Headlines

ফুটবল বিশ্বকাপ এবং আমার শৈশব ।। দিব্যেন্দু দ্বীপ

football

[আপনিও লিখুন আপনার শৈশব এবং ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে। সবচে’ ভালো লেখাটিকে আমরা পুরস্কৃত করতে চাই।]

’৯৮ সালে কোয়ার্টাল ফাইনালে হল্যান্ডের কাছে আর্জেনটিনা হেরে যাওয়ার পর বাড়িতে এসে (মামাবাড়ি) দরজা দিয়ে কেঁদেছিলাম! সে আবেগ আর ধরে রাখতে পারলাম কই!! আমি আর্জেন্টিার সার্পোর্টার হই ৯০/৯১ সাল থেকে। তখন খেলা বোঝার মতো আমার বয়স নয়। তবে একটা বাক্য মনে গেঁথে গিয়েছিল। আমাদের বাড়ি একেবারে পাড়া গায়ে হলেও মাঝে মাঝে পত্রিকা আসত। [বাবা বাগেরহাট গিয়ে নিয়ে আসতেন। আমরা ছিলাম ভীষণ গরীব একইসাথে এলোমেলো এবং অভিজাত একটি পরিবার!] একটা পুরনো পত্রিকা কাঠের বেড়ায় লাগানো ছিল ঘুণে ধরা কাঠে একটু সৌন্দর্য আনার জন্য। ওতে লেখা ছিল, “রেফারির অশুভ কালো হাত জার্মানিদের জিতিয়ে দিয়েছে।” এটা ’৯০ বিশ্বকাপ ফাইনাল (আর্জেন্টিনা বনাম জার্মানি) ম্যাচের কথা লেখা ছিল।

এরপর থেকে আমি হয়ে গেলাম আর্জেন্টিনার সার্পোটার, একেবারে ডেড সার্পোর্টার। মামাবাড়িতে বেশিরভাগ ব্রাজিলের সাপোর্টার, ’৯৮ সালে আমি পড়ি নবম শ্রেণিতে, ছোটো ভাই সপ্তম শ্রেণিতে, ও নাছোড়বান্দা টাইপের—মামাদের দোতলা কাঠের বাড়ি চক দিয়ে এঁকে এঁকে ব্রাজিলের পতাকা দিয়ে ভরে দিল, আমি পাল্লা দেয়ার একটা বৃথা চেষ্টা করলাম।

ওবার শেষ পর্যন্ত জিতলও তো বোধহয় ব্রাজিল, নাকি, না ফ্রান্স? মনে আছে, ওর্তেগা নামে আর্জেন্টিার একজন খেলোয়াড় নেদারল্যান্ডের গোলকিপারকে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ মাথা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে লাল কার্ড পায়, এরপর মনোবল কমে যাওয়ায় মূলত আর্জেন্টিানা সেবার হেরে যায়। ঐ গোলকিপারই তাকে প্রথমে উত্তেজিত করেছিল, কিন্তু সে কথা ইতিহাস লিখে রাখে না। একই কাণ্ড ঘটেছিল একবার জিদানের বেলায়ও। ঐবারও তো ফ্রান্স হেরে গেল, তাই না?

বাড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ আর্জেন্টিানার সাপোর্টার না, এটাও ভালো লাগল না। সবাই যে ব্রাজিলের সাপোর্টার ছিল তাও না। এক একজন একেক দলের সাপোর্টার। দাদু ছিলেন ইতালির, ছোটো মামা ফ্রান্সের, বলাই মামা ব্রাজিলের, বড়ো মামা ব্রাজিল, কানাই মামা জার্মানির, মেজ মামা অন্য রকম, আমি আর্জেন্টিনা, লেলিন ব্রাজিল; বাড়ির মহিলারা তো ‘মহিলা’। সংখ্যাগরিষ্ট ব্রাজিলই ছিল। ব্রাজিলের সমর্থকদের আমরা সুবিধাবাদী বলতাম। বলতাম, “জেতে বলে সাপোর্ট করে, শুনে শুনে সাপোর্ট করে।” তাঁরা একটা জিনিস বলা শুরু করল, “আমরা শৈল্পিক ফুটবলের সমর্থক।” দুএকজন এটা শুনে বলা শুরু করল, “আমরা শিল্পি ফুটবলের সমর্থন করি।” আমরা বলতাম, “খাইছে!”

