পানি বিশুদ্ধকরণ ফিল্টার কেনার ক্ষেত্রে সতর্কতা জরুরী

পানি পরিশোধন
শহর নগর সবখানেই এখন বিশুদ্ধ পানির ভয়াবহ অভাব। পানি আছে, কিন্তু তা বিশুদ্ধ নয়। The Rime of the Ancient Mariner এ Samuel Taylor Coleridge লিখেছেন,

“Water, water, everywhere,
And all the boards did shrink;
Water, water, everywhere,
Nor any drop to drink.”

লেখক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, অথাৎ সাগরের পানি যে পানযোগ্য নয় সেটি বোঝাতে লিখলেও, লাইনটির অর্থ বিস্তৃত। এই ঢাকা শহরের কথাই ধরুণ না, কল খুললেই চড়চড় করে পানি পড়তে শুরু করবে, কিন্তু আপনি তা খেতে পারবেন না, আপনাকে পানি ফুটিয়ে খেতে হবে। এতে শুধু কাজ বাড়ে না, খরচও বাড়ে, অবশ্য খরচটা এখন পর্যন্ত অন্তত ঢাকা শহরে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে যায়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সম্পদ তো আসলে আপনার-আমারই সম্পদ, তার মানে ভুরি ভুরি গ্যাস পুড়িয়ে পানি ফুটালে দিনশেষে তাতে আমাদের ক্ষতিই হয়।

সমস্যা হচ্ছে, ফুটিয়েও পানি নিরাপদ হচ্ছে না, থেকে যাচ্ছে তাতে বিভিন্ন ধরনের পার্টিকেল। দেখা দিচ্ছে যান্ত্রিকভাবে পানি পরিশুদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা। 

এ সুযোগে বাজারে এসেছে বিভিন্ন ধরনের পানি পরিশোধন যন্ত্র। বিভিন্ন প্রকার থাকায় কোনটি কেমন, কীভাবে কাজ করে –সে বিষয়ে ধারণা প্রয়োজন হয়, না হলে সঠিক যন্ত্রটি কেনা যায় না।

পানি বিশুদ্ধকরণের ক্ষেত্রে ‘বিপরীত অভিস্রবণ’ পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে যে ফিল্টারগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলো একটু বেশি দাম এবং জটিল প্রকৃতির হয়। এগুলোর দাম ব্রান্ডভেদে ১২হাজার টাকা থেকে ২৫হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। সাধারণত বাসাবাড়িতে এগুলো ব্যবহার করা হয় না।
 
পানি ফিল্টারের আদী পদ্ধতিটি অারো পরিশীলিতভাবে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ব্রান্ডের ফিল্টার বাজারে ছাড়া হয়েছে, এর মধ্যে চায়না হতেই বেশিরভাগ এগুলো আমদানী হয়ে থাকে। পানির একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে, অদ্রবণীয় বন্তুগুলোকে আলাদা করে দেয়া। কোনো মাধ্যম দিয়ে যাওয়ার সময় পানি এটি করে থাকে। এ ধরনের ফিল্টারগুলোতে পানির সে গুণটিই মূলত কাজে লাগানো হয়।
এ ধরনের ফিল্টার পানিতে থাকা রোগ জীবানু মারতে পারে না যদি না তাতে আল্ট্রা ফিলট্রেশন পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয়। চায়না থেকে আমদানীকৃত যেসব ফিল্টার রয়েছে বাজারে, সেগুলোতে ইউএফ মেম্রব্রেন থাকে না। তাই এ ফিল্টারগুলো পানি হতে অদ্রবণীয় পদার্থগুলো অনেকাংশে আলাদা করতে পারলেও ব্যকটেরিয়া ভাইরাস পৃথক করতে পারে না, এ ধরনের জীবানুগুলোকে মারতে পারে না।
তাই এসব ফিল্টারে অবশ্যই ফুটানো পানি ব্যবহার করতে হবে, তবে বিভিন্ন দোকানপাটে সেটি করা হয় না। চায়না হতে আসা বা দেশে তৈরি হওয়া এ ধরনের ফিল্টার মানভেদে পাওয়া যায় ৬০০টাকা থেকে ১২০০টাকার মধ্যে।
যেকোনো ওয়াটার ফিল্টারের ফিল্টার পেপারটা তিন চার মাসের বেশি ব্যবহার করা উচিৎ নয়। উন্নত প্রযুক্তির ফিল্টারগুলোর কার্টিজ ফিল্টার পরিবর্তন করা লাগে বছরে অন্তত একবার।

