ইউরোপীয় রেনেসাঁর পূর্বে শিক্ষার দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল অতীন্দ্রিয়বাদে প্রোথিত। মানুষ জানবে কেন? বুঝবে কেন? জ্ঞান লাভ করবে কেন? এই সবগুলো কেন-র জবাব প্রাচীন জগত দিয়েছে— কোনো এক অলৌকিক সত্তায় তাকে বিশ্বাসী হতে হবে। যেহেতু মানুষের মন চঞ্চল, ইন্দ্রিয় অসংযত, তাই তাকে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে দৈনন্দিন শৃঙ্খলার মাধ্যমে এই বিশ্বাসকে চিত্তে-চেতনায় স্থির করতে হবে, কোথাও তাকে সকল কিছু সমর্পণ করতে হবে। এই সমর্পণের পাত্রটি কোন যুগে কোন সমাজে বহু দেবতা, কোন সমাজে এক আল্লাহ, কোন সমাজে অনিবার্য অপ্রতিরোধ্য জন্মান্তরবাদ। একটি শৃঙ্খলার মাধ্যমে একটি কিংবা বহু বিদেহী সত্তার প্রতি স্থির বিশ্বাসী করে তোলাই ছিল প্রাচীন পৃথিবীর শিক্ষাদর্শনের মূলকথা।
প্লেটো গ্রিসে গার্ডিয়ানদের যে শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশ করেছিলেন, তার চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল পরমসত্তার স্বরূপ উপলব্ধি। তিনি মনে করতে বাধ্য হয়েছিলেন, পরমসত্তার বিষয়ের জ্ঞানের বলেই মানুষের সুস্থ সমাজ সৃজন সম্ভব। প্রাচীন ভারতে ব্রক্ষ্মজ্ঞানকে ধরা হত সকল জ্ঞানের কাণ্ড— আর সব জ্ঞান ডাল-পালা বিশেষ। বৌদ্ধযুগে শিক্ষা বলতে বোঝাত নির্বানের শিক্ষা। ইসলামিক জগতে কোরআনে অখণ্ড আস্থা স্থাপন এবং পরকাল-পরলোকে নির্দ্বন্দ্বে বিশ্বাস করার যে শিক্ষা দেয়া হত তাই আদর্শ শিক্ষা বলে বিবেচিত হত। মধ্যযুুগের খ্রিস্টান ইউরোপের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাই তো ছিল মা মেরির পুত্র যিশুর ঈশ্বরের সন্তানত্বে এবং বাইবেলের অলৌকিকত্বের প্রতি কোনরকমের প্রতিবাদহীন অন্ধ আনুগত্যের এক ‘মৌমাছী চক্র’।
আবার সে সকল মানুষকে অবতার পয়গম্বর সম্মান দেয়া হয় এবং যাঁরা মুনষ্য জাতির শিক্ষক বলে পরিগণিত হয়ে আসছেন, তাঁদের সকলের বিষয়ে একটি নিরেট সত্য, তাঁরা পরমতত্ত্বজ্ঞানী এবং একভাবে না একভাবে পরমসত্তার বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেছেন বলা হয়ে থাকে। মনুষ্য জাতির শিক্ষক এই পয়গম্বর-অবতারদের বিষয়ে আরো একটি সাধারণ সত্য, তাঁরা পতিতপাবন বা দরিদ্রজনের বন্ধু বলে আখ্যায়িত হয়েছেন। পরমেশ্বর-বিষয়ক জ্ঞান দিয়ে তাঁরা দরিদ্র জনগণের উপকার করেছেন। উপকার করেছেন সংশয়ের স্থালে বিশ্বাস দিয়ে এবং বেঁচে থাকার প্রেরণা যুগিয়ে।
সুতরাং লোকাতীত ইন্দিয়াতীত সত্তায় বিশ্বাস এবং নির্ভরশীলতাই হল প্রাচীন জগতের শিক্ষাদর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। গ্রিসে তার এক রূপ, চীনে এক রূপ এবং আরবে আরেক রূপ। মানুষের কেজো শিক্ষাকে নেহায়েত মামুলি ব্যাপার ধরে নেয়া হত। এমনিক যে সকল বিদ্যা এবং তত্ত্বজ্ঞান আহরণে রীতিমত সুক্ষ্মদর্শিতার প্রয়োজন— তাও মনে করা হত দেবতা কিংবা আল্লাহর কৃপাতেই সম্ভব হচ্ছে। মানুষের হাত-পা চালানো, মগজ-মন খাটানোর প্রক্রিয়া আয়ত্ত করাকে কখনো অভিজাত শিক্ষার পর্যায়ে স্থান দেয়া হয়নি। মানবশিশুর সঙ্গে পশুশিশুর প্রভেদ স্বল্প। মানুষ যেমন খায় দায়, ঘুমোয়— পশুও ওসব কাজ করে। সুতরাং কোন দাম নেই। যদিও বা কখনো মানুষের