দালাল প্রবেশে বাধা নেই, সাংবাদিক প্রবেশ করলে সমস্যা

বেসরকারি হাসপাতাল আর রোগ পরীক্ষাগারের দালালে ছেয়ে গেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের চিকিৎসকরা কোনো রোগ পরীক্ষার পরামর্শ দিলে নানা প্রলোভনে তাদের নিজেদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে চায় দালালরা। হাসপাতালে সাংবাদিক ঢুকতে বাধা দেয়া কর্তৃপক্ষকে এসব দালালের প্রবেশ ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না কখনো।

হাসপাতালের নিরাপত্তায় ভেতরে মোতায়েন থাকে অস্ত্রধারী আনসার সদস্য। ভেতরে মোবাইল ফোন দিয়ে ছবি তুলতে গেলেও তারা তেড়ে আসে। সাংবাদিক পরিচয় পেলে দুর্ব্যবহার এক নিয়মিত ঘটনা। কখনো কখনো ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত আরও নানা ঘটনা।

এর মধ্যেই দালালরা রোগীকে লক্ষ্য করে তারে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে।

পরিচয় গোপন রেখে গত রবি ও সোমবার হাসপাতাল পরিদর্শন করে প্রতিটি ওয়ার্ডেই দালালদের রোগী ধরতে ছুটোছুটি করতে দেখা গেছে। তাদের সঙ্গে হাসপাতাল কর্মীদের সখ্যেরও  প্রমাণ পাওয়া গেছে।

দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতালে প্রয়োজনীয় প্রায় সব রোগ পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। সংকটাপন্ন রোগীকে প্রায়ই অভিজাত বেসরকারি হাসপাতাল থেকে পাঠানো হয় এখানে। তারপরও এখানকারই আবার একাধিক চিকিৎসককে রোগ পরীক্ষার পরামর্শ দিয়ে সুনির্দিষ্ট রোগ পরীক্ষাগারে যাওয়ার পরামর্শ দিতে দেখা গেছে।

এই হাসপাতালের পাশের ‘দ্য প্যাথলজি সেন্টার’-এর দালালদের দৌরাত্ম্যই সবচেয়ে বেশি দেখা গেল। নিমতলীর প্রধান সড়কের পাশে এই ক্লিনিকটির দালালদের দেখা গেছে প্রতিটি ওয়ার্ডেই। এই ক্লিনিকটির সঙ্গে ঢাকা মেডিকেলের বেশ কয়েকজন ডাক্তারের সখ্য রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ২১২ নম্বর ওয়ার্ডের ২৭ নম্বর শয্যায় ফরিদপুরের নগরকান্দা থেকে একজন রোগী আসা মাত্র কয়েকজন দালাল তাকে ঘিরে ধরে। দালালরা ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছিল, তারা স্বজনদের নানা ভয় দেখাচ্ছিল।

একজন দালাল বলল, ‘রোগীর অবস্থা তো ভালো না। এই মুহূর্তে তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিতে হবে, এখানে তা সম্ভব হবে না।’

অন্য একজন বললেন, ‘এই মুহূর্তে রক্ত লাগবে, ঢাকা মেডিকেলের টেস্ট রিপোর্ট পেতে কয়েক দিন লেগে যাবে। আমাদের দিয়া করান, আধা ঘণ্টার মধ্যে সব পেয়ে যাবেন।’

এই পর্যায়ে এসে ঢাকা মেডিকেলের একজন চিকিৎসক রোগীর স্বজনদের জরুরি কিছু পরীক্ষা করাতে বললেন। কোথায় এটা করতে হবে সেটাও বলে দিলেন তিনি। বললেন, সেই দ্য প্যাথলজি সেন্টারের নাম। তিনিই এক দালালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আর দালাল হাসপাতালের ভেতরেই প্রকাশ্যে রোগ পরীক্ষার জন্য তিন হাজার টাকা নিলেন।

কেবল একজন রোগী নয়, আরও অনেকের সঙ্গেই এমন করতে দেখা গেল দালালদের।

রক্ত কেনাবেচা

মেডিকেলের প্রতিটি ওয়ার্ডেই প্রকাশ্যে দালালদের রক্ত কেনাবেচার জন্য হাঁকডাক করতেও দেখা গেল। প্রতি ব্যাগ রক্তের দাম গ্রুপভেদে দেড় হাজার টাকা থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। রক্ত কার কাছ থেকে নিবেন সে বিষয়েও ডাক্তাররা দালাল ঠিক করে দিতে দেখা গেছে। কারো রক্তের প্রয়োজন হলে নির্দিষ্ট দালালের কাছে পাঠাতেও দেখা গেছে।

হাসপাতালটিতে রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ থেকে রক্তদান থেকে শুরু করে রক্ত হাতে পেতে বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। মূলত এই সুযোগটাই নিচ্ছে দালালরা।

দালালরা এসব রক্ত কোথা থেকে আনছে, কার রক্ত, রক্তের সঠিক ক্রস ম্যাচিং ও প্যাথলজি টেস্ট আছে কি না সেই বিষয়ে কোনো তথ্য দিচ্ছে না। কর্তব্যরত ডাক্তারও এসব বিষয়ে কোনো খোঁজ-খবর নিচ্ছে না। রক্ত পাওয়ামাত্র রোগীর শরীরে তা পুশ করা হচ্ছে।

ফরিদপুরের নগরকান্দা থেকে আসা ২১২ নম্বর ওয়ার্ডের ২৭ নম্বর শয্যার সেই রোগীর কাছে পরদিনের চিত্রটা আলাদা কিছু নয়। সেদিন একই চিকিৎসক রোগীর স্বজনদের বলেন, অপারেশনের জন্য দ্রুত রক্ত লাগবে। আরো কয়েকটি পরীক্ষাও করতে হবে। রক্তের জন্য প্রথম প্রয়োজন রক্তের গ্রুপিং করা।

রোগীর স্বজনের পক্ষ থেকে ডাক্তারের কাছে রক্তের গ্রুপিংয়ের পরীক্ষার কথা জানতে চাইলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে বলেন, ‘গ্রুপিং লাগবে না, রুবেলের (দ্য প্যাথলজি সেন্টারের দালাল) কাছে গেলে সব হয়ে যাবে। এরপর রোগীর স্বজনরা রুবেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার কাছ থেকে সাড়ে চার হাজার টাকায় তিন ব্যাগ রক্ত কেনেন।

কর্তৃপক্ষের অস্বীকার

হাসপাতালে দালালদের এসব তৎপরতার কিছুই স্বীকার করেন না ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক খাজা আবদুল গফুর। এসব অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করলে তিনি বলেন, ‘কোনো বেসরকারি কোম্পানির লোককে হাসপাতালে দেখলে আমরা তাকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে থাকি। আর আমাদের হাসপাতালে জরুরি রক্ত, মল-মূত্র পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে বাইরে কোনো প্রতিষ্ঠানের এখানে কাজ করার সুযোগ নেই।’

সংবাদ উৎস : ঢাকাটাইমস