অবশ্য রোনালদিনহোর ফ্রি কিকের একটা গোল এখনো আমি ভুলতে পারি না। ওটা ছিল ২০০২ কোরিয়া বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সাথে খেলায়। অন্যদিকে রোনালদো ছিল দুর্দান্ত এক সুযোগ সন্ধানী স্ট্রাইকার। রোনালদো বোধহয় ব্রাজিলকে দুটো বিশ্বকাপ জিতিয়েছে, কিন্তু তাঁর কথা খুব কমই আলোচিত হয়।  

খেলা দেখতে যেতাম অন্য বাড়িতে, বিদ্যুৎ ছিল না, বর্ষাকালে কাঁদা ভেঙ্গে যেতে হতো। ’৯৪ বিশ্বকাপের কয়েকটি খেলা দেখেছিলাম আলোকদি গ্রামে পরিতোষ স্যারদের বাড়িতে। সেও এক কিলোমিটার দূরে। শেষ কয়েকটি খেলা দেখেছিলাম মিহির মামাদের বাড়িতে, সেটা ঠিক ’৯৪ বিশ্বকাপ নাকি ’৯৮ বিশ্বকাপ ঠিক মনে নেই। ’৯৮ বিশ্বকাপের বেশিরভাগ খেলা দেখেছিলাম বাসুদের দাদুদের বাড়িতে, এটা মামাবাড়ি থেকে বেশ কাছে ছিল। তবে হাঁটু সমান কাঁদা ভাঙা থেকে রেহাই ছিল না। ’৯৪ বিশ্বকাপেরও বেশিভাগ খেলা দেখতে গিয়েছি বটে, তবে দ্বিতীয় খেলাটা দেখতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্নে দেখা শুরু করেছি এমনও হয়েছে বহুবার।  

ব্যাটারি দিয়ে সাদা কালো টিভিতে খেলা দেখা হতো। ছবি ঝিরঝির করতো, কখনো শোওওও করে বন্ধও হয়ে যেত! তাতে কি, বিশাল আনন্দ হতো, গ্রামের প্রায় সব পুরুষ একসাথে খেলা দেখত। বাড়িতে এসে দেখতাম, দিদিমা রান্নাবান্না করে রাত জেগে আছেন। খেলায় চলতো নানান মতামত, হিসেব-নিকেষ। জার্সি দেখে খেলোয়ার চিনতে মাঝে মাঝে অসুবিধা হতো যেহেতু সাদাকালো টিভি, দুদলের জার্সি অনেক সময় একই রংএর হয়ে যেতো। মনে পড়ে, চিত্ত জামাই তখন একটা উপায় আবিষ্কার করলেন, প্যান্ট দেখে খেলোয়াড় চিনতে হবে। ওনাকে দেখে আড়ালে আমরা বলতাম, “সাদা প্যান্ট-কালো প্যান্ট” আসতেছে।

মাঝে মাঝে টিভি এতটা ঝিরঝির করতো যে কিছুই বোঝা যেতো না, চোখের সে কি কসরত! প্রথম আমি খেলা দেখা শুরু করি ’৯৪ সালে, সেবার আর্জেন্টিনা সম্ভবত কোয়ার্টার ফাইনালে হেরেছিল। মনে নেই ঠিকমতো। ফাইনালে ইতালি ব্রাজিলের সাথে হেরেছিল বেজিওর পেনাল্টি কিক মিস হলে। ঐ বছরই বোধহয় ম্যারাডোনা শেষ খেলেছিল, গ্রিসের সাথে ম্যারাডোনার খেলা দেখেছিলাম। আবছা আবছা মনে পড়ে সবকিছু।  ম্যারাডোনা শেষ খেলেছিল ’৯৪ তেই। কোকেইন পজেটিভ হওয়ায় ম্যরাডোনা ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ হয়ে যায় সেবার থেকে।  ম্যারাডোনার মাঠ ছেড়ে যাওয়ার সে দৃশ্যটি অনেকেরই মনে আছে, গুগল সার্চে সেটি পাওযা যায়।