ধর্ষণের ব্যাপকতার পেছনের অন্যতম একটি কারণ ধর্মীয় ওয়াজ-মাহফিলে নারীবিদ্বেষী বক্তৃতা। বিভিন্ন সময় মাহফিলে নারীদের পোশাক নিয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া হয়। এ ছাড়া অপরাধীর শাস্তি না হওয়াও ধর্ষণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্লিপ্ততাও দায়ী। আইন যদি কঠোরভাবে প্রয়োগ না করা হয়, যদি ধর্ষণের শিকার নারী বিচার না পান, সেক্ষেত্রে ধর্ষণ কমবে না।
আজ অবধি ধর্ষণের ঘটনার সঠিকভাবে সুরাহা করে দোষী ব্যক্তিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে দেখা যায়নি। তাই অপরাধীরা মনে করে, অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়া যায়। এ ছাড়া যখনই কোনো ঘটনা ঘটে, তখনই এক পক্ষ সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে- না, তেমন কিছু হয়নি!। বিশেষ করে প্রশাসন। মানবাধিকারকর্মীরা ঘটনার প্রতিবাদে মাঠে নামলে প্রশাসন বোঝাতে চায়, ‘মানবাধিকারকর্মীরা বাড়াবাড়ি করছে’। রাজনৈতিকভাবে সরকার ও প্রশাসনিকভাবে যারা দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের যে ধরনের দায়িত্ব পালন করা দরকার ছিল, তারা তা করছেন না। ফলে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে।
১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট কিশোরী ইয়াসমিন ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া নৈশকোচে দিনাজপুরের দশমাইল মোড় এলাকায় পৌঁছলে কোতোয়ালি পুলিশের টহল দল তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে পিকআপ ভ্যানে তুলে নেয়। পথে পুলিশ সদস্যরা ইয়াসমিনকে ধর্ষণ করে। পরে নির্মমভাবে হত্যা করে তার লাশ দিনাজপুর দশমাইল মহাসড়কের পাশে ফেলে দেয়। বর্বরোচিত এ ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন দিনাজপুরের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। এ সময় পুলিশের গুলিতে সাতজন প্রাণ হারান। আহত হন কমপক্ষে শতাধিক। বিক্ষুব্ধ মানুষ দিনাজপুর শহরের থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। প্রশাসন অসহায় হয়ে পড়ে। শহরে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। পরে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করা হয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তীব্র আন্দোলনের মুখে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যায় জড়িত তিন পুলিশ সদস্যের ফাঁসি হয়। তাই প্রতিটি ঘটনায় আন্দোলন জোরদার করতে হবে। প্রচার করতে হবে, যেন অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়। ইয়াসমিনের ঘটনার পর এখন কিন্তু পুলিশ দ্বারা ধর্ষণের ঘটনা তেমন ঘটে না। কারণ তারা জানে, ধর্ষণের ঘটনায় শাস্তি নিশ্চিত।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকায় হেফাজতে ইসলামের আমির আহমদ শফীর দেওয়া একটি ধর্মীয় বক্তৃতায় নারীদের প্রতি অবমাননাকর শব্দ ব্যবহার করা হয়। নারীদের নিয়ে ‘অসম্মানজনক’ মন্তব্য ও ‘তেঁতুলের সঙ্গে নারীদের তুলনা করা’র মতো উস্কানিমূলক বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগের ওয়েসাইটগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। আরও অনেক হুজুরই ওয়াজের নামে নারীদের পোশাক নিয়ে বক্তব্য দেন, যা উস্কানিমূলক। এসব অশ্নীল ও উস্কানিমূলক বক্তব্যের কারণে ধর্ষণ বাড়ছে। কারণ ওইসব বক্তব্য সাধারণ মানুষ বেশি শোনে। গাড়ির চালকরাও এসব শোনে। এক্ষেত্রে সরকার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। অথচ সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা লিখলে বা বললেই তাকে ৫৭ ধারায় গ্রেফতার করা হচ্ছে।
যানবাহনে ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর বর্বরভাবে হত্যা বেড়েছে। কারণ চালক, হেলপাররা জানে অপরাধ করেও তাদের নেতার কারণে তারা পার পেয়ে যাবে। সরকারের মধ্যেই আছেন সেই নেতা। সেই শ্রমিক নেতা বাস-মালিক সমিতিরও নেতা, ইউনিয়নের নেতা। তিনি ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, বাস-ট্রাকের শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। তাহলে তারা আন্দোলনের হুমকি দেন। এজন্য সরকারও কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই চালক-হেলপাররা নিজেদের অনেক শক্তিশালী মনে করে এবং অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়।
খুশি কবির
লেখক: সমন্বয়কারী, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নিজেরা করি
সৌজন্যে: দৈনিক সমকাল