নিজেকে হারাই: কানামো কাহিনী (তৃতীয় ও চতুর্থ পর্ব)

follow-upnews
0 0

পূর্ব প্রকাশের পর

১০ অগাস্ট ২০১৬। হঠাৎ করে পুরনো পেটের ব্যাথাটা শুরু হল। বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি করে কান্নাকাটি করার মত অবস্থা। ছিলাম শিরিন আপুর বাসায়। রাত ৯টার দিকে আপু ডেল্টা হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু আমি ঠোঁট কামড়ে বিছানায় পড়ে রইলাম। দুলাভাইয়ের এনে দেওয়া ওষুধ খেয়ে এক ঘুমে রাত পার করলাম। সকালে একটু সুস্থ বোধ করায় আমার এক সিনিয়র প্রফেসরের কাছ থেকে রেফারেন্স নিয়ে ছুটলাম বিএসএমএমইউ (পিজি) হাসপাতালে।

ডাক্তার কিছু টেস্ট দিলেন মেডিনোভা থেকে করে নিয়ে আসার জন্য। রিপোর্টগুলো দেখে ডাক্তার বললেন, ২১ সেপ্টেম্বর তোমার অপারেশন। আমি ডাক্তারকে বললাম, তার আগে আমি প্রায় ছয় হাজার ফুটের একটা পাহাড়ে যেতে চাই, শারীরিক কোনো সমস্যা হবে কিনা। ডাক্তার কিছু ওষুধের তালিকা দিয়ে বললেন, পাহাড়ে গেলে সেগুলো সাথে রাখতে। ডাক্তারের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে পূর্ণ উদ্যমে চলল কানামো যাত্রার জন্য গোছগাছ।

দিনগুলো কাটতে লাগল চরম উত্তেজনায়। সারাক্ষণ মাথায় কানামো যাত্রা নিয়ে নানারকম জল্পনা-কল্পনা। পরিচিত অভিজ্ঞ ট্রেকারদের সাথে পরামর্শ করি। এটাওটা জানতে চাই। উৎসাহ আর উদ্দীপনার যেন কোনো শেষ নেই! এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন ফেসবুকের ইনবক্সে একটা মেসেজ “আপনি কি মাউন্টেনিয়ার?” উত্তর পাঠালাম নিজেকে “মাউন্টেনিয়ার” বলার মত এত দুঃসাহস আমার এখনো হয়নি, তবে আমি পাহাড় ভালবাসি, পাহাড়ে ছুটে যেতে আমার ভালো লাগে।

এভাবেই কথা শুরু সনি ভাইয়ের সাথে। সনি ভাই জানালেন রাতুল ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছেন আমি কানামো যাবার পরিকল্পনা করছি। ওনারও একই রকম পরিকল্পনা, তাই কথা বলতে আগ্রহী। সম্ভাব্য কানামো সামিট নিয়ে আমরা আমাদের চিন্তা ভাবনা, পরিকল্পনা শেয়ার করলাম। দুই গ্রুপই প্রায় এক সময়ে সামিটের প্ল্যান করেছি, তাই ঠিক হল ইন্ডিয়া গিয়ে আবার যোগাযোগ হবে। মানালি পৌঁছে জ্বরে ভুগে আর প্রায় ২৪ ঘণ্টা অচেতনের মত থেকে আমি যখন আর কিছু পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারছি না, সেই সময় সনি ভাইয়ের ফোন পেলাম। জানতে চাইলেন, আমাদের আপডেট। ওনারা ওই দিনই মানালি পৌঁছেছেন। আমার দলের সাথীরা অনবরত তাড়া দেওয়াতে বিকেলের দিকে আমি বের হলাম আমার জন্য টেন্ট আর স্লিপিং ব্যাগের ব্যবস্থা করতে। দেখা হল সনি ভাইয়ের গ্রুপের সাথে। সাথে ছিলেন ওনার খালু (যাকে নিয়ে কিবের পর্যন্ত যাবার পরিকল্পনা), বন্ধু দীপঙ্কর, সোনালি আর শামিম। সবার সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগল। ওনারা সবাই আমাদের দলের অন্যদের সাথেও কথা বিনিময় করলেন।

সনি ভাই যেন ত্রাণকর্তার ভূমিকা নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। প্রথমেই জ্বর মাপার ব্যবস্থা করলেন। জ্বর তেমন ছিল না ওই সময়। কিচ্ছু খাইনি এমনকি পানিও না,  শুনেই নিজেই উনি পানি কিনে আনলেন। জোর করে পানি খাওয়ালেনও। এরপর নিয়ে গেলেন ভাত খাওয়াতে। ভাত খাব না শুনে সেই নেপালি রেস্টুরেন্টের মালিককে বললেন একটু মুরগীর স্যুপ বানিয়ে দিতে। এভাবেই শুরু হল সনি ভাইয়ের অভিভাবকত্ব। ওই দিন রাতে শান্তনু আর সজীবকে বললাম, এই রকম দুর্বল শরীর নিয়ে আমি কিবের যাব না। ওরা বলল, আমার জন্য মানালিতে একটা দিন ওরা অপেক্ষা করবে যাতে আমি যদি এরমধ্যে সুস্থ বোধ করি তাহলে যেন একসাথে যেতে পারি। আমি চাইছিলাম না ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করুক, কিন্তু ওই সময় আর কিছু বলার মত অবস্থা আমার ছিল না।

