প্রতিটি গ্রাম হয়ে উঠবে এক একটি ছোট্ট সবুজ শহর

follow-upnews
0 0

মসনী


সমস্যা

বিগত কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশে মানুষের শহরে যাওয়ার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। শহর বলতে বিশেষ করে ঢাকা শহরে মানুষ ভিড় জমাচ্ছে। ঢাকা শহর অনেক আগেই তার ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত জনসংখ্যা ধারণ করে ফেলেছে। এই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে পরিকল্পনা এবং যথাযথ উদ্যোগের অভাবে। তাছাড়া আশির দশক থেকে ঢাকা শহরে পোশাক প্রস্তুত শিল্প (মূলত কারখানা) বিস্তার লাভ করায় প্রচুর শ্রমিক ঢাকায় টেনে নেয়ার প্রয়োজন হয়েছে।

অন্যান্য শিল্প, কুটির শিল্প, অফিশ, কলকারখানা —সবই ঢাকায় এবং ঢাকার আশেপাশে স্থাপিত হয়েছে, ফলে মানুষ কর্মসংস্থানের লোভে ঢাকার পথে নেমেছে। এটা এখন যতটা না সুযোগ তার চেয়ে অনেক বেশি অভ্যাস। কর্মসংস্থান একটা হয়ত তাদের জুটেছে, কিন্তু তাদের অজান্তেই তারা জীবন হারিয়ে ফেলেছে, প্রত্যেকে হয়ে উঠেছে উদ্দেশ্যহীন এক একটি কর্মদানব (যন্ত্রমানব)। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ডিউটি করে, এরপর এক রুম বা দুই রুমের বাসায় (হলোই বা একটি ফ্লাট বাসা) সবাই মিলে মাথা গুজে থাকা, কোনোমতে কিছু খেয়ে আবার সকালে বেরিয়ে পড়া। আসার যাওয়ার পথে নানান বিপত্তি, অসহ্য ট্রাফিক জ্যাম, দূষণ —আসলে নিম্ন আয়ের মানুষের, এমনকি মধ্যবিত্তদেরও ঢাকায় বিড়ম্বনার শেষ নেই। উচ্চ আয়ের মানুষেরাও যে খুব স্বস্তিতে আছে তা নয়, কারণ, অব্যবস্থাপনা এবং ফলস্বরূপ অস্বস্তির প্রকারটাই হচ্ছে— পরিবহন, পরিচলন বা বিকিরণ যেকোনো পদ্ধতিতে তা ছড়িয়ে পড়বেই, সবাইকেই আক্রান্ত করবে। করছেও তাই।

সোজা কথায় শেকড় থেকে সরে গিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে গিয়ে মানুষ অসুস্থ অস্থির হয়ে পড়েছে ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে। মানুষের এখন হাসফাঁস অবস্থা। একটা বিষচক্রের মধ্যে তারা পড়ে গিয়েছে। চাইলেই রাতরাতি এখান থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না, তবে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে অবশ্যই সম্ভব। পরিকল্পনাটা যার যারটা তারই করতে হবে। তবে সাংগঠনিকভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে মডেল তৈরি করে তাদের উদ্বুদ্ধ করার কাজটি প্রথমে করতে হবে।

সম্ভাব্য সমাধান 

গ্রামের মানুষকে গ্রামেই রাখতে হবে। শুধু নিজের বাড়িতেই যে তার কর্মসংস্থান সবটুকু হয়ে যাবে তা নয়, তবে গুচ্ছগ্রাম পদ্ধতিতে হবে। প্রতিটি গ্রামে কৃষিভিত্তিক খামার এবং পরিবেশ বান্ধব কূটির এবং ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তুলতে হবে।

গ্রামের মৌলিক চাহিদাগুলো যদি গ্রামে বসেই সমাধান হয়ে যায় তাহলে মানুষ শহরে যাবে না, যাবে কেন? শহরে বা অন্য কোথাও যাবে মানুষ বেড়াতে। এজেন্ট ব্যাংকিং-এর কল্যাণে গ্রামে এখন ব্যাংকও আছে, কৃষি ব্যাংক তো আগে থেকেই আছে— রাস্তাঘাট, বিদুৎ সব যদি গ্রামে পৌঁছে যায় তাহলে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে গ্রামপ্রধান সক্ষম স্বচ্ছল সুন্দর দেশের একটি অসাধারণ মডেল।

চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং সুশিক্ষা দেওয়া। চ্যালেঞ্জ হলেও সেটি অসম্ভব নয়। পাশাপাশি মানুষকে বোঝাতে হবে কীভাবে অপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলো এড়িয়ে যেতে হয়। গ্রামের ব্যবসাপাতির কন্ট্রোল যদি শিক্ষিত সচেতন মানবিক মানুুষের হাতে থাকে, তাহলে তারা অপ্রয়োজনীয় হাবিজাবি পণ্যের বিস্তার ঘটানো বন্ধ করতে পারবে। প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো চিহ্নিত করে সেগুলো নিয়ে কাজ করতে পারবে।