এছাড়া এক ধরনের ফিল্টার বাজারে রয়েছে, যেটি সাধারণ ফিলট্রেশনের পাশাপাশি কেমিকেলও ব্যবহার করে। যেমন, পিওর ইট

‘পিওর ইট’ শুধু যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফিল্টার করে না, এটাতে রয়েছে একটি হ্যালোজেন ট্যাবলেট দেওয়া, যেটি মূলত পানির জীবানু মারে। এটির কল্যাণেই বিজ্ঞাপনে তারা বলে থাকে যে ‘পিওর ইট’ ফুটানো পানির চেয়েও নিরাপদ।

বিষয়টি নতুন কিছু নয়, হ্যালোজেন গ্রুপের (ক্লোরিন, ফ্লোরিন, ব্রোমিন, আয়োডিন) যেকোনো মৌল পানিতে যোগ করলে পানি বিশুদ্ধ হয়। বন্যা দুর্গত এলাকায় ত্রাণের সাথে এজন্য হ্যালোজেন ট্যাবলেট নিয়ে যাওয়া হয়।

‘পিওর ইট’ এই জিনিসটাকেই বলছে ‘জার্মকিল প্রসেসর’। এটি যেহেতু একটি কেমিকেল উপাদান এবং তা ক্রমাগতভাবে পানির সাথে মিশে জীবানু হত্যা করছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই এটি ফুরিয়ে যাবে। এটি ফুরিয়ে গেলে ফিল্টারটি অটো ফিল্টার করা বন্ধ করে দেবে।

ফুরিয়ে গেছে কিনা সেটি বোঝা যাবে ছবিতে চিহ্নিত বড় ফুটোটি দেখে। সেটি পুরোপুরি লাল হয়ে যাওয়ার মানে হচ্ছে ভেতরের ক্লোরিন ট্যাবলেটটি শেষ হয়ে গিয়েছে।

পিওর ইট

তবে জিনিসটি আবার কিনতে পাওয়া যায়। এটি আছে দুই প্রকার– ছোটটি ১৫০০লিটার পানি ফিল্টার করতে পারে, এবং বড়টি ফিল্টার করতে পারে ৩০০০লিটার পানি।

পুনরায় কিনতে গেলে ছোটটি কিনতে লাগবে ৭০০টাকা এবং বড়টি কিনতে লাগে ১২০০ টাকা। সাথে কার্বন ট্রাপটিও নিতে হয়, অর্থাৎ শুধু এটি কেনা যায় না।

ইউনিলিভার
ক্লোরিন শেষ হয়ে গেলে এই সেটটি আবার কিনতে হয়।

ফলে শুধু জার্মকিল প্রসেসরটি বা হ্যালোজেন ট্যাবলেটের ঐ খাপটি ইউনিলিভারের নামে নকলও বেরিয়েছে, যেটির গায়ে দাম লেখা আছে ৬০০টাকা। তবে সেটি নকল। ইউনিলিভার এটি বের করে না।

ফিল্টারটিও মূলত আসে ভারত থেকে। অর্থাৎ পিওর ইট ফিল্টারের কারখানা বাংলাদেশে নেই। ঐ নকল পণ্যটিও ভারত থেকে এসেছে বলে জানা গিয়েছে।

এবার আসা যাক পিওর ইটের পানি ফিল্টার করার পদ্ধতি বিষয়ে। কোম্পানি বলছে চার ধাপে তাদের ফিল্টারটি পানি বিশুদ্ধ করে থাকে। 

জেনে নেয়া যাক, কীভাবে সেটি আসলে যন্ত্রটি  করে। শুরুতে যে ছাঁকনিটি রয়েছে সেটিকে তারা বলছে ‘মাইক্রোফাইবার ফিল্টার’ যেটি দৃশ্যমান ময়লাগুলো ছেকে রেখে দেয়।

এরপর পানি পৌঁছায় এক্টিভেটেড কার্বন ফিল্টারে, যেটি সকল ক্ষতিকর জীবানু মেরে ফেলে বলে বলা হয়ে থাকে। এরপর পানি যেতে হয় জার্মকিল প্রসেসরের মধ্য দিয়ে, যেখানে ক্রমাগতভাবে কেমিকেলটি নিঃসরিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এই চেম্বারে সকল ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস মারা পড়ে।

