একই শব্দের বহুবিধ ব্যবহারের সাথে আমরা পরিচিত। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে একটি নির্দিষ্ট শব্দের অর্থ যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ নেয়, তার প্রচুর উদাহরণ আমরা জানি। তেমনি একটি সুপরিচিত শব্দ ‘পাগল’। বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধানের পরিমার্জিত সংস্করণ অনুসারে, ‘পাগল’ শব্দটির কয়েক ধরনের অর্থ হয়। ‘পাগল ছেলে, যা বায়না ধরবে, তা নেবেই’ —এই বাক্যে ‘পাগল’ বলতে বোঝানো হচ্ছে ছেলেটি ‘অবোধ’।
‘রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে একেবারে পাগল’ —এখানে ‘পাগল’-এর অর্থ বিমুগ্ধ, বিমোহিত। ‘কী দিয়া সুন্দরী মোরে করিল পাগর (পাগর= কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী কর্তৃক ব্যবহৃত পাগলের বিকল্প শব্দ)’ —এখানে পাগর/পাগল এর মানে মত্ত বা মাতাল।
উপরিউক্ত উদাহরণগুলোতে ব্যবহৃত ‘পাগল’ শব্দের কোনো অর্থই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কোনোভাবে ‘অসুস্থ’ বলে চিহ্নিত করে না। বরং, ব্যক্তির কোনো বৈশিষ্ট্যকে উপস্থাপন করে যা কখনো রসিকতা, কখনো স্নেহ, কখনো ভালবাসায় বিশেষায়িত। পাগলের আরেক ধরনের অর্থ অভিধানে রয়েছে যা হচ্ছে— বাতুল, উন্মাদ, বিকৃতমস্তিষ্ক, ক্ষ্যাপা। এই অর্থটি এক ধরনের অসুস্থতার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং বহুল ব্যবহৃতও।
সাধারণ্যে বা অধিকাংশের মাঝে অসুস্থ বোঝাতে ‘পাগল’ শব্দের ব্যবহারে যে চিত্রটি ফুটে ওঠে তা হচ্ছে— ঐ ‘পাগল’ ব্যক্তিটি উলঙ্গ অবস্থায় অথবা ময়লা, জীর্ণ, শতচ্ছিন্ন কাপড় গায়ে, রুক্ষ জটপাকানো চুলে, পুরুষ হলে মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল নিয়ে, রাস্তায় রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ায়; ডাস্টবিন ঘেঁটে খাবার কুড়োয়; অশ্রাব্য গালি-গালাজ বা অশ্লীল বাক্যের তুবড়ি ছোটায়; যখন-তখন যে কারো দিকে তেড়ে যায় বা আক্রমণ করে বসে, ভাঙচুর করে ইত্যাদি ইত্যাদি। দুঃখজনক ব্যাপারটি হচ্ছে, ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’ বা ‘মানসিক রোগী’ বলতেও অনেকের চোখে রোগী বা অসুস্থ ব্যক্তিটিরও কেবল এই ধরনের চিত্রই ফুটে ওঠে, আদতে যা পুরোপুরিই অজ্ঞতাপ্রসূত।
তাহলে মানসিক রোগ কী? মানসিক অসুস্থতা বলতে কী বোঝায়? সহজ কথায় মানসিক অসুস্থতা হচ্ছে মনের রোগ। শরীরের যেমন রোগ হয়, রোগ হয় মনেরও। শরীরের যেমন অনেক অংশ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, মনও তেমনি অনেকগুলো বিষয়ের সমষ্টি। শরীরকে যেমন ভাগ করা যায় মাথা, হাত, পা, চোখ, পেট, বুক, শরীরের ভেতরের হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি, যকৃত, পাকস্থলি —এমনি নানা অংশে; তেমনি মনও অনুভূতি, আবেগ, বোধ, চিন্তা, স্মৃতি —এমনি নানা উপাদানে গঠিত। শরীরের একেক অংশের রোগ, এর উপসর্গ-লক্ষণ যেমন একেক রকম, তেমনি মনেরও নানা উপাদানের অসুস্থতাজনিত বহিঃপ্রকাশও ভিন্ন ভিন্ন। আবার, শরীর ও মন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িতও। শারীরিক রোগে যেমন মানসিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে, তেমনি মানসিক রোগের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে শারীরিক লক্ষণের মাধ্যমে।
মানসিক রোগগুলোকে বোঝার সুবিধার্থে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটি হচ্ছে নিউরোসিস। অপরটি সাইকোসিস। নিউরোসিস-জাতীয় রোগে আবেগের প্রকাশ বা মাত্রা স্বাভাবিকতা অতিক্রম করে যায়। যেমন— মন খারাপ, উদ্বেগ, ভয় এগুলো মানুষের স্বাভাবিক আবেগীয় প্রকাশ। দুঃখ বা ব্যর্থতায় যে কারো মন খারাপ হতে পারে, যে কোনো দুঃসংবাদ বা বিপদাশঙ্কায় উদ্বেগও স্বাভাবিক, কুকুর, উচ্চতা বা অন্ধকারে কিছুটা ভয়ও অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু এইসব আবেগ স্বাভাবিক মাত্রা ও সময়কে অতিক্রম করে যখন ব্যক্তির জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, শিক্ষা বা পেশাগত জীবনকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাধাগ্রস্ত করে, তখনই কেবল তা রোগ হিসেবে চিহ্নিত হয়। আবার, অনেক সময় মানসিক চাপের প্রকাশ ঘটে শারীরিক কোনো উপসর্গে— এসব ক্ষেত্রে উপসর্গ শারীরিক হলেও এর পেছনে শারীরিক কোনো রোগের প্রমাণ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পাওয়া যায় না।
