একটার পর একটা প্রয়োজন এবং আধুনিক সভ্যতার সংকট

প্রয়োজনের পর প্রয়োজন অনুভূত হওয়া, এবং তা যেকোনোভাবে মেটানোর চেষ্টা আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে বড় সংকট বলে মনে হয়।

ঢাকায় এসে যখন আমেরিকান তালার সাথে পরিচিত হই, তখনই বিষয়টি নিয়ে আমি ভাবতে বাধ্য হয়েছিলাম। মনে মনে প্রশ্ন তুলেছিলাম, এমন একটি তালার (ঘরে বা বাইরে থেকে খোলা যায়) প্রয়োজন হয়েছিল কেন?

প্রয়োজন তো অবশ্যই আছে, পাশাপাশি প্রয়োজনের প্রেক্ষাপট এবং রকম নিয়েও ভাবতে হবে। এর সাথে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদ, বা ‘একটুও হস্তক্ষেপ’ সহ্য না করা, বা ‘অন্যের দ্বারা একটুও বিরক্ত হতে না চাওয়া’র মত বিষয়গুলো অবশ্যই জড়িয়ে রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি জড়িয়ে আছে অর্থনীতি। অর্থাৎ আমার টাকা আছে, তাই এই জীবনে ভোগ করে যেতে হবে, বিদ্যমান সুবিধা দিয়ে হচ্ছে না, নিজের জন্য আরো সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে।

বিজ্ঞানের আবিষ্কার এবং প্রযুক্তিগত আবিষ্কারের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে, বিজ্ঞানের আবিষ্কার হয় জিজ্ঞাসু মন থেকে, মানবিক প্রয়োজন মাথায় রেখে; আর প্রযুক্তিগত আবিষ্কারগুলো হয় দৈনন্দিন-বস্তুগত প্রয়োজনবোধ থেকে বা ব্যবসায়ীক কারণে প্রয়োজন চাপিয়ে দেয়ার জন্যে।

ঐ ধরনের তালাটা হয়ত প্রয়োজনীয়, কিন্তু অনেক কিছুর কথা চিন্তা করলে দেখা যায়, এগুলো এসেছে স্রেফ বাজে রকমের ভোগবাদ এবং বাজারের অস্থিরতা থেকে, শুধুমাত্র ব্যবসার প্রয়োজনে। তাছাড়া সুবিধাগুলো এমনভাবে বণ্টন করা হচ্ছে, যাতে প্রয়োজন কোনোভাবেই না ফুরায়।

বিষয়টিকে আরেকটু পরিষ্কার করা যেতে পারে, ধরুণ, আপনার একটা ল্যাপটপ দরকার। কিনলেন ল্যাপটপ। ল্যাপটপ রাখার জন্য একটা ব্যাগ দরকার। কিনলেন সেটি। ব্যাগ রাখার জন্য বাসায় একটি র‌্যাক দরকার, তাও কিনলেন।

এখন দেখলেন, ল্যাপটপ রেখে কাজ করার জন্য একটা পড দরকার, কিনলেন সেটি। এবার দেখলেন, ল্যাপটপ রাখার জন্য যে ব্যাগটি আপনি কিনেছেন, সেটি বেশ ব্যাগডেটেড, এর চেয়ে অাধুনিক ব্যাগ বাজারে চলে এসেছে। আরো একটি ব্যাগ কিনে ফেললেন। কিনে ফেললেন বটে, কিন্তু ওটিও ব্যাগডেটেড হতে সময় লাগবে না।

আধুনিক ব্যবসার বৈশিষ্টই হচ্ছে—আপনাকে দিয়ে একই পণ্য বারে বারে কেনাবে, কারণ, তারা জানে মানুষ অহংকারী হতে চায় এবং এটা (নতুন পণ্য দিয়ে নিজেকে সাজানো) নিজেকে ‘বড়’ করে দেখানোর একটা সহজ পথ। এবং এমন অনেক পণ্য আপনার সামনে প্রয়োজনীয় করে তুলবে যেগুলোর ব্যবহার না জানলে কখনই প্রয়োজনীয় মনে হতো না।

এই দুই মাসে ল্যাপটপে গান শোনা, মুভি দেখা, এবং ইন্টারনেটে … ছাড়া আর কিছু এখনো করে উঠতে পারেননি। কিন্তু সময় দিয়েছেন প্রচুর, ডাউনলোড করেছেন, আপলোড করেছন, সিডি-ডিভিডি কিনেছেন, ইত্যাদি অনেক কিছুই করেছেন। যেহেতু ঠিক কীসের জন্য যন্ত্রটি আপনি কিনেছেন তা জানেন না, তাই এটির বাহ্যিক দিক এবং ফান পার্ট নিয়েই আপনার যত ভাবনা, এবং কোম্পানিগুলো চায়ও তাই।

এতসব কেনার পর মনে হল, ল্যাপটপ নিয়ে শুয়ে শুয়ে কাজ করা যায় না। এর চেয়ে দামী একটা স্মার্ট ফোন থাকলেই ভালো হতো। টাকা আপনার কাছে কোনো ব্যাপার না। কিনলেন স্মার্টফোন। সেটির জন্য সুদৃশ্য একটি কাভারও কিনলেন। এবার আরেকটা সমস্যা ধরা পড়ল, স্মাটর্টফোনটির সব ভালো, কিন্তু এটি দেখতে খুব সুন্দর না, স্লিম না। কোম্পানি বাজার গবেষণা করে আপনার এ আক্ষেপও বের করে ফেলল।

কোম্পানি বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিল, এবং স্লিম স্মার্ট ফোন আপনার মতো মানুষের জন্য বের করে ফেলল। এভাবে একটার পর একটা… এইসব প্রয়োজনের কোনো আদ্যপান্ত নেই। মার্কেটে চোখ রাখলে মাথা ঘুরে যায়। যে কিনছে সে তো কিনছেই, যে কিনতে পারছে না সেও আফসোস করছে অকারণে!

স্লিম স্মার্টফোন পাইলেন বটে, দেখলেন, এটার ক্যামরেটা খুব ভালো না। বিশেষ করে সেলফিটা যুতসই ওঠে না। খুঁজে খুঁজে ভালো ফ্রন্ট ক্যামেরা আছে এমন একটা সেট কিনে ফেললেন।

এবার আরেক সমস্যা আবিষ্কার হল, এই ফোনটি আবার এন্ড্রয়েড নয়। ভাই, বুঝতে পারছেন কি আপনি আধুনিক সভ্যতার কোন গোলকধাঁধার মধ্যে আছেন?

বিষয়টিকে সভ্যতার সংকট বলে মানতে হবে, কারণ, এইসব উদ্ভট প্রয়োজন মেটাতে গিয়েই পৃথিবীর সহনশীলতার বিষয়টি মারাত্মকভাবে অবহেলিত হচ্ছে, প্রকৃতির উপর হস্তক্ষেপ বাড়ছে, বৈষম্য তৈরি হচ্ছে, মৌলিক চাহিদার জায়গায় বিনিয়োগ এবং গবেষণা সংকুচিত হচ্ছে, মানুষ মানবিক জায়গায় সময় দিতে পারছে না, ইত্যাদি অনেক সমস্যা তৈরি হচ্ছে বলে ধরে নেওয়া যায়।


দিব্যেন্দু দ্বীপ