প্রথাগত শিক্ষার পরিবর্তন যেহেতু সরকারি সিদ্ধান্ত এবং দীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক বিষয়, তাই অলটারনেটিভ স্কুল খুলে গ্রামের মানুষকে বাস্তবসম্মত শিক্ষা দিতে হবে। ঝরে পড়াদের কাজে লাগাতে হবে। তাদেরকে কর্মমুখী শিক্ষা দিয়ে কাজে লাগানো অধিকতর সহজ এবং কার্যকর, কারণ, ইতোমধ্যে তারা নিজেকে “বাজে শিক্ষার্থী” বলে চিহ্নিত করে ফেলেছে, ফলে তাদের পক্ষে ফালতু ইগো থেকে বের হয়ে আসা সহজ হয়।  

পাশাপাশি তিনটি গ্রামকে গুচ্ছ ধরে কাজটা শুরু করা যেতে পারে। তালিকা করতে হবে গ্রামে কারা বেকার আছে, কোথায় কোথায় জমি পতিত আছে এবং কী ধরনের সম্ভাবনা আছে। পাশাপাশি গ্রামের কারা শহরে থেকে কোনোমতে জীবনযাপন করছে, সে খোঁজখবর নিতে হবে। প্রথম যারা গ্রামে আছে তাদের নিয়ে কাজ করতে হবে, বাইরে যারা আছে তাদের সবাইকে ফিরিয়ে না এনে (অসম্ভব), খুব কষ্টে আছে এমন দুএকজনকে ফিরিয়ে এনে কাজ দিয়ে উদাহরণ তৈরি করতে হবে। মডেল তৈরি করতে হবে, যাতে অন্যরা সাহস পায়। করতে পারলে সিস্টেমটা অটো রান করবে। প্রতিটি গ্রামই হয়ে উঠবে এক একটি ছোট ছোট সবুজ শহর।

যা যা করার পরিকল্পনা

প্রথমত, তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাদেরকে বোঝাতে হবে সামষ্টিক লাভের কথা, কীভাবে সকলে মিলে ভালো থাকা যায। প্রথমে তাদেরকে বিশ্বাস করাতে হবে যে, গ্রামে বসেই গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব। ভালো থাকা সম্ভব, সঞ্চয় করা সম্ভব। যে কোনো একটি জায়গা থেকে শুরু করতে হবে। যেমন, গ্রামের অনেক নারী মুরগী পালে, গরু পালে, কাঁথা সেলাই বা বিভিন্ন কারুকাজ করে— তাদেরকে সহযোগিতা করতে হবে, যাতে কাজটি তারা আরও ভালোভাবে করতে পারে। তাদের উৎপাদিত পণ্য কোথায় কীভাবে বিক্রী হতে পারে, সে ব্যবস্থাটি করে দিতে হবে। অনেকে বাঁশের কাজ করছে, অনেক চীড়া মুড়ি ভাজে, সেখানে প্রণোদনা দিতে হবে। আরও কী কী কাজের সুযোগ আছে, সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে। সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে যথাসম্ভব অর্গানিক খাদ্যপণ্য প্রস্তুতির দিকে, কারণ, এটাই গ্রামে বসে সর্বাধিক কার্যকরভাবে করা সম্ভব। যেগুলো বেশি দাম দিয়ে কিনতে প্রস্তুত আছে শহরের মানুষ। এভাবে গ্রাম এবং শহরের মানুষের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক ভারসাম্যমূলক যোগাযোগ গড়ে উঠবে।

একটি ফার্টিলাইজার প্লান্ট বসিয়ে অর্গানিক ফার্টিলাইজার প্রস্তুতের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সমবায়ভিত্তিক কিছু খামার গড়ে তুলতে হবে, সেখানে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। এখন অনেক ব্যাংকই এজেন্ট ব্যাংকিং দিচ্ছে। গ্রামের একজন স্বচ্ছল লোক এগিয়ে এসে যেকোনো একটি ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং নিয়ে ব্যাংকিং সাপোর্টটা দিতে পারে। অবশ্য গ্রাম থেকে কোনো না কোনো ব্যাংকের একটি শাখা খুব দূরে নয় এখন আর।

