আধুনিকতা হচ্ছে একটি ফাঁদ

follow-upnews
0 0
আধুনিকতা হচ্ছে একটি ফাঁদ। আমরা সবাই এই ফাঁদে পড়ে আছি। আমি অনেকবার ভেবেছি— সব ছেড়েছুড়ে গ্রামে ফিরে যাব কিনা। কিন্তু আমিও এই ফাঁদ থেকে বের হতে পারিনি। একটা সময় পরে চাইলেও বের হওয়া যায় না। তাছাড়া একজন ব্যক্তি মানুষ ফাঁক গলে কী করবে সেটি কোনো টেকসই সমাধান নয়। ওটা একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়, অনুকরণীয় কিছু নয়।
জীবন যদি হয় শুধু ঢালা-ভরার— বেশি আয়, বেশি ব্যয়ের এ জীবনের আদৌ কি কোনো মানে আছে? কেন আয় করছেন, কোথায় ব্যয় করছেন? বিনিময়ে কী পাচ্ছেন? কী পেতে চাচ্ছেন? কোনো উত্তর কি পান? পেতে চান?
জীবনটাকে একটা রেসে পরিণত করে দিয়েছে পুঁজিবাদ এবং উন্নয়নের এ গণতন্ত্র। কেউ মাসে এক লক্ষ টাকা আয় করে ভালো নেই, কেউ মাসে দশ হাজার টাকা আয় করে ভালো নেই। মানুষের সামনে একটার পর একটা চাহিদা সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যেগুলো ভালো থাকার জন্য, আনন্দে থাকার জন্য আদৌ প্রয়োজন নেই। বিপরীত মৌলিক চাহিদাগুলোকে দিনকে দিন করে তোলা হয়েছে ভেজালযুক্ত।
মানুষকে ভালো থাকতে, মানবিক থাকতে, আনন্দে থাকতে শেখানো হয়নি। মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছে ব্রান্ড, মানুষকে করে তোলা হয়েছে পণ্য। কেক কেটেও জন্মদিন পালন করা যায়, উদ্যাপন করাটা, আনন্দ করাটাই যদি মূল লক্ষ হয়, তাহলে তা কেকের পরিবর্তে কালাই রুটি দিয়েও করা যায়। কিন্তু আমাদের সামনে প্রয়োজনগুলো শুধু না, বিনোদনের বিষয়গুলোতেও ভয়ঙ্করভাবে ফিক্সড্ করে দেওয়া হচ্ছে, হয়েছে। সবকিছুর পিছনে, অন্তরালে একটি ব্যবসায়িক লক্ষ্য জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
একই অসুখ, একই অভাববোধে ভুগছে সবাই। একদিন বিনামূল্যে যা ছিল সকলের, পাঁচিল তুলে দিয়ে তা করে তোলা হয়েছে কতিপয়ের, সবকিছু হয়ে উঠেছে একটা পাল্লাপাল্লির বিষয়। উন্নয়নের নামে সবকিছু মানুষকে টাকার অংকে পেতে শেখানো হচ্ছে। ভয়ঙ্কর এ পশ্চিমা শিক্ষাকে আমরা সঠিক ভেবে নিয়েছি, সবকিছু আমরা প্রবৃদ্ধি দিয়ে মাপতে শিখেছি! পশ্চিমারা যেভাবে একটা পরিণত জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে, বিশ্বকে একটা ইউনিট ভাবলে সেটাকে কি কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায়?
মানুষের সামনে একটার পর একটা মূলো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। চাকরি পাও, তারপর প্রমোশন, তারপর গাড়ি পাও, কয়েক তলা বাড়ি করো, বাগান নেই তো কী হয়েছে! ছাদ বাগান করো। পাওয়ার অপেক্ষার শেষ নেই, ওদিকে জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আনন্দে কাটছে না একটি দিনও।
সন্তানরাও হয়ে উঠছে পিতামাতার স্টাটাসের বিষয়বস্ত, সন্তানদের শিক্ষা দিতে গিয়ে যান্ত্রিক বানানো হচ্ছে, শিক্ষার নামে মুখস্থ করানো হচ্ছে গাদাগাদা বিষয়বস্তু। প্রকৃত শিক্ষা কী, কেমন হওয়া উচিত— রাষ্ট্রও সেটি জানে না, বুঝে না বুঝে একটা কিছু চাপিয়ে দেয়, দিচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে অহেতুক দৌড়ের উপর আছে মানুষ। বিশেষ করে ঢাকা শহরের এই জীবন- কার জীবনটা ভালো আমাকে একটু বলেন। যার বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, সব আছে সে কি ভালো আছে?
আপনি যদি পুরো শহরটাকেই নষ্ট করে ফেলেন, তাহলে সেখানে বাড়ি করে আপনি ভালো থাকবেন কীভাবে? এ ধরনের গাড়ি বাড়িও তো একটা ফাঁদ, সুবিধা যা দেয়, এগুলো তার চেয়ে যন্ত্রণাই বেশি দেয়। গাড়ি জ্যামে আটকে থাকে, গাড়ি পার্ক করার জায়গা নেই, গাড়িতে ঘষা লাগলো কিনা, গাড়ি চুরি হলো কিনা, ড্রাইভার তেল চুরি করলো কিনা, ড্রাইভার ঠিকমতো আসলে কিনা— কত সমস্যা! বিপরীতে সবার জন্য সুন্দর একটি গমনাগমনের ব্যবস্থা থাকলেই কি আরও ভালো হত না? আপনার সন্তানটি যদি সবার সাথে আনন্দ করতে করতে স্কুলে যেতে পারে সেটিই কি ভালো না? সন্তানের মানসিক বিকাশের জন্য শারীরিক সুস্থতার জন্য, পিতা-মাতার জন্য, সবার জন্যই তো সেটি ভালো।
