Headlines

যে জীবন আমার নয়

নাজনিন মায়া
 
২০১১ সালে আমি প্রথম সরকারি চাকরিতে যোগদান করি। চাকরিটা একটু প্রতিক্ষিতই ছিল। আমাদের দেশে স্বল্প কিংবা বেশী বেতনের সরকারি চাকরিই সবার প্রতিক্ষিত। আমিও একটু বেশিই চেয়ে ফেলেছিলাম।
২০০৯ সালে অনেকটা বাধ্য হয়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে চাকরি নামক যুদ্ধে আমাকে অপরিণত সৈন্য হিসেবে নাম লেখাতে হয়। এসবের মূল হোতা আমার তিন বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা কোর্স।
পড়া শেষ হওয়ার অনেক আগেই চরম বোকামি হিসেবে পছন্দের মানুষকে বিয়ে করে ফেলা। আমি হয়ত বোকা ছিলাম, পরিবারের মানুষ না, তবুও এবার তাদের ইচ্ছাতেই বাল্য বিবাহ ব্যাপারটার পুনরাবৃত্তি ঘটে গেল।
সেই মানুষটার করার কিছু ছিল না, তাই খুব স্বল্প বেতনের বেসরকারি চাকরিটা অনেক অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে করতে হল। কী যে নির্মম ছিল দিনগুলো!
সংসার গুছিয়ে অফিস করতে হত, বেশিরভাগ মেয়েদেরকেই তা করতে হয় কিন্তু সেগুলো করারও তো একটা সময় লাগে। আমার জীবনে যে সমস্ত ঘটনাগুলো ঘটেছে তার সবই যেন সময়ের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আমি একটু সরল বুদ্ধির মানুষ, এজন্য সমস্যাগুলো বেশী জটিল।
আমার মত নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো আমাদের শিক্ষা ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে খুব অন্তরায় সৃষ্টি করে। কখনো প্রবল উৎসাহ নিয়ে বলে, “পড়, অনেক বড় হতে হবে” পরক্ষণেই চিন্তা করে মেয়েকে পাত্রস্থ করার।
আমার বেলাতে মনে হয় মাতৃগর্ভে আসার পর থেকেই ওই ভাবনাটা শুরু হয়েছিল। ছেলে হলে সব মাফ, মেয়ে হলে অবশ্যেই সেই আদীম বধ্যমূলীয় ভাবনা।
জন্ম নিলাম! মানুষ বটে তবে সে মানুষের শারীরিক গঠন মেয়ের। মা খুশি হলেন কিনা জানি না তবে আব্বা তখন থেকে আজ অব্দিও আমাকে নিয়ে খুশি নয়।
ছোট থেকেই পড়ালেখা তে বেশ ভালো ছিলাম, যেখানেই গেছি উজ্জ্বলতার স্বাক্ষর রেখেছি। মাধ্যমিক পরীক্ষায় মধ্যম মানের ফলাফল করেছিলাম। তখন না ছিল নিজের প্রচেষ্টা না ছিল পরিবারের যথেষ্ট সহযোগিতা। গ্রামের স্কুল, গ্রামের মেয়ে আর গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থা। এখানে ধারণাটা এমন যে তুমি যদি মেয়ে হও তবে যত ভাল পড়ালেখাই করো না কেন তোমার একমাত্র সামনের গন্তব্য শ্বশুরবাড়ী, আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হল না।
বয়স তখন ১৬। মজার কথা হলো ঐ বয়সে আমার ওড়নাই পরা লাগতো না আর তখনই আমার পরিবারের মধ্যে ‘চৈতন্য’ আসল– আমি বাল্য বিবাহের শিকার হলাম।
অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে অতঃপর খুব কষ্টে কলেজে ভর্তি হলাম। অনেক সংগ্রামের পর ঐ সম্পর্কটা থেকে মুক্তি পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম! কলেজে গিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হল। পড়ালেখার প্রকৃত রূপ আমাকে গ্রাস করল, আমি খুব ভাল ফলাফল করতে শুরু করলাম।
নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধুরা সবই আমাকে আমার অতীত থেকে মুক্তি দিতে শুরু করল। যতক্ষণ কলেজে থাকতাম পড়ালেখার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে খুব আনন্দে কাটত সময়টুকু।
কিন্তু বাড়ী ফিরতেই মায়ের সার্বক্ষণিক জ্ঞানদান আর আব্বার অকথ্য ভাষার সাথে শারীরিক নির্যাতন প্রত্যাহিক সঙ্গীতে পরিণত হল। একমাত্র কারণ, আমার অপরিণত বয়সে তাদের নেয়া সিদ্ধান্তের বাইরে এসে সম্পর্কটা থেকে নিজেকে মুক্ত করা। -চলবে