ডায়াবেটিসের একটা বাংলা নাম আছে, বহুমুত্র। বিচ্ছিরি একটা নাম। রোগের উপসর্গ বহুমুত্র, রোগের নাম কেন উপসর্গের নামে হবে! আমি ডায়াবেটিসকে ডায়াবেটিসই বলি।
এই রোগটা ইউরোপের লোকদের কিন্তু ততটা নেই, যতটা আছে আমাদের, এই ভারতীয় উপমহাদেশের লোকদের। আমাদের অঞ্চলে মানুষ দুর্ভিক্ষে ভুগেছে অনেক। না খেয়ে থেকেছে দিনের পর দিন। আর যখনই খাদ্য জুটেছে, শরীর সেই খাদ্যগুলোকে ফ্যাট বানিয়ে দুঃসময়ের খাদ্য হিসেবে জমা করে রেখেছে, এই করে করে জিনটাই বদলে দিয়েছে। জিনে এখন ‘টাইপ টু ডায়াবেটিস’, ’ফ্যাটি লিভার’, আরও কত কী কে জানে।
ডায়াবেটিসের সঙ্গে জীবন কাটাতে কারও ভালো লাগার কথা নয়, আমারও লাগে না। ডায়াবেটিস জিনিসটা ভীষণ বিচ্ছিরি। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি এই রোগ। নানার ছিল। নানার মিষ্টি খাওয়া বারণ ছিল। কিন্তু নানা আমাদের বাড়িতে আসতো, খেতো, ঘুমোতো। ঘুম থেকে ওঠে নানা মিষ্টি খেতে চাইতো। মা লুকিয়ে লুকিয়ে স্বদেশি বাজারের শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে পানতোয়া আর ছানার জিলিপি এনে নানাকে খাওয়াতো। নানার অসুখ বাড়লে বাবা রাগ করতো। বলতো মা’ই নাকি নানার অসুখ বাড়ার জন্য দায়ী। নানা মিষ্টি ভালোবাসে, অথচ তাকে মিষ্টি খেতে দেওয়া হবে না — এই ব্যাপারটা আমার ভালো লাগতো না, খুব নিষ্ঠুর মনে হতো। একসময় বাবার নিজের হলো এই অসুখ। বাড়িতে কড়া নিয়ম করে দিল বাবা। তার পাতে যেন মিষ্টি বা মিষ্টি জাতীয় কিছুই না পড়ে। বাড়িতে আমাদের সবার জন্য বাবা মিষ্টি আনতো, কিন্তু নিজে খেতো না। বাবার রক্তচাপও বেশি ছিল। উচ্চ রক্তচাপ, তার ওপর ডায়াবেটিস। দুটো একসঙ্গে থাকা মানে যমের বাড়ির ওপর দিয়ে সকাল বিকেল যাতায়াত করা।
একসময় আমার মা’রও হলো ডায়াবেটিস। মা খুব মেনে চলতো। নিয়ম করে ওষুধ খাওয়া, ইনসুলিন দেওয়া— বেশ পারতো মা। কিন্তু মা’র ক্যানসার হয়ে গিয়ে বিপদ বাঁধালো। ক্যানসার না হলে ডায়াবেটিস মা’কে কাবু করতে পারতো না। ডায়াবেটিস থাকলে অন্য কোনও রোগের দিকে চোখ যায় না। মা’র যখন পেটে যন্ত্রণা হচ্ছিল, আমরা ভাবছিলাম ডায়াবেটিসের কারণে হয়তো কিডনি খারাপ হয়ে গেছে, একবারও ভাবিনি এ কোলন ক্যানসারের জন্য হচ্ছে।
বাবা মা দুজনেরই ডায়াবেটিস থাকলে ছেলেমেয়েদের ডায়াবেটিস ধরে। আমরা চার ভাই বোন। চারজনের মধ্যে তো দুজনের হবেই ডায়াবেটিস। প্রথমে বড়দার হলো। তার পর ছোটদার। আমি তো ভেবে নিয়েছি দু’জনের হয়ে গেছে, আর কারও হবে না। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই পেলাম বিপদ সংকেত। একই সময়ে আমার আর আমার ছোট বোনকে, আমাদের রক্ত-পরীক্ষার ফল দেখে, বিদেশের ডাক্তাররা বললেন, ডায়াবেটিসের নামের রোগটি আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। আমার এইচবিএওয়ানসি পাঁচ দশমিক এক। আমার বোনের ছয়। আমি স্টকহোমে, আমার বোন নিউইয়র্কে।
ডায়াবেটিস শব্দটা শুনে আমি এমনই ভয় পেয়ে গেলাম যে সেদিন থেকেই দু ‘বেলা হাঁটাহাঁটি, জিমে যাওয়া, ডায়েট কন্ট্রোল পুরোদমে শুরু করে দিলাম। যে খাবারে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম, সেসব ছাড়া অন্য কোনও খাবার একেবারেই খেতাম না। তিন মাসে ত্রিশ কিলো ওজন কমিয়ে ফেলাম। কিছুতেই চাইনি ডায়াবেটিস — এই ভয়ংকর রোগটি আমার শরীরে বাসা বাঁধুক। আমার পক্ষে এ অসম্ভব মেনে নেওয়া যে দিনে দু’বেলা আমার শরীরে সুঁই ফোটাবো। একে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে যা কিছু করার তাই করলাম।
