মা, খালা ও বান্ধবীদের নিয়ে চাঁদনি চক মার্কেটে গিয়েছিলেন ইডেন শিক্ষার্থী রিনা (ছদ্মনাম)। ভীড়ের মধ্যে হঠাৎ একে অপরের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
বলাকা সিনেমা হলের কোনায় একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন মা। দোকানের নাম শাহনুর ফেব্রিকস। ফোনে নিজের অবস্থান মেয়েকে কথা জানিয়ে দেন দ্রুত। মিনিট খানেকের মধ্যেই মেয়ে হাজির।
কিন্তু এতেই তেতে ওঠে দোকানের কর্মচারি নজরুল। বয়স্ক ওই নারীকে পারলে ঠেলে ফেলে দেয়। অভিযোগ, দোকানে নাকি খদ্দের প্রবেশ করতে পারছে না!
দুই দিকেই খোলা দোকানটিতে তখন কোনো খদ্দের ছিল না। এমন আচরণে বিস্ময় প্রকাশ করেন ওই নারী। সঙ্গে যোগ দেন মেয়ে রিনা। দোকানেই বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাকি দুই বন্ধবী। মা-মেয়ে মিলে দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ করলে আরো ক্ষেপে ওঠে নজরুল। সঙ্গে যোগ দেয় বাকী কর্মচারীরাও। হৈ-হট্টগোল বাড়তে থাকে।
এ এলাকায় যা হয় আরকি, অসহায় মেয়েদের পেয়ে একজোট হয়ে যায় কর্মচারীরা। চারদিক থেকে ঘিরে ধরে। বাদ যায় না কাছেই দাঁড়ানো দুই বান্ধবীও। মেয়ে মানুষ চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে যাবে, কেন প্রতিবাদ করল- এই নিয়ে তর্ক বেঁধে যায়।
এক পর্যায়ে শুরু হয় খিস্তিখেউর। মেয়েটি নিজের পরিচয় দিয়ে মুখ সামলে কথা বলতে বললে, নজরুল বলে, ‘তোকে এখন এখানে দাঁড়ায়া……..! (ভাষায় প্রকাশ যোগ্য নয়) । দেখি তোরে কোন বাবায় বাঁচায়।’
হতভম্ভ হয়ে যায় মেয়েটি। সত্যিই কেউ আসেনি। ২০-২৫ জন আশপাশের কর্মচারী যাও জড়ো হয়েছে, তা সহযোগতিতা করতে নয়, সুযোগে নারী শরীর স্পর্শের ধান্দায়।
অবস্থা বেগতিক দেখে এগিয়ে আসে মেয়েটির বান্ধবী লিনা (ছদ্মনাম)। সাহস করে নজরুলকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। বলে, ‘মেয়েদের পেলেই মুখ খারাপ শুরু হয়ে যায় না? আমরা কি পন্য নাকি?’
আর যাবে কোথায়, সকল সীমা লঙ্ঘন করে মেয়েটির বুকের কাছে জামা খামচে ধরে নজরুল। বলে, ‘দেখি তোর কত তেজ, আয়!’
হেঁচকা টানে কাছে নিয়ে যে যেভাবে পেরেছে, মুখে, চোখে, হাতে মেয়েগুলোকে অপমান করেছে। মায়ের শাড়ী ধরেও নাকি কেউ একজন টান মেরেছে। পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারত, বয়স্ক কয়েকটা লোক এসে তাদের উদ্ধার করে সরিয়ে দেয় এবং দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করতে বলে। যেন দেশে যুদ্ধ লেগেছে, নারী-শিশুদের পালানো ছাড়া পথ নেই!