নিউরোসিস রোগীর ক্ষেত্রে রোগী সাধারণত বাস্তবতার সাথে সংযোগ হারায় না এবং তার ব্যক্তিত্বেরও উল্লেখযোগ্য কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটে না। বিষন্নতা (ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার), উদ্বেগাধিক্য (অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার), অহেতুক ভীতি (ফোবিক ডিসঅর্ডার), শুচিবায়ু (অবসেসিভ-কমপালসিভ ডিসঅর্ডার) প্রভৃতি নিউরোসিসের উদাহরণ।
অন্যদিকে ‘সাইকোসিস’-এর রোগীদের আচার-আচরণ, ব্যবহার বা কথাবার্তা, ব্যক্তিত্ব এলোমেলো, বিশৃঙ্খল হয়ে যায়। বাস্তবের সাথে তাদের সংযোগ থাকে না। অনেকের মাঝে অযৌক্তিক, ভিত্তিহীন, ভ্রান্ত অথচ দৃঢ় বিশ্বাস দেখা দেয়। যেমন, সাইকোসিসে আক্রান্ত অনেক রোগী বিশ্বাস করেন— সবাই তার শত্রু, সবাই তার ক্ষতি করার জন্য ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে, অথবা সে নিজে বিরাট ক্ষমতার অধিকারী, অনেক টাকা-পয়সা বা ক্ষমতার মালিক— যদিও বাস্তবে এর কোনোটিই সত্য নয়। অনেকে গায়েবী আওয়াজ শোনেন বা গায়েবী কিছু দেখেন। তারা সাধারণত নিজেরা বুঝতে পারেন না যে তারা রোগাক্রান্ত। আশপাশের লোকজন সহজেই তাদের ভেতর এই পরিবর্তনটি ধরতে পারেন। সিজোফ্রেনিয়া, ম্যানিয়া বা বাইপোলার ডিসঅর্ডার —এগুলো সাইকোসিসের উদাহরণ। এছাড়া মাদকাসক্তি, মানসিক প্রতিবন্ধী, ব্যক্তিত্ব বৈকল্যসহ আরো অনেক ধরনের মানসিক রোগ রয়েছে। আবার শারীরিক রোগের কারণেও দেখা দিতে পারে মানসিক রোগের লক্ষণ-উপসর্গ।
কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, আমরা অনেকেই এখনো ‘মানসিক রোগ’ বলতে আটকে আছি ঐ ‘পাগল’-এই। অথচ ‘পাগল’ বলতে যে চিত্র ভেসে ওঠে, মানসিক রোগীদের মধ্যে যারা সাইকোসিসে ভোগেন তাদের কেবল একটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে সেরকম লক্ষণ-উপসর্গ দেখা যায়। এই ক্ষুদ্র অংশেরও অধিকাংশ চিকিৎসা নেন না বা চিকিৎসার আওতায় আসেন না বলেই উপসর্গগুলো এই পর্যায়ে পৌঁছায়। সময়মতো যথাযথ চিকিৎসায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীর অতোটা অবনতি সহজেই রোধ করা যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের গবেষক দলের জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১৮ বছরের উপরের জনসংখ্যার ১৬.১% মানুষ মৃদু থেকে গুরুতর মানসিক রোগে ভুগছে। এর মধ্যে ১.১% সাইকোসিসে আক্রান্ত। যে সাইকোসিসের একটি ক্ষুদ্র অংশের উপসর্গের সাথে মিল রয়েছে তথাকথিত ‘পাগল’দের। বাকি ১৫% রোগীর মধ্যে মাদকাসক্তি ও অন্যান্য কিছু রোগ বাদে প্রায় সকলই নিউরোসিস, যারা তাদের যে সমস্যা বা কষ্ট হচ্ছে, তা নিজেরাই বুঝতে পারেন। কিন্তু এই বুঝতে পারা সত্ত্বেও তারা চিকিৎসা নিতে যান না। কারণ, সমস্যা বুঝলেও সেটা যে ‘মানসিক রোগ’ তা তারা বুঝতে পারেন না।
ঐ যে মানসিক রোগী মানে তো ‘পাগল’! তারা ভাবেন— আমি তো আর পাগল না! তাহলে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাবো কেন? সাইকিয়াট্রিস্ট বা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে তো যাবে ‘পাগল’রা। আবার অনেকে এটাকে মানসিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারলেও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যান না। মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে যাব বা মানসিক রোগের হাসপাতালে যাব? —লোকে কী বলবে! অজ্ঞ, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ব্যক্তিদের কাছে এখনো মানসিক রোগ মানেই ‘পাগলামি’। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এমনকি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাঝেও এই প্রবণতা দেখা যায়। ‘পাগল’ অভিধায় মানসিক রোগী যেন সমাজে অচ্ছুত, তার পরিবার যেন একঘরে।
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগেও, নিমিষেই সকল তথ্য হাতে পাওয়ার অপার সুযোগের এই সময়েও মানসিক রোগ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার এই চলমান ধারা খুবই দুঃখজনক। মানসিক রোগীদের সঠিক চিকিৎসার আওতায় আনার জন্য প্রয়োজন সকলের মাঝে মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা। সকলের মাঝে মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা জাগ্রত হোক, সকল নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, কুসংস্কার, জড়তা কাটিয়ে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সুচিকিৎসা লাভে সচেষ্ট হোন।
ডা. মুনতাসীর মারুফ
সহকারী রেজিস্ট্রার
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।