হারভার্ড ইউনিভার্সিটিতে তখন আমি ফেলোশিপ করছি। লাউডন স্ট্রিটে আমার অ্যাপার্টমেন্ট। লাউডন থেকে প্রতিদিন কেনেডি স্কুলে হেঁটে যাই, বিকেলে সাঁতার কাটি। ওজন আশি কিলো থেকে নেমে পঞ্চাশ কিলো। এইচ বি এ ওয়ান সি কমে চার। উচ্চ রক্তচাপ ছিল, সেটি তো কবেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ওজন কমলে আর নিয়মিত শরীরচর্চা করলে যে কী সুফল পাওয়া যায়, তখনই হাতে নাতে প্রমাণ পেয়েছি। কিন্তু হারভার্ড থেকে কলকাতায় চলে আসার পর জীবন যাপন বদলে গেল। কলকাতায় পাকাপাকি ভাবে যখন থাকছিলাম, বাড়িতে কাজ করার লোক পেলাম, বাড়ির কাছেই পেলাম মাছের বাজার, এসব পেয়ে এমনই আরাম করতে শুরু করলাম আর এমনই খেতে শুরু করলাম যে পঞ্চাশ কিলো থেকে ফের আশি কিলোয় ফিরতে বেশি সময় নিইনি। ওজন বাড়লে যা হয়, ধীরে ধীরে সব বাড়তে লাগলো। রক্তচাপ, রক্তের চিনি।
ডাক্তাররা কখনও রোগী হিসেবে ভালো নয়। এ কথাটা আগে আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আমার বাবাকে আর নিজেকে দেখে বিশ্বাস করি। আমার বাবা খুব ভালো ডাক্তার ছিলো, বাবাও শেষ দিকে ডায়াবেটিস কন্ট্রোল করতো না। এর ফল কী হলো, কিডনি দুটো নষ্ট হয়ে গেল। মানুষ ডায়ালাইসিস করে করে অনেককাল বেঁচে থাকে। আমার বাবার সেই সুযোগটা হলো না। শুরুতেই সেপটিসেমিয়া হয়ে গেল। আমি ডাক্তার, কিন্তু আমিও রোগী হিসেবে যাচ্ছেতাই। অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েছি অনেক, কিন্তু কোর্স কমপ্লিট করেছি খুব কমই। রক্তের চিনি মাপার যন্ত্র ঘরে আছে, কিন্তু মাপতে ভয় হয়। ডায়াবেটিস আসছে আসবে – শোনার পরও অস্বীকার করতে চাই। মিষ্টি খাওয়া উচিত নয় জেনেও কে সি দাসের রসগোল্লা খেয়ে ফেলি, সেন মহাশয়ের সন্দেশ মুখে পুরি। সকাল বিকেল হাঁটা উচিত জেনেও আলসেমি করি। এ ভাবেই কাটছিল। ডাক্তার তখনও বলছেন না ওষুধ খেতে, তখনও দিচ্ছিলেন ডায়েট কন্ট্রোলের আর এক্সারসাইজের উপদেশ। বলছিলেন বর্ডারলাইন ডায়াবেটিস, কন্ট্রোল না করলে হুড়মুড়িয়ে এসে যাবে।
মাঝে মাঝে যে সিরিয়াস হইনি তা নয়। খারাপ জিন নিয়ে জন্মেছি। বেঁচে থাকতে চাইলে তো সিরিয়াসলিই চিকিৎসা করতে হবে নিজের। ট্রেড মিল কিনেছি, এক্সারসাইজ বাইক কিনেছি, বিকেলে পার্কে হাঁটছি– সবই করেছি। ডায়েটটাও যথাসম্ভব মেনে চলেছি। কিন্তু ভয়াবহ কাণ্ডটি ঘটলো তিন বছর আগে। ডেঙ্গু জ্বর ধরলো আমাকে। ফরটিস হাসপাতালে ছিলাম দশদিন। এই দশদিনে ডেঙ্গু আমার শান্ত সুবোধ ডায়াবেটিসকে বাড়িয়ে আকাশে তুললো। ডাক্তার অনুপ মিশ্র বলেছিলেন, ডেঙ্গু সেরে যাওয়ার পর রক্তের চিনিও স্বাভাবিক হয়ে আসবে। দু’সপ্তাহ অপেক্ষা করে দেখা হলো, না, চিনি আকাশ থেকে নামছে না। অতঃপর ওষুধ দিলেন ডাক্তার। ওষুধ হাতে নিয়ে সেদিন আমি শিশুর মতো কেঁদেছিলাম। ডায়াবেটিসের ওষুধ খেতে হচ্ছে মানে সত্যি সত্যি আমি এখন ডায়াবেটিস রোগী। শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিরি একটা রোগ আমাকে ধরলোই! বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না, কিন্তু বিশ্বাস আমাকে আলটিমেটলি করতে হলোই। যে রোগটিকে ছোটবেলা থেকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছি, সেই রোগটি আমাকে ছেড়ে দিল না। আমার বোনেরও হয়েছে ডায়াবেটিস। চার ভাই বোনের কেউই রেহাই পায়নি রোগটি থেকে।
