এরপর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কোভিডের নিয়মিত চিকিৎসাতেই আমি সুস্থ হয়েছি। যারা হাসপাতালে নিয়ম করে আমার কাছে ছিল— আমার স্ত্রী নুরুন্নাহার সুবর্ণা, বড় বোন তুলিকা রাণী দাস, ছোট বোন দেবপ্রিয়া দাস, ছোট ভাই শেখ দিদারুজ্জামান, এবং দাদা বাবু বিভাষ ভূষণ দাস মাঝে মাঝে গিয়েছেন। ছোট ভাই সজল বিশ্বাস দেখতে গিয়েছিলেন। আমি না চাইলেও বিকাশে টাকা পাঠিয়েছেন মৃত্যুঞ্জয়, ছোট ভাই কাইয়ুম, পিন্টু দা, রাজীব, সাজ্জাদ ভাই, সাগর দা, আমার মামা বলাই, খরচ করেছেন দাদা বাবু বিভাষ ভূষণ দাস। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল পর্যন্ত আমি বিশেষ কোনো অর্থকড়ি খরচ করিনি, করতে হয়নি। [কারও অবদান ভুলে গেলে ক্ষমা করবেন।]
তেরোতম দিনে আমি বাসায় চলে আসি। বাসায় এসে ইচ্ছে করছিল একটু পাখা মেলে উড়তে। ততক্ষণ পর্যন্ত আমি নেগেটিভ রিপোর্ট হাতে পাইনি। তাই কোয়ারেন্টানাইন মেনে চলছিলাম। শরীরে নানান ধরনের সমস্যা ছিল, শ্বা:স নিতে কষ্ট হচ্ছিল, কোনো খাবার হজম হচ্ছিল না। হার্টবিট এবং ব্লাড প্রেসার দুটোই অনেক বেশি থাকত। দুই দিন পর— অথাৎ পনেরো দিনের মাথায় আমি কোভিড নেগেটিভ হই। এর মধ্যেই একবার ফরাজি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আবার দিনে দিনে ফেরৎ এসেছে। সম্ভবত সতেরো কি ঊনিশ তম দিনে গিয়ে একটা বড় সমস্যা হয়।
আমি রিক্সায় একটু ঘুরতে নিচে নেমেছি। ঈশপ এবং ঈশপের মা-ও সাথে। ওদের নিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরার পর ওদের রিক্সায় করে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে আমি ওষুধ কিনতে যাই। হঠাৎ গ্যাস জমে পেট ফুলে উঠেছে, শ্বা:স নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি একটা অমিনিক্স পাউডার কিনে গুলে খাই। খেয়ে একটা ইফতারের দোকানের সামনে যাই— ভাবছিলাম ওদের জন্য কিছু ভাজা-পোড়া খাবার কিনে নিয়ে উপরে উঠব। হঠাৎ করে আমার মাথা ঘুরে আসে, দুই হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি হাত দুটো অনেক লাল হয়ে গেছে। সারা শরীর কাঁপছে। সমস্যা বুঝতে পেরে একটা রিক্সায় কোনোমতে উঠে দু’শো মিটার দূরত্বে ফরাজি হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে গিয়ে বেডে শুয়ে পড়ি। কর্তব্যরতম চিকিৎসক প্রেসার মেপে দেখেন প্রেসার ১১০/১৬০, হার্টবিট ১৪০। শরীর কাঁপছে, হাত-পা-পিঠ জ্বলে যাচ্ছে। ঈশপের মা-কে ডাকা হলো। গার্ডিয়ান কেউ না আসা পর্যন্ত এ ধরনের কাউকে ওরা ডিল করতে চায় না। আমি যতই বলি ওষুধ দিতে, ওরা বলে কাউকে লাগবে। বাসা কাছে হলেও ঈশপের মায়ের আসতে অনেক সময় লেগে গেল। উচিৎ ছিল ঈশপকে পাশের বাসায় রেখে আসা, কিন্তু মূলত ঈশপকে নিয়ে আসতে গিয়ে ও দেরি করেছে। আমি চোখ বুঝে শুয়ে আছি। সত্যি বলতে আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এরকম প্রস্তুতি মনে মনে আমি কোভিডকালীন তিনবার নিয়েছি। কোনোবারই আমার কাউকে দেখতে ইচ্ছে করেনি, বা কিছুই ইচ্ছে করেনি— একটা মহাশূন্যের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছি। অনুভূতিটা আমাকে খুব বেশি কষ্টও দেয়নি। মৃত্যুটা আমার কাছে এখন কিছুই না, শুধু একটা ভ্রমণের শেষ মাত্র। এক ঘণ্টা পরে হার্টবিট একটু কমেছে, প্রেসার তখনও বেশি। ওখান থেকে আবার ভর্তি দেওয়া হলো। এবার বনশ্রীতে অবস্থিত বেসরকারি হাসপাতাল ফরাজিতে ভর্তি হলাম।
এবার খরচের ধাক্কাটা অনেক বেশি। সোহরাওয়ার্দীতে ফ্রি অক্সিজেন টেনেছি। এখানে প্রতিদিন অক্সিজেনের বিলই উঠতেছে দুই হাজার টাকা। কেবিন ভাড়া, সবমিলিয়ে দিনে দশ হাজারের কাছাকাছি। এবার চাপটা আমার নিজের ওপরেই পড়েছে। ঈশপের মা-কে যেহেতু একটু রেস্ট দেওয়া দরকার, তাই একটা ভালো কেবিনই নিতে হলো। ফলে সাতদিনে বিল উঠে গেল সত্তর হাজার সামথিং। ভিআইপি কেবিন, ফলে নার্সদের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে থাকা সম্ভব ছিল। কিন্তু ঈশপের মায়ের শরীরে না কুলালেও তা হতে দেবে না। পাহারা দেবার জন্য হলেও থাকা চাই। তাহলে ওর কি ধারণা যে, বিছানায় পড়ে গেলেও কেউ আমার প্রেমে পড়বে? বাস্তবতা মোটেও তা নয়, আমার প্রেমে কেউ কোনোদিন পড়েনি, অথচ ও মনে করে— নারী মাত্রই আমার প্রেমে পড়ে! এটা বড় কথা নয়— সুবর্ণা এমনিতেই গত কয়েক বছর ধরে একটা অটিস্টিক শিশু নিয়ে নাস্তানাবুদ, তারওপর গত আঠারো বিশ দিন ধরে আমাকে নিয়ে পড়ে গেছে একরকম “না করলে কেমন হয়” টাইপ দায়িত্বের মধ্যে। স্ত্রী বলে কথা!
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী রাজীব, আজম ভাই এবং ছোট ভাই সজল কিছু টাকা পাঠালো। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী শান্ত সস্ত্রীক দেখতে এসে সাহস জোগালো, ফল কেনার জন্য টাকাও দিলো। নিজের এমার্জেন্সি কয়টা টাকা ছিল আগে পরে মিলিয়ে সব শেষ। এ ধরনের সময়ে কেউ আসলে সত্যিই সাহস বাড়ে। কেউ সেনসিবল আচরণ করলে অবশ্যই সেটি মনে রাখার মতো। ভর্তি এর পরেও হতে হয়েছে। সে কাহিনী আগামী কিস্তিতে বলছি।