পরের দিন সামান্য একটু ভালো বোধ করায় অপু ভাইয়ের রেকমেন্ড করা এক দোকান থেকে ডাউন স্লিপিং ব্যাগ, টেন্ট, ট্রেকিং পোল আর আনুষাঙ্গিক যা কিছু লাগে কিনে ফেললাম। পরের দিন মানালি ছাড়ার পরিকল্পনা। সজীবদের প্ল্যান হল, লোকাল বাসে করে একেবারে কিবের পৌঁছানো। ভেবে দেখলাম, আমার এই দুর্বল শরীর নিয়ে মানালি থেকে ওভাবে কিবের যাত্রাটা অনেক কষ্টের হয়ে যাবে। তাই ঠিক হল, আমি সনি ভাইদের সাথে রিজার্ভ সুমোতে কাযা যাব, আর সজীবরা লোকাল বাসে কিবের পর্যন্ত চলে যাবে।

নেপালি দোকানের স্যুপ খেয়ে ভালো লাগার পর থেকে খালি স্যুপই খেয়েছি, সলিড কিছু খাওয়া হয়নি, তাই রাতে খেলাম চিকেন মম। মমটা খেতে অনেক ভালো লেগেছিল, তাই কয়েকটা মম সাথে করে নিয়েও এসেছিলাম হোটেলে। পরদিন খুব ভোরে গাড়ি ছাড়বে মানালি থেকে। তাই ভোর ৪টায় উঠে রেডি হলাম। আর খালি পেটে খেলাম রাতে এনে রাখা সেই মম। খাওয়ার একটু পরেই শুরু হল বমি। এক দফা বমি করা শেষ করে পাঁচ-সাত মিনিট বিরতি দিয়ে আবার আরেকবার বমি করে বিছানায় নেতিয়ে পড়লাম। এর মধ্যেই সজীবরা এল বিদায় নিতে। ওদের জানালাম, একটু আগেই বমি হয়েছে, আমি আদৌ কতদূর যেতে পারব জানি না। খুশি মনেই ওদের বিদায় দিলাম, ভাবলাম, আমি না পারি অন্তত ওরা সফল হোক।

একটু পরে সনি ভাই আমাকে নিতে আসলেন। বমি করেছি শুনে একটু সময় দিলেন ধাতস্থ হবার। বললেন, মানালি থেকে রওনা হতে। ভালো বোধ না করলে আবার আমাকে মানালি ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। টালমাটাল মাথা নিয়ে সুমোতে উঠে বসলাম, ব্যাগের উপর মাথা রেখে আবারো অচেতন মত হয়ে পড়লাম। এভাবেই মানালি থেকে কাযার পথে যাত্রা শুরু হল আমার।

ভোর ৬টায় মানালি থেকে শুরু হল কিবেরের পথে যাত্রা। ২০৫০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত মানালি থেকে পাহাড় বেয়ে আমাদের গাড়ি একেবেঁকে উঠতে থাকল উপরের দিকে। কিছুক্ষণের পরেই ৩৩৬০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত মারহি পৌঁছলাম আমরা। মারহি পর্যন্ত আমি গাড়িতে ঝিমাচ্ছিলাম শরীর খারাপ লাগছিল বলে। মারহি পৌঁছে সবাই সকালের নাস্তা খেল। আমার কিছুই খেতে ইচ্ছা করছিল না। এক কাপ লাল চা খেলাম শুধু। গরম চা খেয়ে আর তাজা বাতাসে নিশ্বাস নিয়েই বোধহয় শরীর অনেক ভালো লাগতে শুরু করল। মারহি থেকে পৌঁছে গেলাম রোহটাং পাসে (৩৯৭৯ মিটার উচ্চতায়)। সেখানে সবাই মিলে কিছু ছবি তোলা হল। যত উপরে উঠতে থাকলাম ততই ভালো বোধ করতে থাকলাম। আমাদের যেহেতু রিজার্ভ করা গাড়ি ছিল, একটু পর পর আমরা থেমে বিরতি নিয়েছি, উপভোগ করেছি সেই জায়গার সৌন্দর্য।

