কোনো কিছু আমার ভাবার সবচেয়ে বড় বিপদ হচ্ছে, সেটি পাহারা দেওয়া লাগে। এই যেমন অনেকে আমাকে বলে ভালো ভালো কবিতাগুলো ফেসবুকে দাও লোকে চুরি করে নিয়ে যাবে না? আমি বলি, লোকে চুরি করতে (ভাবতে) হবে কেন, এমনিই নিয়ে নিক না। আমি ওগুলো রেখে কী করব?
সেদিনের একটি ঘটনা বলি। একটি ভারী ব্যাগ সিঁড়ির নিচে রেখে আমি বাজারে গেছি, বাজার থেকে কী জানো মনে করে আবার চলে গেছি আরেক জায়গায়, ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ব্যাগের কথা মনে ছিল, একইসাথে ভেবেছিলাম, ব্যাগটি ওখান থেকে কেউ নিয়ে নেবে এই সম্ভাবনা খুবই কম। প্রথমত, এরকম মানুষ কম, দ্বিতীয়ত, সবাই ভাববে আশেপাশেই এটার মালিক আছে এবং এটা এমন কিছু মূল্যবানও নয় নিশ্চয়ই। ফিরে এসে ব্যাগটি আমি পেয়েছি, কিন্তু ততক্ষণে ও বাড়িতে তুলকালাম ঘটে গেছে! পাঁচ ছয় ঘণ্টা ধরে ব্যাগটি ওখানে পড়ে থাকায় সবাই ভেবেছে নিশ্চয়ই জেএমবি ওখানে ওভাবে বোমা রেখে গেছে। হাকডাক দিয়ে কাউকে না পেয়ে অবশেষে ওরা ব্যাগটির আংটায় বাস ঢুকিয়ে একটা নির্জন জায়গায় রেখে এসেছে।
ফলে ফিরে এসে আমাকে কাঠ গড়ায় দাঁড়াতেই হল। অনেক মানুষ যখন একটা কিছু যুক্তি বা যুক্তিহীনভাবে বুঝাতে চায় তখন পাল্টা যুক্তি দেওয়ার কোনো মানে হয় না। তবে আমি একটি বাক্যে তাদের ঠাণ্ডা করতে পারলাম, বললাম, কারো কিছু না বলে নেওয়ার অধিকার আমার নেই, তাই বলে কিছু ফেলে যাওয়ার অধিকারও কি আমার নেই? পকেট থেকে আমি মোবাইলটা বের করে বললাম, এই মোবাইলটা যদি এখানে ফেলে রেখে যাই, তাহলে কি এভাবে সবাই হাকডাক করবে, বোমা ভেবে কেউ নির্জন স্থানে ফেলে আসবে? আসবে না।
তাহলে ব্যাগটি নিয়ে কেন এই চিন্তা? ব্যাগটি নিয়ে এরকম চিন্তার পিছনে সবচেয়ে বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে— নিশ্চয়ই ব্যাগের মধ্যে মূল্যবান কিছু নেই, এরপর চিন্তা এসেছে জেএমবি বোমা ফেলে যেতে পারে। কারণ, এভাবে নিশ্চিন্তে কেউ ব্যাগ রেখে যেতে পারে সেটি চিন্তা করাটাই আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এত অবিশ্বাস মানুষের প্রতি মানুষের?! এরাই তো আবার ঈশ্বর বিশ্বাস করে প্রবলভাবে!! মেলে না মোটেও। ঐ ভবনের পঞ্চাশ-ষাট জন মানুষের মধ্যে একজনও জোর দিয়ে ভাবতে পারল না যে, নিশ্চয়ই কেউ না কেউ ব্যাগটা রেখে গিয়েছে। ব্যাগে তো তালাও ছিল না, কারো একটু খুলে দেখার সাহস পর্যন্ত হল না! তাহলে কতটা অবিশ্বাস আর আশংকার মধ্যে আমরা বাস করি ভাবা যায়! এই মানুষের কাছ থেকে ঔদার্য-সৌন্দর্য-উদারতা আশা করি কীভাবে?
প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কেন ব্যাগটি ওভাবে রেখে গিয়ে নিশ্চিন্ত থাকলাম। এর কারণ দুটো—
১. মানুষের প্রতি আমার এখনো অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস;
২. ‘আমার’ ভাবনাটা আমার মধ্যে খুব দুর্বল। নিয়ে গেলে যাক—এরকম একটা ভাবনা সব সময় আমার আছে।
আসল কথা হচ্ছে, মুক্ত থাকা। অনেকে এখনো বলে, “চাকরিটা না ছাড়লে এখন একটা পাঁচতলা বাড়ি থাকত তোমার।” আমি তাদের বলি, “ঐ পাঁচতলা বাড়িটা ব্যবস্থাপনা করতে এবং পাহারা দিতে আমার সত্তা এবং স্বাধীনতা শেষ হয়ে যেত।”
আধুনিক যুগের মানুষ কেন প্রচার এবং খ্যাতির পিছনে ছোটে? এটি নিশ্চয়ই গবেষণার বিষয়, তবে মোটা দাগে সহজ উত্তর খুঁজে বের করা যায়। মানুষ অবচেতনে বুঝে গেছে, খ্যাতি এমন এক সম্পদ যা পাহারা দেওয়া লাগে না। এটিকে (খ্যাতি) সুন্দরভাবে বলা যায় স্বীকৃত জ্ঞান বা কোনো অর্জন (লিগেসি তৈরি করা)। ‘সফলতা’ এমন এক সম্পদ যা পাহারা দেওয়া লাগে না। ঠিক এ কারণেই টাকা বা সম্পদ গচ্ছিত করার চেয়ে সফল হওয়া বেশি জরুরী। সফল হওয়া মানে, ভালো কিছু, বিশেষ কিছু করে মানুষের মাঝে জায়গা করে নেওয়া। টাকার অভাবে অনেক কিছু করা যায় না— এটা যেমন সত্য আবার অভাব মানুষকে দিয়ে বিশেষ বিশেষ অনেক কিছু করিয়েও নেয়— এটাও সত্য। তাই অভাবের কারণে কিছু হচ্ছে না— এই চিন্তা নিয়ে চুপ করে বসে থাকার চেয়ে শূন্য হাতে যা করা যায় তা-ই করতে থাকা উচিৎ নিবিড়ভাবে।
সব কথার শেষ কথা হচ্ছে, শিক্ষা— ভাবাদর্শমূলক শিক্ষার বিস্তার যদি সামাজিকভাবে প্রতিটি ঘরে ঘরে, হাটে-মাঠে-বন্দরে পৌঁছে না যায়, তাহলে পারিবারিক এবং সামাজিক দর্শন তৈরি হয় না, সমাজ সুন্দর হয় না। প্রতি মুহূর্তে দায়িত্ববান হওয়ার জন্য, প্রতি মুহূর্তে দার্শনিক ঔদার্যের জন্য, প্রতি মুহূর্তে মুক্তির জন্য শিক্ষা দরকার, এবং সে শিক্ষা অবশ্যই শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, এ শিক্ষার বিচরণ থাকা দরকার আমাদের পরিবারে, পরিবেশে, চারপাশে। সে শিক্ষা বিস্তারের ভার নেবে কে?
দিব্যেন্দু দ্বীপ
সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
সম্পাদক, ফলোআপনিউজ