মানুষ এককভাবে খুবই অসহায়, খুবই। প্রয়োজন ছিল সবাই মিলে ভালো থাকতে চাওয়া। সেই জায়গা থেকে সরে যাওয়াটাই কাল হয়েছে। আবার মানুষকে বাঁচার জন্য, ভালো থাকার ওন্য একত্রিত হতে হবে, প্রতিযোগিতার জন্য নয়। প্রতিযোগিতা হতে পারে বিনোদনের, উন্নয়নের নয়। উন্নয়ন হতে হবে মানবিক, সামষ্টিক, প্রকৃতিবান্ধব এবং আত্মিক। এমন একটা দিন আবার আসবে যেদিন মানুষ প্রতিবেশীকে দেখিয়ে দেখিয়ে ভালো খাবারটা খেয়ে গর্ববোধ করবে না, অহংকারের মধ্যে বৃথা আনন্দ খুঁজবে না, কারণ, সেখানে আনন্দ আসলে নেই।
মানুষ একদিন নিশ্চয়ই বুঝবে যে, শহর বড় করতে করতে সেখানে তিনতলা রাস্তা বানানোর নাম উন্নয়ন নয়, এটা পুঁজিবাদের ফাঁদ; বরং প্রকৃতির কোলে, প্রকৃতির সাথে কীভাবে বাঁচা যায় সেই শিক্ষাটাই হবে উন্নয়নের প্রকৃত শিক্ষা। হাসপাতাল লাগবে, ভালো চিকিৎসা লাগবে, কিন্তু এসি রুম আমাদের মতো নাতিশিতোষ্ণ একটি দেশে কেন লাগবে? বাইরেটা দূষণীয় করে, ধুলোধুলিময় করে এসি রুমে সমাধান খোঁজার নাম উন্নয়ন নয়। এরকম উন্নয়নের নামে আমরা একটার পর একটা পরিবেশ এবং প্রতিবেশের উপাদান নষ্ট করে চলেছি।
কোন জিনিসটা আমরা ঠিক রেখেছি? আমরা খাদ্য নষ্ট করে ফেলেছি, আমরা বাসস্থান নষ্ট করে ফেলেছি, আমরা পানি-বায়ু নষ্ট করে ফেলেছি। বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতি যা আমাদের বিনা মূল্যে দিয়েছিল, তার অধিকাংশই আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। গ্রাম বাঁচিয়ে, প্রকৃতি বাঁচিয়ে ‘উন্নয়ন’ করা যায় না? অবশ্যই যায়। তাতে হয়ত আগ্রাসী ব্যবসা বাঁচে না। যতদিন না পৃথিবী আগ্রাসী মুনাফার এ কবল থেকে বের হতে না পারবে ততদিন তথাকথিত উন্নয়নের লাগাম টেনে ধরাও সম্ভব হবে না। পৃথিবীর রাজনীতি, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং কায়েমি স্বার্থবাদী চক্রের হাত থেকে মানুষ যতদিন না মুক্ত হচ্ছে ততদিন এই ধারা চলতেই থাকবে।
মানুষ বুঝতে পারেনি তা না, মানুষ বুঝতে পেরেছে যে, উচ্চ জনঘনত্বের, দূষণের শহরকেন্দ্রিক কৃত্রিম এ জীবনব্যবস্থা প্রকৃত জীবনব্যবস্থা নয়, তারপরও মানুষ এ ফাঁদ থেকে বের হতে পারছে না। মানুষ একটা বিষবৃত্তে আটকে গিয়েছে। আরও বেশি অর্থ উপার্জনের মধ্য দিয়ে মানুষ সমাধান খুঁজছে, কিন্তু সমাধান তাতে হচ্ছে না, এভাবে সমাধান হতে পারে না। কারণ, আপনার আরও বেশি অর্থ নিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ আপনার চারপাশেই পাতা আছে। কখনো উন্নত চিকিৎসার নামে, কখনো বিনোদনের নামে, কোনো না কোভাবে আপনার টাকা বেরিয়ে যাবে। একবার আয় করে জীবন ক্ষয়, আরেকবার ব্যয় করে জীবন ক্ষয়। ক্ষণস্থায়ী আমাদের এ জীবনটা শুধু ক্ষয়ই হচ্ছে। যেভাবেই হোক মানুষকে এখান থেকে বের হতে হবে, বের হওয়া প্রয়োজন।
Next Post

ধর্মাবমাননার অভিযোগে পাকিস্তানে শ্রীলঙ্কান কর্মকর্তাকে পুড়িয়ে হত্যা

শিয়ালকোটের পুলিশপ্রধান আরমাগান গোন্ডাল বার্তা সংস্থা এপিকে জানিয়েছেন, হত্যার আগে প্রিয়ান্থা কুমারার বিরুদ্ধে হজরত মুহম্মদের (স.) নামসংবলিত একটি পোস্টার অবমাননার অভিযোগ তুলেছিল শ্রমিকরা। কারখানার ভেতরেই নির্যাতনে হত্যার শিকার হন তিনি। পরে তার মরদেহ পুড়িয়ে দেয়া হয়। ইসলাম ধর্মের নবী হজরত মুহম্মদকে (স.) অবমাননার অভিযোগে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের শিয়ালকোটের এক কারখানার শ্রীলঙ্কান […]
Srilankan Killed In Pakistan