গ্রামের বাড়িতে সবারই একটা বা দুটো গরু এবং কয়েকটি মুরগী পালার সুযোগ আছে, সে কাজটি তারা করছে কিনা দেখতে হবে। করলেও বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে করছে না, অনেকে আবার ওভারলোড নিতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছে। ব্রয়লার চাষ করতে গিয়ে তারা দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়েছে। তাদেরকে বুঝাতে হবে, বিষবৃত্ত থেকে বের করে আনতে হবে। তাদেরকে বুঝাতে হবে যে, ভেজাল মুক্ত বিশুদ্ধ খাবার নিজেদের জন্য আগে নিশ্চিত করতে হবে, এরপর কিছু বাড়তি হলে বিক্রী। প্রথমেই ব্যবসার চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। মাংস, মাছ, দুধ, ডিম, চাল, শাক সবজির যোগান নিজেদেরটা নিজেরা করতে পারলে, আর নিজের বাড়িতে থাকতে পারলে এর চেয়ে শান্তি আর কী হতে পারে! বছর শেষে বিশ হাজার টাকা জমাতে পারলেও তো অনেক। পরিকল্পনামাফিক চলতে পারলে সম্ভব।

শিক্ষার জন্য একটি অনলাইন স্কুল থাকবে। যেখানে প্রজেক্টরের মাধ্যমে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে জ্ঞান বিতরণ করা যাবে। সব বয়সের সবাই ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারবে। ছোটদের জন্য আলাদা সেশন থাকবে। মাঝে মাঝে সেখানে সিনেমা, নাটক দেখানো হবে। একটি ক্লাব থাকবে, যেটি খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো পরিচালনা করবে। একটি ওয়েবপোর্টাল থাকবে যেখানে ঐ গ্রামগুলির খবরাখবর এবং কর্মকাণ্ডগুলি প্রকাশিত হবে, গ্রামে যে পণ্যগুলো উৎপাদিত হবে, সেগুলোর বাজারজাতকরণেও ওয়েব পোর্টালটি সাহায্য করবে। এটি গ্রাম ভিত্তিক না হয়ে উপজেলা ভিত্তিকও হতে পারে। যেমন, এই মুহূর্তে বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার জন্য আমরা এরকম একটি ওয়েব পোর্টাল তৈরির কাজ করছি।

প্রতিটি গ্রামের একটি কমন ফান্ড থাকবে। গ্রামের কেউ অসুস্থ হলে বা বিপদে পড়লে ফান্ড থেকে তাকে সহযোগিতা করা হবে। সহযোগিতা সে পাবে প্রয়োজনের ভিত্তিতে। অর্থাৎ যার প্রয়োজন আছে সে পাবে। কিন্তু ফান্ডে নির্দিষ্ট হারে টাকা জমা করবে সবাই। হতে পারে মাসে একশো টাকা করে মাথাপিছু জমা করতে হবে। কোনো বিষয়ই পরিবারভিত্তিক না করে জনপ্রতি করলে তাতে ন্যায্যতা আরও স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। শহরে বা বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত কোনো মানুষ গ্রামের এই ফান্ডে টাকা দিতে চাইলে দিতে পারবে।  

যে জায়গা থেকে শুরু করব আমরা

প্রথমে পাশপাশি তিনটি গ্রামের সকল ধরনের তথ্য নিয়ে একটি ডাটাবেস তৈরি করা হবে। ডাটা এনালাইসসি করে প্রাথমিক করণীয় নির্ধারণ করা হবে। তিনটি গ্রাম থেকে পাঁচ জন করে নিয়ে একটি ওয়ার্ক ফোর্স গঠন করা হবে, যারা বিভিন্ন সামজিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি নিজেদের জন্য যুতসই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। অর্থাৎ এই পাঁচজনই প্রথমে কিছু উদাহরণ তৈরি করবে, পাশাপাশি অলটারনেটিভ স্কুলটা পরিচালনা করা হবে, ক্লাবটি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হবে। একটি ডিজিটাল পাঠাগার থাকবে, যেখানে কম্পিউটার এবং আইটি প্রশিক্ষণ সহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। প্রকৃতপক্ষেই যদি এগুলো করা সম্ভব হয়, তাহলে সত্যিকারার্থেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে পারে।


দিব্যেন্দু দ্বীপ

গবেষক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

Next Post

পথকাব্য: “এই যে সবকিছু বুঝতে পারি এটাই আমার সুখ”

অনেকদিন ধরে একজন সাধু উসখুস করতেছেন আমাকে কিছু বুদ্ধি পরামর্শ দেবেন বলে। কিন্তু আমার কিছুতেই সময় হয় না। আসলেই তো সময় হয় না। কিছু সময় হলে সেটি তো ঈশপের জন্য বরাদ্দ থাকে। যাইহোক, শেষপর্যন্ত গতকালকে তার সাথে বসলাম। কিছু অগোছালো খোস গল্পের পরে উনি আমাকে প্রশ্ন করা শুরু করলেন। আমি […]
বাগেরহাট