এখন আমার রুটিনটা বলছি। সকালে ওঠে পরপর কয়েক কাপ গ্রিন চা খাই। নাস্তা ওটমিল, সঙ্গে কিছু ওয়াল নাট, আর কয়েক টুকরো আপেল। অথবা নয় শষ্যের মিশেল আটা দিয়ে বানানো দুটো পাতলা রুটি, একটুখানি সবজি। দুপুরে এক চামচ ব্রাউন চালের ভাত, অল্প অলিভ ওয়েলে রান্না করা অথবা সেদ্ধ করা মিনিমাম চার পাঁচ রকমের শাকসবজি। এক টুকরো মাছ, বাঙালি যেহেতু, মাছ ছাড়া খাওয়া সম্পূর্ণ হয়েছে বলে মনে হয় না। বিকেলে পেয়ারা, শসা, পেস্তাবাদাম, রোস্টেড ছোলা এরকম কিছু। রাতে ওই একই, দুপুরের মতোই। গ্রিন চা অবশ্য সারাদিনে অনেক বার খাওয়া হয়। সন্ধের দিকে জিমে চলে যাই, মিনিমাম এক ঘণ্টা ওখানে কাটে। যদিও ঘরে আমার এক্সারসাইজ বাইক আছে। কিন্তু জিমের বাইকে ফাঁকি দেওয়াটা কম হয়। আসলে ফাঁকি দিলে নিজেকেই ফাঁকি দেওয়া হয়।ডায়াবেটিসের জন্য দুটো ট্যাবলেট খেতে হয়। দুটোর একটি মেটফরমিন, আরেকটি ফরজিগা।ফরজিগা নতুন ট্যাবলেট। রক্তে জমা চিনি কিডনির ছাকনি দিয়ে বের করে দেয়। আপাতত ঠিক আছি। রুটিন সবসময় মেনে চলি না, মাঝে মাঝেই ভেঙে তছনছ করি। প্রাণের আরামের জন্য করতেই হয়। ইনসুলিন যত দেরিতে নেব, তত ভালো। ইনসুলিন ইনজেকশান এখনও দুঃস্বপ্নের মতো। স্বপ্ন দেখি প্যানক্রিয়াসের স্টেমসেল নেব, নতুন একটি প্যানক্রিয়াস গজাবে শরীরে।
কেন রক্তের চিনি কমিয়ে রাখার চেষ্টা করি। কারণ রক্তে চিনি বেশি থাকলে স্নায়ু নষ্ট হয়, কিডনি নষ্ট হয়, চোখ নষ্ট হয়, ত্বক নষ্ট হয়, হার্ট অ্যাটাক হয়, স্ট্রোক হয়, আরও যে কত কিছু হয়। পৃথিবীতে প্রতি কুড়ি সেকেন্ডে ডায়বেটিসের কারণে কারও না কারওর পা কেটে ফেলতে হচ্ছে। ইনফেকশন হলে রক্তে চিনি থাকার কারণে ইনফেকশন সারে না, গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়, অতঃপর পা কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। পায়ের পাতাটা দেখতে হয় প্রতিদিন, সব ঠিক আছে কি না। ওই পায়ের পাতাতিই ফাংগাস বা ব্যাকটেরিয়া বাসা বাঁধে। স্নায়ু নষ্ট হলে পায়ের পাতায় রক্ত চলাচলও নষ্ট হয়, সে কারণেই ফাংগাস বা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জেতা যায় না। রক্তের শ্বেত কণিকাই তো যুদ্ধগুলো করে।
ডায়াবেটিসকে অনেকে রোগ বলে মনে করে না, বলে রিস্ক ফ্যাক্টর। ডায়াবেটিস কন্ট্রোল না করলে নানা রোগ হওয়ার রিস্ক থাকে, সে কারণেই রিস্ক ফ্যাক্টর। অনেকে মনে করে মোটা লোকদের ডায়াবেটিস হয়, তা কিন্তু নয়, ওজন বেশি এমন অনেক মানুষ আছে যাদের ডায়াবেটিস নেই। জিনটা বড় জিনিস। পরিবারে ডায়াবেটিস থাকলে ডায়াবেটিস হয়। আমার যেটা।
তবে সত্যি বলতে কী, ডায়াবেটিস আছে, থাকবে, এটা মেনে নেওয়ার পর জীবন অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে। লিখছি, পড়ছি, ভাবছি, আডডা দিচ্ছি, প্রেম করছি, ঘুরছি, পৃথিবী দেখছি, বক্তৃতা করছি, পুরস্কার পাচ্ছি, আনন্দ করছি। ডায়াবেটিস যে শরীরে আছে, বেশিরভাগ সময় ভুলেই থাকি। ভুলে থাকাই ভালো। শুধু খাবার সময়গুলোয় আর বিকেলে বা সন্ধ্যেয় জিমে যাওয়ার সময়টায় মনে রাখলেই হলো।