মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর শরীরে শারীরিক বিপাকের ফলে যে বর্জ্য তৈরী হয় তা শরীর থেকে বের করে দেওয়ার জন্য ছাঁকনি হিসেবে কিডনি কাজ করে। কিডনি শরীরে প্রবাহিত সমস্ত রক্ত ছেকে পানির সাথে মিশিয়ে মূত্র হিসেবে শরীরের বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়। কোন কারনে কিডনি নষ্ট হলে কিডনির পরিবর্তে কৃত্রিম ছাঁকনি ব্যবহার করে তার মধ্যে দিয়ে শরীরে প্রবাহিত সমস্ত রক্ত ছেঁকে শরীর থেকে বর্জ্য বের করে দেওয়ার প্রক্রিয়াকে চিকিৎসা শাস্ত্রে বলা হয় ডায়ালাইসিস্ এবং যে কৃত্রিম ছাঁকনি দিয়ে এ ছাঁকন প্রক্রিয়া করা হয় তাকে বলা হয় ডায়ালাইজার।
ডায়ালাইসিস কেন এবং কখন লাগে? ডায়ালাইসিস কত প্রকার?
সাধারণত কিডনি বিকল হলে ডায়ালাইসিস্ করতে হয়। কিডনি বা বৃক্ক এবং এর বিকল্প ডায়ালাইজার তরল পদার্থের ব্যাপন (diffusion) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রক্ত হতে বর্জ্য পদার্থ এবং সূক্ষ ছাঁকন প্রক্রিয়ায় (ultrafiltration) পানি ছেঁকে একে মূত্র হিসেবে শরীর থেকে বের করে দেয় ।
ডায়ালাইসিস কত প্রকার?
ডায়ালাইসিস মূলত ২ ধরনের:
১. হেমোডায়ালাইসিস
২. পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস
হেমোডায়ালাইসিস
সাধারনত একটি মেশিনের মাধ্যমে হেমোডায়ালাইসিস করা হয়। মেশিনটি শরীরের বাইরে স্থাপিত থাকে এবং এর মধ্যকার ফিল্টারের মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবাহিত করা হয়। পরিশোধন শেষে রক্ত পুনরায় শরীরে ফেরত পাঠানো হয় । সাধারণত সপ্তাহে তিন থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত হিমোডায়ালাইসিস করতে হয়। প্রতি সেশনে কতটা সময় করতে হবে তা নির্ভর করে রোগীর কিডনির অবস্থার ওপর। কিছু ক্ষেত্রে রোগীর হিমোডায়ালাইসিস বাড়িতেও করা সম্ভব। যেমন— ডায়ালাইসিস করার সময় যে রোগী সুস্থ থাকে বা অবস্থা পরিবর্তিত হয় না, যখন রোগীর অন্য কোনো অসুখ না থাকে। হেমোডায়ালাইসিস করার আগে হাতে একটি এভি ফিস্টুলা করে নিতে হয়। এটি ডায়ালাইসিস শুরু করার অন্তত এক মাস আগে করতে হয়, কারণ, ক্ষত শুকিয়ে এটি তৈরি হতে মাস খানেক সময় লাগে।
এভি ফিস্টুলা: রক্তনালীর ফিস্টুলাকে ডায়ালাইসিস রোগীদের লাইফ লাইন বলা হয়। কারন এর মাধ্যমেই ডায়ালাইসিস করা হয় যা কৃত্রিম কিডনির কাজ করে, শরীরের বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়। এদের ভাসকুলার একসেস বা হিমোডায়ালাইসিস একসেস ও বলা হয়।।
পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস
এই প্রক্রিয়ায় রোগীর শরীরের মধ্যেই রক্ত পরিশোধন করা হয়। একধরনের বিশেষ তরল পেটের ভিতরে রাখা হয় যেটি বর্জ্য পদার্থ গ্রহণ করে নেয় এবং নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া শেষে তরল বের করে নেয়া হয়। পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস সাধারনত বাসায় করা হয় ।পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস আবার দুই রকম। কন্টিনিউয়াস অ্যাম্বুলেটরি পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস বা সিএপিডি। কন্টিনিউয়াস সাইক্লিক পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস বা সিসিপিডি। প্রথমটি প্রতিদিন কয়েকবার করতে হয়। খুবই সহজ। রোগী বা রোগীর সঙ্গের লোকই করতে পারেন। কোনো যন্ত্রপাতির সাহায্য লাগে না। দ্বিতীয়টি সাধারণত রোগী যখন ঘুমায় তখন করতে হয়। সাধারণত প্রতি রাতেই করতে হয়। সময় লাগে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা। এটা করতে ছোট একটি মেশিনের সাহায্য লাগে।
সতর্কতা
একই ডায়ালাইজার এর মধ্যে দিয়ে একাধিক রোগীর রক্ত প্রবাহিত করে পরিশোধন করলে রক্তের মাধ্যমে রক্ত বাহিত মারাত্মক সংক্রামক রোগ যেমন হেপাটাইটিস বি হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই, কিডনি রোগীদের চিকিৎসায় ডিসপোজেবল (ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয়) ডায়ালাইজার ব্যবহার করা আবশ্যক।
