মারা যাওয়া ব্যক্তি শিরোণাম হয়নি, শিরোণামে এসেছে শুধু বেঁচে যাওয়া মডেলের নাম

২৯ জুন ২০১৫ তারিখে ভোরে কুমিল্লা বিশ্বরোডে নোভার গাড়িটি দুর্ঘটনায় পড়ে। দুর্ঘটনায় চালক মারা যায় এবং নোভা, নোভার স্বামী নাট্যনির্মাতা ও চিত্রগ্রাহক রায়হান খান, বড় বোন অন্তরা ফিরোজ ও ভাগনি প্রত্যাশা আহত হয়।
সংবাদটি পরিবেশন করতে গিয়ে প্রথম আলো শিরোণাম করেছে-
“অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচলেন নোভা”
প্রথম আলোর সংবাদটির লিংক :
http://www.prothom-alo.com/entertainment/article/565366
সংবাদের সাথে নিম্নের ছবিটি তারা দেয়।

p alo


অর্থাৎ দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার ব্যাপারটি খবর হয়নি, খবর হয়েছে এবং ফেসবুকে প্রথম অালোর পেজে প্রচারিত হয়েছে যে বেঁচে গিয়েছে তাকে নিয়ে । কারণ, পাবলিক চালকের ঐ সহকারীকে চেনে না, এবং অনুমিতভাবেই তাকে নিয়ে আগ্রহী হবে না, কিন্তু ‘আগ্রহ’ আছে জনৈক মডেল নোভাকে নিয়ে। তাছাড়া সংবাদ পরিবেষণকে উপলক্ষ্য করে মডেলের একটি আকর্ষণীয় ছবি দেওয়াও কিন্তু এখানে সম্ভব হয়েছে। শিরোণামটি নিয়ে যেমন সচেতন পাঠাকের অাপত্তি রয়েছে, আপত্তি রয়েছে ভেতরের বর্ণনা নিয়েও।
আরেকটি অসংগতি প্রথম আলোর ঐ সংবাদটিতে রয়েছে। সেখানো দেখানো হচ্ছে যে, সংবাদটি আপডেট করা হয়েছে ২৯ জুন রাত ২টা ৩৪ মিনিটে, কিন্তু সংবাদের বর্ণনায় তারা বলছে, দুর্ঘটনাটি ঘটেছে ভোর চারটার দিকে।

অন্যান্য পত্রিকায়ও খবরটি এসেছিল। প্রথম আলোর মত ‘শীর্ষ’ ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারও একইভাবে সংবাদটি উপাস্থাপন করেছে। ২৯ জুন ২০১৫ তারিখে সংগঠিত ঐ দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে দ্যা ডেইলি স্টারের শিরোণাম ছিল :
“Nova in road accident”
চালক মারা যাওয়ার বিষয়টি সংবাদের র্বণনাতেও নেই!
সংবাদটির লিংক :
http://www.thedailystar.net/arts-entertainment/nova-road-accident-104788

আলোকিত বাংলাদেশ নামক আরেক দৈনিকে প্রথম অালোরই প্রতিধ্বনী যেন। তারা শিরোণাম করেছে-
“দুর্ঘটনায় অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন নোভা”
খবরের সাথে নোভার নিচের এই ছবিটি তারা ব্যবহার করা হয়েছে।

alokito bng
সংবাদটির লিংক :
http://www.alokitobangladesh.com/online/entertainment/2015/06/29/5559

সমকালের শিরোণাম ছিল :
“অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন নোভা ও রায়হান খান”
লিংক : http://www.samakal.net/2015/06/30/146551

তবে কয়েকটি পত্রিকা চালক নিহত হওয়ার বিষয়টি শিরোণামে এনেছে। যেমন, মানকণ্ঠ শিরোণাম করেছে-
“সড়ক দুর্ঘটনার কবলে অভিনেত্রী নোভা, চালক নিহত”

কিছু অনলাইন নিউজ সাইট বরং দায়িত্বশীল শিরোণাম করেছে। কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হল।
“দুর্ঘটনার শিকার নোভা দম্পতি চালক নিহত ”
লিংক : Click This Link

“অভিনেত্রী নোভা ও তাঁর স্বামী দুর্ঘটনায় আহত, নিহত গাড়ির চালক”
লিংক : http://www.ctgbarta24.com/2015/06/29/

“সড়ক দুর্ঘটনায় আহত নোভা, নিহত গাড়িচালক”
লিংক : http://onlinebangla.com.bd/post/8389

