তাদের ক্ষমা নেই। তাছাড়া প্রতিবেশী দেশের সমর্থন না করে, খেলার কথা বলে কূটচালে হন্তারক দেশের সমর্থন করার মধ্যে বিন্দুমাত্র যুক্তি সে খুঁজে পায় না। শফিক সাহেব হঠাৎ লাফ দিয়ে ওঠে। কী যেন ভুলে গিয়েছিল সে।
[ কাদেরকে ডাক দেয় ]
– কাদের, টাকার ব্যাগটা কী করেছিস?
– স্যার, ঐভাবেই আমার রুমে রয়েছে।
– ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বল। টাকার ব্যাগটা নিয়ে তুই আমার সাথে চল।
গাবতলী গরুর হাটে গিয়ে বিশাল বিশাল চারটা গরু কিনে ট্রাকে তোলে। গরুগুলো সোলায়মানকে দেবার জন্য কাদেরকে বলে রাখে। ব্যাগের বাড়তি টাকাগুলো কাদেরকে নিতে বলে। কাদের কোনো প্রশ্ন করতে সাহস পায় না। কাদের গরুগুলো নিয়ে চলে আসে।
অনেকদিন পরে শফিক সাহেব আজ নিজে গাড়ি চালাচ্ছেন। গাড়ি চালানোর পাকা হাত তার। কাঁচপুর ব্রিজ পেরিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিয়ে রেকর্ড প্লেয়ার চালিয়ে দেয়। পিছনের কোনো কিছুই সে আর মনে করতে চাইছে না। শূন্য, সব শূন্য, কিছুই সে দেখছে না, কিছুই সে শুনছে না। রেকর্ড প্লেয়ার বাজছে, সে কিছুই শুনছে না। হঠাৎ একটা গান তার মনে ধরে, ঐটাই সারাপথ টেনে টেনে শুনতে থাকে।
সাগরটাও যেন আজ নিশ্চুপ। ছোট ছোট ঢেউ, আশাহত চাঁদের বিষন্ন আলোয় চিক চিক করছে।
শফিক সাহেবের মধ্যে কেনো চঞ্চলতা নেই। পিছনের কিছুই যেন সে আর দেখতে পারছে না। সবার সাথে সব দেনাপাওনা মিটে গিয়েছে।
একাকী গাড়িতে গানটা বেজেই চলেছে। “… আজ সাগরের ঢেউ দিয়ে তাই যেন মুছিয়া গেলাম।”
জুন ২০১০, ভূতেরগলি, ঢাকা