পশ্চিমাঞ্চলে ঈদের ফিরতি টিকেট বিক্রি শুরু হয়েছিল গত পঁচিশ তারিখ থেকে৷ পঁচিশ থেকে একত্রিশ পর্যন্ত মোট সাতদিন আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল রাজশাহী স্টেশনের এসি কাউন্টারে দাঁড়িয়ে টিকেট বিক্রী তদারকি করা৷
হৃদয়বান নাকি হৃদয়হীন ভেবে কর্তাব্যক্তিগণ আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন তা বুঝে উঠতে পারিনি৷ তবে দাঁড়িয়ে পায়ের গোড়ালি ব্যথার পাশাপাশি অভিজ্ঞতার ঝুলি বেশ সমৃদ্ধ হয়েছে৷
সব থেকে চাঞ্চল্যকর যে তথ্যটি আমি দিতে বাধ্য হচ্ছি, তা হলো– কাউন্টারের সামনে দাঁড়ানো টিকেট প্রার্থীদের অবয়ব দেখে আমার মনে হয়েছে, অন্ততপক্ষে ৫০% টিকেট কোথিত ব্ল্যাকারের হাতে গিয়েছে, অর্থাৎ প্রকৃত যাত্রী তা পায়নি ৷
এটা একান্তই আমার নিজস্ব অভিমত। সুশীল সমাজের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, “আপনি প্রতিরোধ করলেন না কেনো?” আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এর মধ্যে অন্তত ৫০% অাছে, অর্থাৎ মোট টিকিটের ২৫%, যারা টাকার বিনিময়ে অনেক গণ্যমান্যদের টিকেট কেটে থাকেন!
বিষয়টি নিশ্চিত হতে আমি অনেক সময় গাঁটের পয়সা খুইয়ে টিকেট প্রার্থীদের সাথে কথা বলেছি এবং তৃতীয় বিশ্বের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিষয়টি আমার কাছে খুব বেশী অস্বাভাবিক মনে হয়নি৷ বিষয়টি কেবলই অর্থের বিনিময়ে শ্রম বিক্রী ছাড়া কিছু নয়। অনেক সময় আমরা টিকেটের পেছনে যাত্রীর নাম, মোবাইল নাম্বার লিখে জমা নিয়েছি ৷ পরে প্রকৃত যাত্রী এসে টিকেট নিয়েছে৷
কালোবাজারিদের মধ্যে বাকী ৫০%, অর্থাৎ মোট টিকিটের ১৭.৫% কে জিজ্ঞেস করলে তারা নিজের নামটাও বলতে পারেন না৷ তারা কেবলই ফিজিক্যালি উপস্থিত থাকেন৷ মূল নির্দেশনা আসে লাইনের আশেপাশে থাকা ব্যক্তিদের কাছে থেকে৷ যারা মূলত টিকেট কাউন্টারের বাইরের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব পালন করে থাকেন৷
আমি বিশ্বাস করতে চাই তারা তাদের কর্তাব্যক্তিদের চাহিদা পূরণেই এই পথ বেছে নিয়েছেন৷ বাকীরা প্রকৃতপক্ষেই কালোবাজারকারি৷ তাদের বিষয়ে আমার সহজ অভিমত হোলো, তাদের কাছে নিজের ও পরের জীবনের দুই পয়সার দামও নেই ৷ কাজেই তাদেরকে প্রতিরোধ করা আমার মোতো ছোটখাট অফিসারের কাজ নয়৷
অতি সম্প্রতি খুলনা স্টেশনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমার কতিপয় করিৎকর্মা সহকর্মীবৃন্দ ফেসবুকে বেশ সুুনাম কুড়াচ্ছেন৷ তাদের কাছে কিছু বিষয় পরিষ্কার করে দিই–
আটককৃত ব্যক্তি রেলওয়ের কর্মচারি নন৷ কম্পিউটারাইজড টিকেটিং সিস্টেম পরিচালনকারি সংস্থার প্রতিনিধি৷ বারোহাত কাঁকড়ের তেরো হাত বিচি নামক প্রবাদের ন্যায় এক সময়কার তলাহীন ঝুড়ি খ্যাত এই দেশের অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন সন্তানের থেকে ভিআইপি বেশী! কাজেই বিশেষ বিশেষ দিবসগুলোতে মাত্র ৫% ভিআইপি কোটাতে কুলানো সম্ভব হয় না!
উপরওয়ালাদের সহজ জবাব, “আপনি কীভাবে করবেন জানি না, তবে আমার টিকেট না পেলে আমি দেখবো আপনি ক্যামনে চাকরি করেন!” এইরকম গুনধরদের হ্যান্ডেল করতে আমরা এস্পেয়ার কোচ অতিরিক্ত হিসেবে লাগিয়ে তাদের সেবা দিই৷
একবার গাড়ি লাগালে টিকেট কাউন্টারে ওপেন হয়ে যায়৷ সাথে সাথে আমরা টিকিট কেটে নিয়ে ভিআইপিদের সরবরাহ করে থাকি৷ গতকালও তেমনই কোনো ভিআইপিদের জন্যই টিকেটগুলো কাটা হয়েছিল৷ ছেলেটি টিকেট সঙ্গে নিয়ে কাউন্টারের বাইরে এসে নিঃসন্দেহে গর্হিত কাজ করেছে, কিন্তু কারো কাছে বেশী দামে বিক্রির চেষ্টা করেনি৷
ইতোমধ্যে ভিআইপিগণ কৃতজ্ঞতা স্বরুপ তার জামিনের ব্যবস্থা করেছেন৷ আর ওসিসাহেব ও আপনাদের মোতো লোকেরা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতেই এই কর্ম করেছেন। আমি হলফ করে বলতে পারি, রাজশাহী স্টেশনে ব্ল্যাকার দ্বারা, প্রভাব খাটিয়ে বা তদবির করে সবচেয়ে বেশী টিকেট নিয়েছেন ওসি সাহেব৷
এবার সুনাম কাঙ্গাল করিৎকর্মাদের উদ্দেশ্যে আমার কতিপয় প্রশ্ন–
১. খুলনায় মোবাইলকোর্টরত অবস্থায় সার্ভারে আপনার নামে রাখা যে টিকেট পকেটস্থ করেছিলেন একবারও কি ভেবেছেন ৫% ভিআইপি কোটা যথাযথভাবে মেইনটেইন হলে আপনার মোতো নব্য নবম গ্রেডের কর্মকর্তাকে ঐ টিকেট দেওয়া সম্ভব হোতো কিনা?
২.আপনারা কি একবারও ভেবেছেন রাজশাহী স্টেশনে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত জোরপূর্বক টিকেট কাউন্টারে প্রবেশ করে একসাথে ছয়জন টেকনিক্যাল পার্সোনের রিপ্লেস না করে আটক করায় টিকেট বিক্রি বন্ধ হয়েছে, যা রাষ্ট্রীয় কর্মে বাধা দানের শামীল?
৩.সর্বশেষ কাঙ্ক্ষিত টিকেট না পাওয়ায় ভাড়া করা গুন্ডাদের দ্বারা সার্ভারের কানেকশন খুলে ফেলার আগে একবারও কি মনে হয়নি রেলওয়েতেও অনেক হৃদয়বান কর্মকর্তা রয়েছেন, যাদের সাথে যোগাযোগ করলে আপনি সমাধান পেতে পারতেন?
–চলবে
Hasina Khatun
Assistant Chief Commercial Manager(Claims)/West, from 31st bcs at Bangladesh Railway (BR)