এভি ফিস্টুলা করলে যেসব বিষয় লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন:
১. ফিস্টুলা করা হাতের শিরায় আইভি লাইন তৈরী করা যাবে না; শিরা থেকে রক্ত নেওয়া যাবেনা; বা কোনো ঔষধ প্রয়োগ করা যাবে না।
২. ফিস্টুলা করা হাতে রক্তচাপ পরিমাপ করবেন না।
৩. ফিস্টুলা করা হাত মাথার নিচে দিয়ে শোবেন না বা ঘুমাবেন না।
৪. অপারেশন করা হাত দিয়ে ভারী কাজ করবেন না বা ভারী কোনো কিছু উঠাবেন না। ফিস্টুলা করা হাতে ভারী ওজন (১০ পাউণ্ড বা ০৫ কেজি) বহন করবেন না।
৫. ফিস্টুলা করা হাতে ঘড়ি, ব্রেসলেট বা আঁটসাঁট/ টাইট কাপড় পরিধান না। হাতের চারপাশে স্ট্রাপ বা হ্যান্ডেল ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
৬. বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম বা ঘুমের সময় অপারেশন করা হাত শরীরের পাশে একটি বালিশের উপর আরামদায়ক ভাবে কিছুটা উচুতে রাখুন।
৭. ড্রেসিংঃ অপারেশনের পরদিন একবার এবং ০৫ দিন পর একবার ড্রেসিং করাতে হবে। অপারেশনের ড্রেসিং শুষ্ক রাখুন। ড্রেসিং ভিজে গেলে দ্রুত পরিবর্তন করুন।
৮. অপারেশনের ১০ দিন পর সেলাই কাটাতে হবে। ক্ষতস্থানে ব্যাক্ট্রোব্যান অয়েন্টমেন্ট ব্যবহার করতে হবেঃ ০৭-১০ দিন।
৯. হাতের ফিস্টুলা (AV fistula) স্পর্শ করার আগে এবং পরে পরিষ্কার পানি, সাবান বা জীবানুনাশক ব্যবহার করুন। এটি ফিস্টুলার সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করে।
১০. ডায়ালাইসিসের আগে এন্টিব্যাক্টেরিয়াল সোপ বা সাবান দিয়ে ফিস্টুলার চারপাশের চামড়া ধুয়ে ফেলুন এবং পরিষ্কার ও শুষ্ক রাখুন।
১১. অপারেশন এর পরদিন থেকে আপনার ডাক্তারের নির্দেশাবলী অনুসারে রাবারের নরম বল এর সাহায্যে হাতের ব্যায়াম করুন। এটি ফিস্টুলাকে দ্রুত ম্যাচিউর হতে সাহায্য করে।
১২. আঘাত থেকে হাতের সুরক্ষার জন্য হাতে এলবো ব্যাগ ব্যবহার করুন।
১৩. অপারেশনের পর চিকিৎসক আপনাকে এন্টিবায়োটিক এবং ব্যথার ঔষধ দেবেন। সেগুলো নির্ধারিত ডোজে, সঠিক সময় পর্যন্ত সেবন করবেন।
সতর্কতাঃ অপারেশন এর পর কিছু অবস্থা রয়েছে, যা তৈরী হলে বা দেখা গেলে আপনাকে দ্রুত চিকিৎসক বা স্থানীয় হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে।
১. হাতের যেস্থানে রক্তনালীর সংযোগ ঘটিয়ে এই অপারেশন করা হয়, সেখানে রক্তের প্রবাহের কারনে কম্পন (থ্রিল) এবং শব্দের (ব্রুই) সৃষ্টি হয়। আপনার হাতের ফিস্টুলা ফাংসনিং বা কার্যকর আছে কিনা তা জেনে নিতে নিয়মিত প্রতিদিন একধিকবার শব্দ (ব্রুই) এবং কম্পন (থ্রিল) চেক করুন। শব্দ বা কম্পনের মাত্রা কমে গেলে বা বন্ধ হয়ে গেলে আপনার ডাক্তারকে দ্রুত অবহিত করুন।
২. ফিস্টুলার চারপাশে লাল হয়ে গেলে বা ফুলে গেলে।
৩. এভি ফিস্টুলা থেকে রক্তপাত হলে। সামান্য রক্ত বের হলে ভয়ের কিছু নেই। তবে অনেক বেশী ব্লিডিং হলে, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলে অপারেশনের স্থান পরিষ্কার শুকনো কাপড় দিয়ে শক্ত করে বেঁধে আপনার চিকিৎসক বা স্থানীয় হাসপাতালে যোগাযোগ করুন।
৪. ফিস্টুলার চারপাশের ত্বকে সংক্রমণের কোনো লক্ষণ দেখা গেলে, যেমন, লাল চামড়া, পানি, পুঁজ বা রক্ত, ফিস্টুলার চারপাশের চামড়ায় গরম অনুভূতি ইত্যাদি থাকলে।
৫. আপনার জ্বর হলে,
৬. আপনার ফিস্টুলা করা হাতের পালস বা নাড়ী স্বাভাবিকের চেয়ে ধীর, অথবা যদি আপনি একটি নাড়ি অনুভব করতে পারেন না।
৭. অপারেশন করা হাত ঠাণ্ডা, দুর্বল বা অনেক ফুলে গেলে।
মনে রাখবেন, ফিস্টুলা অপারেশন ছোট কিন্তু সূক্ষ্ম একটি কাজ। একটি ফিস্টুলা তৈরী করা যতটা কঠিন, এর চেয়েও বেশী কঠিন একে টিকিয়ে রাখা। আপনার ভাসকুলার অ্যাক্সেস বা ফিস্টুলাটি শুধুমাত্র ডায়ালাইসিসের জন্য ব্যবহার করুন। আপনার সচেতনতা এবং সঠিক যত্নই পারে ফিস্টুলাকে ডায়ালাইসিস এর উপযোগি করে গড়ে তুলতে।।