যিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে চরকায় সুতা কাটেন, পাকিস্তানের স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করেন, পাকিস্তানের দেওয়া ‘তঘমা-ই- ইমতিয়াজ’ পুরস্কার ঘৃণাভরে বর্জন করেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে শহীদজননী জাহানারা ইমামের সতীর্থ হয়ে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলেন-সেই সংগ্রামী মহীয়সীর নাম বেগম সুফিয়া কামাল। কবি, লেখিকা, বুদ্ধিজীবী ও নারীমুক্তি আন্দোলনের পুরোধা বেগম সুফিয়া কামালের সাহসী ভূমিকা, যা ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে।
১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত হিন্দুসঙ্গীত, ইসলামের পবিত্র ভূমি পাকিস্তানে তা চলবে না। তথ্যমন্ত্রীর পক্ষে সমর্থন জানিয়ে আবুল মনসুর আহমেদ (ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের পিতা), অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ ও বেনজীর আহমেদসহ চল্লিশ জন পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী বিবৃতি দেন। তৎকালীন বাঙালি সুধিমহলে এসব বুদ্ধিজীবীরা ‘চল্লিশ চোর’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
সেদিন এই চল্লিশ চোরের বিবৃতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন বেগম সুফিয় কামাল, ড. কুদরত-ই-খোদা, কাজী মোতাহার হোসেন, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শামছুর রাহমান ও সিকান্দার আবু জাফরসহ মোট ১৯ জন বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিকপাল।
১৯৬১ সাল। বিশ্বব্যাপী মহাসমারোহে পালিত হচ্ছিল রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী। কিন্তু পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল সরকার রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। কিন্তু সেদিন পাকিস্তান সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে এগিয়ে আসেন গোবিন্দ চন্দ্র দেব (শহীদ বুদ্ধিজীবী), মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (শহীদ বুদ্ধিজীবী) ও বেগম সুফিয়া কামাল প্রমুখ।
স্বৈরশাসকও হাত পা গুটিয়ে বসে ছিল না। সরকারে উর্দুভাষী চীফ সেক্রেটারি জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা “বেগম সুফিয়া কামালকে ডেকে পাঠিয়ে কড়া সুরে উর্দুতে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘ইয়ে সব কেয়া হো রাহা? নরম স্বভাবের সুফিয়া কামাল নম্রভাবে শক্ত করে জানিয়েছিলেন যে, সারা বিশ্বে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যা হচ্ছে এ-ও তাই।” (অধ্যাপিকা সানজীদা খাতুন, জাহানারা ইমাম স্বারক বক্তৃতা, ২৬ জুন ২০১৫) জনগণের মনোভাব বুঝতে পেরে ও বেগম সুফিয়া কামালের দৃঢ়চেতা মানসিকতার কাছে সরকার হার মানে। পরে নির্বিঘ্নে জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়।
লৌহমানব আইয়ুব খান গভর্নর্স হাউসে (বর্তমান বঙ্গভবন) লেখকদের এক সমাবেশে বাঙালিদের তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন, ‘বাঙালি তো পশুর চেয়ে অধিক নয়। ছোটখাটো, চোখে পড়ে না, সুফিয়া কামাল বলে উঠলেন আপনি তো তাহলে পশুরাজ (হাওয়ানোকে বাদশা)। আইয়ুব রেগে গেলেন, সমাবেশ গেল ভেঙ্গে।’ (ওয়াহিদুল হক, ছায়ানট আরাম্ভ কথা)
সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে এবং মুক্তবুদ্ধির পক্ষে তিনি আজীবন লড়াই করেছেন। তার সংগ্রামী জীবন এখনও বাঙালি জাতিকে পথ দেখায়। তার ১০৯তম জন্মশতবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা।
আলী আকবর টাবী
লেখক ও গবেষক