“সড়ক দুর্ঘটনার কবলে নোভা, চালক নিহত”
লিংক : http://www.jagonews24.com

শিরোণামটি কী হতে পারতো তা আমি একজন সাংবাদিকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। উনি আমাকে বললেন, সহজেই শিরোণামটিতে দায়িত্বশীল হওয়া যেত, এবং তাতে বাণিজ্যিক দিক একটুও খর্ব হত না। যেভাবে শিরোণাম হওয়া উচিৎ ছিল বলে উনি জানালেন, “দুর্ঘটনায় চালক নিহত, অভিনেত্রী নোভা অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছেন”
অথবা
“দুর্ঘটনায় অভিনেত্রী নোভা অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছেন, চালক নিহত”

চালক নিহত হওয়ার খবরটি কোন কোন পত্রিকা শিরোণামে উল্লখ করলেও, কোথাও চালকেও নাম পরিচয় নেই। সংবাদে স্বকীয়তা নেই, কয়েকটি সংবাদের পার্থক্য ছাড়া একটি পত্রিকা থেকে অপর একটি পত্রিকায় তথ্যগত তেমন কোন ব্যবধান নেই।
আসলে এ ধরনের বিষয়গুলি নিয়ে কিছু ভাবারই প্রয়োজন বোধ করে না আমাদের মূল ধারা গণমাধ্যমগুলো। তারা এতটাই সেলিব্রেটি এবং রুই কাতলা ঘেষা যে, সাধারণ মানুষ না মরলে খবর হয়। এখানে তো মরেও খবর হল না!

কাছাকাছি সময়ে জুলাইয়ের ২ তারিখ, ২০১৫, এরকম একটি ঘটনা ঘটে ইন্ডিয়ায়। সেখানের কয়েকটি পত্রিকা কীভাবে খবরটি কাভার করেছে তা এখানে তুলে ধরা হলো :

“In pics: Hema Malini injured, child killed in road accident” – দুর্ঘটনার একটি ছবি দিয়ে হিন্দুস্তান টাইমস্ এভাবে খবরটি কাভার করেছে। সেখানে হেমামালিনির রক্তাত্ত অবস্থায় কয়েকটি ছবি দেওয়া হয়েছে।

hindustan times
বর্ণনার শুরুতেও তারা হেমামালীনির আহত অবস্থাকে হাইলাটস্ করেছে। তারা শুরু করেছে-
“Bharatiya Janata Party MP and actor Hema Malini was injured on Thursday in a road accident which killed a two-year-old child and severely injured two others at Dausa in Rajasthan.”
সংবাদটির লিংক :
http://www.hindustantimes.com/india-news/in-pics-hema-malini-injured-child-killed-in-dausa-road-accident/article1-1365407.aspx

পাশাপাশি দেখে নেওয়া যেতে পারে বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাজ্যের শীর্ষ পত্রিকা দ্যা গার্ডিয়ান কীভাবে নিউজ করেছে।

খবরটির প্রেক্ষিত্রে যুক্তরাজ্যের অন্যতম শীর্ষ পত্রিকা দ্যা গাডিয়ানের শিরোণামটি এরকম :
“Child killed and Indian celebrity politician Hema Malini injured in car crash”

এবং খবরের বর্ণনার শুরুতেও নিহত শিশুটিসহ অন্যান্য আহতদের কথা এসেছে- “A car accident involving Hema Malini, a popular Bollywood actor and Indian politician, has killed a girl and injured several others including the politician.”
সংবাদটির লিংক :
http://www.theguardian.com/world/2015/jul/02/india-hema-malini-injured-fatal-car-crash-rajasthan

ইন্ডিয়ার আরেক জনপ্রিয় পত্রিকা টাইমস্ অব ইন্ডিয়ার খবরের শিরোণামটি নিম্নরূপ :
“Hema Malini injured in road accident in Rajasthan”
এটা ছিল তাদের জুলাইয়ের ২ তারিখের নিউজের শিরোণাম। খুব তড়িৎ, অর্থাৎ ঘটনা ঘটার এক ঘণ্টার মধ্যে তারা খবরটি তাদের অনলাইনে কাভার করে, এবং মোটামুটি ডিটেইলস্ খবর দেয়। ভিতরে শিশুটির মৃত্যু সংবাদ রয়েছে। অর্থাৎ জানা সত্বেও তারা শিরোণামটি হেমামালিনিতেই সীমাবদ্ধ রেখেছে।
এরপরেও তারা বিষয়টি নিয়ে নিউজ করেছে, তবে একইভাবেই তা করেছে।
“Hema Malini’s car accident: Here’s what happened”
তারা মোট আটটি ছবি সেখানে দিয়েছে। দুর্ঘটনার ছবি সেখানে আছে। হেমামালিনির রক্তাত্ব অবস্থার ছবি আছে, সুস্থ অবস্থার ঝবি আছে, কিন্তু একই দুঘটনায় দুই বছরের যে শিশুটি মারা গিয়েছে এবং অন্য গাড়িটির যারা আহত হয়েছে, তাদের কোন ছবি নেই।