গল্প নয়, বাস্তব এই ঘটনাটি গতকালের।
লজ্জায়, অপমানে মেয়েগুলো তাদের মাকে নিয়ে সেদিন পালিয়েছিল ঠিকই কিন্তু চুপ করে থাকেনি। এ ঘটনার কিছু অংশ ফেসবুকে লিখেছিল একজন। মেয়েদের হয়রানি সংক্রান্ত ঘটনায় প্রতিবাদের কয়েকটি কার্যকর উদাহরণ তৈরি করায় অনেকেই সে লেখার নিচে আমাকে মেনশন করতে শুরু করেন। এরপর আমি মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ করি। মেয়েটি সাড়া দেয়। পুরো ঘটনায় বিচার চেয়ে একটি দরখাস্ত লিখে মেয়েটিকে আজ দুপুরে দেখা করতে বলেছিলাম। মেয়েটি বান্ধবীদের নিয়ে এসেছিল। তাকে নিয়ে নিউমার্কেট জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার সাজ্জাদ রায়হান ভাইয়ের অফিসে চলে যাই।
যাবার আগে আরো দু’জনকে বিষয়টি জানাই। এই দু’জন আমার ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ কাজে-কর্মে বিরক্তিহীন সহযোগিতা করেন সব সময়। এদের একজন এডিসি নাজমুন নাহার আপা, অন্যজন রাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডিআইজি জামিল আহমেদ । তারাও সাজ্জাদ ভাইকে এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এরপর রচিত হলো প্রতিবাদের এক দারুণ গল্প।
এসি সাজ্জাদ ভাইয়ের নির্দেশে দুটি টিম ছুটল চাঁদনি চকের দিকে। ভূক্তভোগি মেয়েরা ওই দোকান ও কর্মচারিদের চিনিয়ে দিল। বাকবিতান্ডা ও মার্কেট কমিটির সুপারিশের মধ্যেও চারজনকে ঠিকই ধরে নিয়ে এলো পুলিশ। মামলা হলো থানায়। আসামীদের চালান করা হয়েছে কোর্টে। যা জানলাম, দুই-চার মাসে জামিন হবার সম্ভাবনা নেই।
নিউমার্কেট এলাকা ঘিরে গড়ে ওঠা ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেল, ইডেন, বদরুন্নেসার মতো ঐহিত্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার নারী শিক্ষার্থী প্রতিদিন কেনাকাটা করতে যান। মার্কেটের দোকানগুলোর বদমায়েশ কিছু কর্মচারির দ্বারা প্রতিনিয়তই সেসব নারীরা নানা ভাবে নিগৃহীত হন। দিনে দিনে ব্যাপারটিকে তারা নিয়মে পরিণত করে ফেলেছেন।
এসব ঘটনায় দু-একজন যদিও বা প্রতিবাদ করে, সদলবলে ওরা তখোন হামলে পড়ে। প্রায়শই সেইসব দু:খের কাহিনী ফেসবুকে শেয়ার করেন ভূক্তভোগি নারীরা। কিন্তু প্রতিবাদের সঠিক রাস্তাটা জানা না থাকায় অনেকেই ইচ্ছা থাকা সত্যেও প্রতিকার পাননা। প্রতিবাদী নারীদের জন্য আজকের ঘটনাটা আলোকজ্জ্বল একটা উদাহরণ তৈরি করলো।
একটু সাহস নিয়ে এগিয়ে এলে, নিয়ম মেনে প্রতিবাদ করলে এবং সেই প্রতিবাদটা সঠিক যায়গায় পৌঁছে দিতে পারলে- এই দেশেও যে অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া সম্ভব, তা আরো একবার প্রমাণিত হলো।
নেই নেই করেও আমাদের দেশে যতটুকু নাগরিক সুযোগ-সুবিধা আছে আমরা তার কতটুকুই বা ব্যবহার করতে পারছি?