এরপর এটি পৌঁছায় ‘ক্যালারিফায়ার’ নামক একটি ডিভাইসের গায়, যেটি ক্লোরিন হজম করে রাখে এবং পানিতে কোনো গন্ধ থাকলে সেটিও এটির মাধ্যমে মুক্ত হয় বলে দাবি করে থাকে ইউনিলিভার। সবশেষে স্বচ্ছ পানি এসে জমা হয় নিচের সংগ্রহশালায়, যেখান থেকে ট্যাপের মাধ্যমে পানি ঢেলে খাওয়া হয়।

আসা যাক খরচখরচা বিষয়ে। ইউনিলিভারের ফিল্টারের মাধ্যমে যদি আপনি পানি বিশুদ্ধ করে খেতে চান, তাহলে আপনার প্রাথমিক বিনিয়োগ করতে হবে ২৯৯০টাকা। তবে কিছুদিন পরপর খরচ আছে।

ধরা যাক, আপনার পরিবারে প্রতিদিন পানি লাগে ১০লিটার। তাহলে ১৫০০লিটার পানিতে আপনার যাবে ১৫০দিন। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে বছরে অন্তত দুইবার আপনাকে জার্মকিল কিটটি কিনতে হবে, যে বাবদ খরচ হবে ১৪০০টাকা।

উপরের মাইক্রো ফাইবার ছাঁকনিটিও কিছুদিন পরপর পরিবর্তন করতে হয়, ওটির দাম ২০০টাকা। বছরের ৪বার পরিবর্তন করলে ছাঁকনি বাবদ খরচ হবে আরও ৮০০টাকা। তাহলে মোট খরচ হবে ২২০০টাকা। তাই ফিল্টারটি কেনার সময় খরচের এই হিসেবটিও মাথায় রাখতে হবে।

কেন্ট

বাজারে পানির ফিল্টারের একটি জনপ্রিয় নাম হচ্ছে ‘কেন্ট’। কেন্ট কয়েক ধরনের পানির ফিল্টার বাজারজাত করে থাকে। এর মধ্যে কেন্ট গোল্ড দামে সাশ্রয়ী বলে এটিই সাধারণ বাসাবাড়িতে মানুষ ব্যবহার করে থাকে। অন্যগুলো হচ্ছে, কেন্ট সুপ্রিম, কেন্ট পার্ক, কেন্ট পার্ল এরকম। কেন্ট গোল্ড UF (ultra filtration) পদ্ধতিতে পানি ফিল্টার করে থাকে। এটি তিন ধাপে পানি ফিল্টার করে থাকে। 

kent gold

প্রথমে পানি যায় সেডিমেন্ট ফিল্টারের মধ্য দিয়ে যেখানে অদ্রবণীয় উপাদানগুলো আটকা পড়ে। এরপর পানি যায় কার্বন ব্লক ফিল্টারের মধ্য দিয়ে, এখানে আরো সক্রিয়ভাবে পানি ছাঁকন হয়, এমনকি পানিতে কোনো কেমিকেল (যেমন, ক্লোরিন) থাকলে তাও আটকা পড়ে। এবং এ ধাপে পানি দুর্গন্ধমুক্ত হয়। ফিল্টারটির শেষ ধাপটি হচ্ছে ইউএফ মেমব্রেন। এখানে পানি জীবানুমুক্ত হয় বলে বলা হচ্ছে।

বর্তমানে বাজারে কেন্ট গোল্ড ফিল্টারটির দাম ৩৫০০টাকা। এবং এটি বাংলাদেশে অনলাইনে সরবরাহ করছে ‘বাংলাচ্যানেল’খোলা বাজারেও ফিল্টারটি পাওয়া যায় বিভিন্ন দোকানে। দাম একই।
সাধরণত এক বছর পর পর ফিল্টারটির যন্ত্রাংশগুলো পরিবর্তন করা লাগে। তবে এটি নির্ভর করে যে পানিটি পরিশোধিত করা হচ্ছে সেটির মান এবং প্রতিদিন কী পরিমাণ পানি ফিল্টার করা হচ্ছে তার ওপর। কেন্টের পুরো সেটটি পুনরায় কিনতে লাগে ১২০০টাকা। এটিও এদেশে ‘বাংলাচ্যানেল’ সরবরাহ করে থাকে।
https://youtu.be/Oq0UnZrdkbQ