সাবির্ক বিবেচনায় দ্যা হিন্দুর নিউজটি ছিল গ্রহণযোগ্য। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং দ্যা গার্ডিয়ানের দৃষ্টিভঙ্গিতে মিল রয়েছে। তাদের শিরোণাম ছিল-
“Child dies, Hema Malini injured in road accident”
সংবাদটির লিংক :
http://www.thehindu.com/news/hema-malini-injured-in-road-accident-rushed-to-hospital/article7379654.ece

দেখা যাচ্ছে, সংবাদ পরিবেষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সাথে ভারতের গণমাধ্যমের পার্থক্য উল্রেখযোগ্য নয়। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো যেমন শিরোণামে মারা যাওয়া চালককে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে, একইভাবে ইন্ডিয়ার গণমাধ্যমগুলো শিশুটির মারা যাওয়ার ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারেনি, এবং শিশুটির নাম পরিচয় তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করেনি।

ইন্ডিয়ার উক্ত খবরটির প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রিয়াজ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি নীপিড়িত এবং দরিদ্রদের বর্তমান বিশ্বে সঙ্গীন অবস্থার কথা বলেছেন। উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গরা যে এখনো নানান ধরনের বৈষম্য এবং নীপিড়নের স্বীকার, তা তিনি বলেছেন। পাশাপাশি হেমামালিনির দুর্ঘটনার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন,
“ভারতের এককালের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র শিল্পী এবং এখনকার ক্ষমতাসীন বিজেপির সাংসদ হেমা মালিনি বৃহস্পতিবার যে দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন, সেই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে একজন শিশু – সোনাম, বয়স চার বছর। তার পরিবার অভিযোগ করেছেন দুর্ঘটনার পর হেমা মালিনির সঙ্গে যদি সোনামকেও হাসপাতালে নেয়া হতো তবে তাঁকে হয়তো বাঁচানো সম্ভব হতো। অভিযোগ রয়েছে যে দুর্ঘটনার পর বিজেপি এমপি এবং তার সঙ্গীরা আহত পরিবারের খোঁজ নেয়নি।”
যৌক্তিক একটি বিষয়ে তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। জনাব আলী রিয়াজ ফেসবুকে আমার বন্ধু তালিকায় থাকায় তাঁর লেখা পড়ার সুযোগ আমার হয়। অনেক আগে থেকে তিনি প্রথম আলোতে লেখেন, সে সুবাধেই ওনার লেখার সাথে পরিচয়।
ফেসবুকের উক্ত স্ট্যাটাসে তিনি মিডিয়ান সমালোচনা করেছেন, তিনি লিখেছেন, “দারিদ্র ও সামাজিক বিভাজনে যারা ‘নিচু তলার মানুষ’, সমাজে যারা প্রভাবশালী নয়, তাঁদের জন্যে মিডিয়ার আলো অনুপস্থিত, আইনের ‘নিজস্ব গতি’ শ্লথ। বর্ণের কারণে, সামজিক অবস্থানের কারণে, দারিদ্রের কারণে তাঁরা যখন বঞ্ছনার শিকার, তাঁরা যখন মৃত্যুর মুখোমুখি তখন তার খবর হয় না। বিত্ত আর ক্ষমতা নির্ধারন করে দেয় তাঁদের খবর আমরা জানবো কি না। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গরা প্রায় প্রতিদিন পুলিশি নিপীড়নের, অন্যায় হত্যাকান্ডের শিকার হন – সেই খবর জানি বটে, কিন্ত ব্যবস্থার বদল হয় না। প্রতিবাদের ভাষা, যা প্রধানত অহিংস, কখনও হয়ে ওঠে সহিংস। তেমনি ঘটে অন্যত্রও; প্রভাবশালী ও বিত্তশালীদের খবর আমরা জানি, অন্যদের খবর থাকে আড়ালে। এই সব ঘটনায়, যাকে গণমাধ্যম দুর্ঘটনা বলেই বর্ণনা করে, সেলিব্রিটিরা যুক্ত থাকেন, যখন রাজনীতিবিদরা যুক্ত থাকেন তখন গনমাধ্যমের আলোর সবটারাই লক্ষ্য তাঁরাই; তাঁরা কি নিরাপদ, তাঁরা কি যথাযথ চিকিৎসা পেলেন?”

chinni-hema-malini-accident-victim_650x400_51435919645