সহকারী কমিশনার সাজ্জাদ রায়হান ভাইকে ধন্যবাদ দিলে কম হবে। শুধু এটুকু বলব, আপনার মতো অফিসার আছে বলেই আমাদের আশার প্রদীপটা এখোনো নিভে যায়নি। যাপিত জীবনের সমবেত কষ্টগুলো, বেদনাগুলো আমরা আপনাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে কিছুটা হলেও শান্তি পেতে চাই। যেভাবে আপনি মেয়েটিকে অভয় দিলেন এবং পাশে থাকলেন তাতে নিশ্চয়ই মহান সৃষ্টিকর্তা আপনার এবং আপনার পরিবারের মঙ্গল করবেন। আমাদের দোয়া থাকল।
নিউমার্কেট এলাকায় প্রতিনিয়ত অনিয়ম-দূর্ভোগের শিকার নারীদের মধ্যে যারা ফেসবুকে চিল্লাপাল্লা না করে সত্যি সত্যিই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চান, তারা আমাদের দেখিয়ে দেয়া এই আইনি পথটি অনুসরণ করতে পারেন। মনে রাখবেন, আপনার প্রতিবাদটি অন্য কেউ এসে করে দিয়ে যাবে না। শুরুটা অন্তত আপনাকেই করতে হবে।
এই দেশে কিছু হয় না বলে যারা পাশ কাটিয়ে যান, যারা প্রতিবাদের বদলে প্রতিনিয়ত অন্যায়কে মেনে নেন, তাদের প্রতি অনুরোধ, নিজের যায়গা থেকে একটুখানি আওয়াজ তুলুন। জনারণ্যে শুরুতে সেই আওয়াজ বড় ক্ষীণ আর বেমানান ঠেকলেও ধীরে ধীরে দেখবেন আরো সহস্র আওয়াজ আপনার দিকে ছুটে আসছে। গণমানুষের সম্মিলিত সেই আওয়াজের সামনে দাঁড়ায়, এমন অপশক্তি কোথায়?
মার্কেট এলাকায় এমন ঘটনার শিকার হলে ভূক্তভোগির কিভাবে আবেদন লিখবেন তার একটি নমুনা দিচ্ছি। নমুনা দরখাস্তটি কাল্পনিক। আগ্রহীরা নিজেদের সঙ্গে ঘটা ঘটনা, নাম ও তথ্য বসিয়ে নেবেন। প্রতিকার পাবেন- এ কথা শতভাগ নিশ্চিত বলতে পারি।
বরাবর
সাজ্জাদ রায়হান
সহকারী কমিশনার
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ,
নিউ মার্কেট সার্কেল, ঢাকা।
বিষয় : নিউমার্কেট এলাকার গাউছিয়া মার্কেটে শপিং করতে গিয়ে দোকানির অভদ্র আচরণের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ প্রসঙ্গে
জনাব,
আমি তামান্না রহমান (ছন্মনাম), …… বিশ্ববিদ্যালয়ের ………. বিভাগের একজন নিয়মিত ছাত্রী। আমার সেশন ——–। আমার পিতার নাম ————।
গতকাল শুক্রবার বিকাল সাড়ে চারটার দিকে গাউছিয়া মার্কেটে শপিং করতে যাই। একটি দোকানে চুড়ির দর-দাম করে অন্য দোকানে যেতে চাইলে দোকানি আমাদের বাধা দেন। দাম শুনে না কিনে চলে যাবার জন্য আমাদের বাজে ভাষায় গালাগাল করেন। প্রতিবাদ করলে আমাদের উপর আরো চড়াও হয়ে তিনি অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকেন। এমনকি মারতেও উদ্যত হন। এই ঘটনায় আশপাশের দোকানের কেউ এগিয়ে তো আসেই নি বরং ওই দোকানির পক্ষ নিয়ে আমাদের হেনস্থা করে। এক পর্যায়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল ছাত্রী পরিচয় দেয়ার পরও লেখার অযোগ্য