আমার সীমিত ভাষাজ্ঞানে মানালি থেকে কাযা পর্যন্ত পথের সৌন্দর্যের বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০৫০ মিটার থেকে ৩৮০০ মিটার উচ্চতার সেই পাহাড়ি রাস্তা বৈচিত্রে ভরপুর। রাস্তা কোথাও উঁচু হয়ে উঠে যাচ্ছে, একটু পরেই আবার পাহাড়ের গায়ের সর্পিল সেই রাস্তা বেয়ে নিচে নেমে আসছে। কোথাও সবুজে ঢাকা পাহাড়, কোথাও বা তা রুক্ষরুপে বিরাজমান। ছোটবড় অসংখ্য জলধারা পাহাড়ের গায়ে ঝর্ণার রূপ নিয়েছে। ঝর্ণার জলধারা আবার কোনো কোনো জায়গায় রাস্তা অতিক্রম করে আরো নিচে পড়েছে, মনে হয় যেন ঝর্ণার মাঝখান দিয়ে পথ করে চলছি। দুরের বরফাচ্ছাদিত শ্বেতশুভ্র পাহাড়চূড়াগুলোর দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রইলাম।

সেখানে সবাই কিছু খেয়ে নিয়ে রওনা হলাম বাটালের পথে। পুরো রাস্তায় আমাদের সঙ্গ দিল রাস্তার দুপাশের পাহাড়গুলো। বাটালে পৌঁছে দেখা পেলাম চন্দ্রা নদীর। পাহাড়ের বরফগলা পানি নিচে নেমে এসে নদীর রুপ ধারণ করেছে। চন্দ্রা নদীর খরস্রোতা রুপ দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম চন্দ্রাতাল লেকের কাছে। গাড়ি থেকে নেমে বেশ কিছুদূর হাঁটতে হল লেকে পৌঁছানোর জন্য। সবুজ পানির লেক, নীল আকাশ, আর নানান শেডের পাহাড় মিলে এক অসাধারণ রুপ দিয়েছে প্রকৃতিকে। লেকের পানিতে হাত ভেজালাম, অনেক ঠাণ্ডা পানি। শুনেছি শেষ রাতের দিয়ে লেকের পানি কোথাও কোথাও নাকি ঠাণ্ডায় জমে যায়। লেকে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আবার রওনা হলাম। তারপর একটা সময় চোখে পড়ল “Welcome to Spiti” সাইনবোর্ড। সাথে সাথে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল আমার। অনেক অনেক দিনের কাঙ্ক্ষিত একটা স্বপ্নের যেন কাছাকাছি পৌঁছে গেছি আমি। তখন সূর্য প্রায় ডুবে যাচ্ছিল। দুপাশে পাহাড় আর সূর্যের সোনালি আভায় আমার মনে হল আমি সত্যি স্বপ্নের মধ্যে আছি। একটা সময় কাযা পৌঁছলাম। আর নিজেকে আবিস্কার করলাম হোটেলের আরামদায়ক বিছানায়। যাত্রার শুরুটা খুব খারাপভাবে শুরু হয়েছিল বলে আমি ভয় পেয়েছিলাম, ভাবছিলাম ৩৮০০ মিটার উঁচুতে যখন পৌঁছাব তখন শরীর আরও খারাপ লাগবে, আমার অক্সিজেন নিতে সমস্যা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যতই উপরের দিকে উঠেছি ততই শরীর ভালো লেগেছে। সনি ভাই ওষুধের মত করে জোর করে খাবার খাওয়াইছেন। সেইসাথে পরামর্শ দিয়েছেন কী করে ঠাণ্ডায় বা কম অক্সিজেনে নিজেকে খাপ খাওয়াব। দিন শেষে আমি যখন কাযা পৌঁছলাম তখন আমি পুরোপুরি সুস্থ। ৩৮০০ মিটার উঁচুতে নিজেকে এক্লিমেটাইজ করতে হবে এই রকম চ্যালেঞ্জ রেখে অনেক আনন্দিত মন নিয়ে ঘুমাতে গেলাম। (চলবে)

সুদূরের পিয়াসী

Next Post

এরকম একটি আলোচিত সংবাদেরও প্রতিটি শব্দ এবং বাক্য বিবিসি বাংলা থেকে কপি করতে পারল দৈনিক কালের কণ্ঠ!

মাশরাফির সাথে সেই ভক্তের মাঠে দৌঁড়ে গিয়ে দেখা করার উপর বিবিসি বাংলার নিউজটি হয়েছে রাত সাড়ে দশটার দিকে। কালের কণ্ঠ নিউজটি করেছে রাত বারোটার একটু পরে। যেহেতু নিউজের প্রতিটি শব্দ মিলে যাচ্ছে, তাই বলা যায় দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকা বিবিসি বাংলার নিউজটি কপি করেছে। “এমন আলোচিত এবং সহজ একটি সংবাদ […]