ভাষায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আমাকে গালাগাল করতে থাকেন ওই লোক। একপর্যায়ে আমাদের গায়ে হাত তুলতে শুরু করেন। এ ঘটনায় আমরা চরম অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছি। ওই দোকানির নাম না জানলেও দোকানটির অবস্থান আমি চিনি এবং দোকানিকেও দীর্ঘদিন কেনাকাটা করায় চেহারায় চিনি। এই এলাকায় আমার মতো হাজার হাজার নারী এইসব বদমায়েশ দোকানির দূর্ব্যবহারের এবং কখনো কখনো হামলারও শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আমি আমাদের সঙ্গে ঘটা এই ঘটনায় যথাযোগ্য বিচারের মাধ্যমে একটি উদাহরণ তৈরি করতে চাই। এ জন্য আপনার স্মরণাপন্ন হয়েছি।
অতএব, মহাদয়ের নিকট আবেদন, আমার অভিযোগটি আমলে নিয়ে, অভিযুক্তকে আইনের আওতায় এনে যাথোপযুক্ত শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে আমাকে বাধিত করবেন। উল্লেখ থাকে যে, অভিযানে গেলে আমি ওই দোকান ও দোকানিকে চিনিয়ে দিতে পারবো।
বিনীত নিবেদক
তামান্না রহমান (ছন্মনাম)
……বিভাগ।
….. বিশ্ববিদ্যালয়।
সেশন————-
হলের নাম———
ফোন নম্বর ——-
নিউমার্কেট এলাকার পুলিশ কর্মকর্তাদের এই নাম্বারগুলো যত্নে রাখুন। যখন-তখন লাগবে।
ওসি নিউমার্কেট থানা: ০১৭১৩ ৩৭৩১২৮
এসি নিউমার্কেট সার্কেল: ০১৭১৩৩৯৮৫৩২ (বিশেষ প্রয়োজনে এবং ওসি ও এসআই আমলে না নিলে)
ডিসি রমনা: ০১৭১৩৩৭৩১২০ (উপরের তিনজনের কেউ অভিযোগ আমলে না নিলে)।
https://www.facebook.com/abdullah.al.imran07/videos/10215720340631110/?t=1
শেষের আগে:
চার আসামীকে থানায় ধরে আনার পর প্রতিবাদী একটি মেয়ে দেখলাম দূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, “এখন কাঁদছ কেন? তুমি তো অনন্য একটা কাজ করেছ। আসামীরা ধরা পড়েছে।”
চোখ মুখে মেয়েটি জানাল, “ভাইয়া আনন্দে কাঁদছি, আনন্দে। কত মানুষ যে বলেছে, পুলিশ কিছু করবে না। পুলিশের কাছে যেও না। ওই জানোয়ারগুলোর কিছু করতে পারব না ভেবে গতকাল সারা রাত খুব কষ্ট পেয়েছি। কেঁদেছি। কিন্তু আসামীদের ধরার পর কী যে ভাল লাগছে! আনন্দে চোখে পানি চলে এসেছে। অন্যায়ের বিচার পেলে যে এতো আনন্দ হয়, জানতাম না, একদমই জানতাম না!”
কথা শেষ করে ফের কেঁদে ফেলল। মেয়েটির কান্না দেখে আমার চোখও ঝাপসা হলো।
আজ যদি এই মেয়েগুলো অপমানের বিচার না পেত, তবে সারা জীবন তারা ভাবত, এই দেশে বুঝি অন্যায়ের কোনো বিচার হয় না!
প্রতিবাদী মেয়ে তিনজনকে স্যালুট।
তাদের এই সাহসিকতার গল্প ছড়িয়ে দিন। পাশে দাঁড়ান। পাশে দাঁড়ানো বলতে বিপদে সহযোগিতা নয়। আপনার সৃষ্ট নতুন কোনো প্রতিবাদই হবে সত্যিকার অর্থে তাদের পাশে দাঁড়ানো।
সকলের মঙ্গল হোক।
নিরাপদ হোক নারীর পথচলা।
শুভ কামনা।
লেখাটি ফেসবুক থেকে নেয়া, এজন্য তা সম্পাদন করা হয়নি।