মন-মগজের ভূমিকা স্বীকার করা হয়েছে, তাও হয়েছে এ কারণে যে দেবতার মূর্তি নির্মাণে ওগুলো কাজে আসে, আল্লাহর মহিমা কীর্তনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে ও-সকল কর্ম। প্রাচীন পৃথিবীর ধারণা অনুযায়ী পৃথিবীর মানুষের জীবনধারণ একভাবে না একভাবে দৈবের উপর নির্ভরশীল। তাই তার জৈব কর্ম, জৈবসৃষ্টিও দেবকাজে নিয়োজিত হয়ে প্রশংসনীয় হয়, অমরত্ব লাভ করে। মানুষ জীব, তাকে দেবতা করে তোলা যায় এবং তা সম্ভব একমাত্র ভক্তি বিশ্বাসের বলে। কোনরকমের প্রশ্নশীলতার স্থান নেই। তাই প্রাচীন পৃথিবীর যে শিক্ষাদর্শন, তার মূল প্রতীতিই হল দৈবের প্রতি মানুষকে আস্থাশীল করা। দৈব উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মন-মগজের শ্রম নিয়োজিত করাতেই জীবনের সার্থকতা।
২
ইউরোপীয় রেনেসাঁর ফলে মানুষের অনেক বিষয়ের সংস্কার যখন বীজপত্রের মত খসে গেছে এবং সমগ্র জগত প্রপঞ্চ সূক্ষাতিসুক্ষ্ম নিয়মের অধীন, নিয়মগুলোকে অধিগত করলেই মানুষের মঙ্গল, এই বোধ ধীর কিন্তু নিশ্চিতভাবে যখন মানুষের মনে প্রভাব ফেলেছে, তারপর থেকেই প্রাচীন শিক্ষাদর্শনের ভিত নড়ে ওঠে। মানুষের জাগতিক অস্তিত্ব আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে জাগতিক কেজো জ্ঞান এবং বিদ্যা, অধিবিদ্যার আসন দখল করে। কেজো বিদ্যার চর্চাই পৃথিবীতে অচিন্তিতপূর্ব যুগান্তর এনেছে। প্রাচীন পৃথিবীর হাড়গোড়ের উপর নতুন একটি পৃথিবী প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। প্রাচীন শিক্ষাদর্শনের নিরিখে ছিল মানুষের সঙ্গে পরম সত্তার সম্পর্ক নিরূপণ। কিন্তু নতুন শিক্ষাদর্শনের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়াল, মানুষে মানুষে যে সামাজিক সম্পর্ক তার প্রকৃত ভিত্তি নির্ণয়। পাশাপাশি প্রাচীন শিক্ষাদর্শনও বেঁচে রইল, কিন্তু তার দাপট অবশিষ্ট রইল না, বেঁচে রইল গাছের মরা ডালের মত হয়ে। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে ধর্মগুরু যে কারণে পতিতপাবন বা দরিদ্রজনের বন্ধু বলে খ্যাত হয়েছেন, মানুষের প্রতিটি বৃত্তির বিশ্লেষণ করে, পরিবেশ বিচার করে মানুষে মানুষে যে সহজ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন তার স্থান অধিকার করল নানানধরনের মানবিক বিদ্যা। বস্তুত একজন বিশ্বাসী মানুষ ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে যে ধরনের নির্মল আনন্দ অনুভব করেন, একজন ধর্মবিশ্বাসহীন মানুষ উন্নত সাহিত্য পাঠেও একই ধরনের আনন্দ পেয়ে থাকেন।
৩
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় রেনেসাঁর পূর্বে যে শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য ইউরোপ সামাজিকভাবে সংগ্রাম করে আসছিল, তা শিক্ষার দর্শনের ক্ষেত্রে আরেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়। যন্ত্র চালু রাখার জন্য যন্ত্রপাতিতে শিক্ষিত মানুষের প্রয়োজন, সুতরাং যান্ত্রিক শিক্ষা চালু হল। এই যান্ত্রিক এবং কারিগরি শিক্ষা সামাজিকভাবে মানুষকে একপেশে করে ফেলল। অন্যদিকে কলা এবং মানববিদ্যাসমূহ যন্ত্রের প্রবর্তণের কারণে সমাজজীবনে যে নতুন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা ব্যাখ্যা করতে পুরোপুরি না হলেও বহুলাংশে ব্যর্থ হল। তাছাড়া এই সময়ে গোটা শিক্ষাপদ্ধতি রাষ্ট্রায়ত্ব হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রের সৈন্য প্রয়োজন। সৈন্য হিসেবে শিক্ষার্থীকে শিক্ষিত করে তুলেছে। রাষ্ট্রের ডাক্তার প্রয়োজন, ডাক্তার হিসেবে শিক্ষিত করেছে। রাষ্ট্রের, কারিগর, মিস্ত্রি, শ্রমিক প্রয়োজন। এই প্রয়োজনের অনুপাতে রাষ্ট্র সবকিছু তৈরি করে নিচ্ছে। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক রাষ্ট্রের হৃদপিণ্ডস্বরূপ। তাই রাষ্ট্রের দর্শন এবং শিক্ষাদর্শন অনেক সময়ে সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। তার ফল হয়েছে, প্রতিটি রাষ্ট্র নিজস্ব প্রয়োজনে ইতিহান বিকৃত করে। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি খোলাসা হবে। বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। তার আগে বাংলাদেশের ছাত্রদের পড়তে হত, ইসলামি রাষ্ট্রই হল আদর্শ রাষ্ট্র, ইসলামি রাষ্ট্রের জনক জিন্নাহ্ সাহেব খুব ভালো মানুষ। পাকিস্তানের ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান সবকিছু শিক্ষা দেয়ার সময় কিছু মিথ্যা বলতে হত। বাংলাদেশে জিন্নাহ্ ভাল লোক একথা আর শিক্ষাবিদেরা বললেন না, শিক্ষার্থীরাও শিখবে না। তার বদলে অন্য কাউকে ভাল বলতে হবে— রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ভাষা এবং সাহিত্য ইত্যাদি শিক্ষা দেয়ার সময় প্রয়োজনীয় অদলবদল করে নিতে হবে। আধুনিক রাষ্ট্র শিক্ষাব্যবস্থার পুরো দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু সে রাষ্ট্র যা শিক্ষা দেয় তাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ মিথ্যার মিশেল থাকেই; এই মিথ্যা মারাত্মক, মানুষের মনোবৃত্তিকে বিষিয়ে তোলার ক্ষমতা এর অপরিসীম। কোনো রাষ্ট্রই ধর্মরাজ্য নয়, কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অভিভাবকত্ব অস্বীকার করার কি কোন উপায় আছে? অথচ রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে এই সময়ে একটা বড় রকমের গলদ থাকে। সেটা হল রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সত্যকে বিকৃত করা। ইংল্যান্ডের ছাত্ররা ইংরেজ লেখকের লেখা ইংল্যান্ডের ইতিহাস একরকম করে পড়ে, আবার ফ্রান্সের ছাত্ররা ফরাসি লেখকের লেখা ইংল্যান্ডের ভিন্নরকম ইতিহাস পড়ে। ইল্যান্ডের শাসক শ্রেণি ইচ্ছা করলে খুব সহজেই ফ্রান্সের জনমত ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে, আবার তেমনি পারে ফ্রান্সের শাসককূল। ইংরেজ ঐতিহ্য, ইংরেজি সাহিত্য ইত্যাদির অপমান করেছে ফরাসিরা। একথা অনায়াসে প্রচার করেই গোটা ইংরেজ জাতিকে যুদ্ধক্ষেত্রে তাড়িত করা সম্ভব। একইভাবে ফরাসিরাও তা পারে। এই অহেতুক জাতিগর্ব আধুনিক রাষ্ট্রগুলো নিতান্ত অস্বাস্থ্যকর জেনেও রক্ষা করছে এবং তা করছে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। গত মহাযুদ্ধে হিটলার গোটা জার্মান জাতিকে জার্মান সম্রাজ্যের নামে যতটা উদ্দীপিত করতে পেরেছিলেন, তার চেয়েও বেশি উদ্দীপিত করেছিলেন আর্যরক্ত, আর্যজাতি ইত্যাদি ধুয়া তুলে। যুদ্ধ ঘটে যুদ্ধের প্রয়োজনে, স্বার্থের তাগিদে। সে যুদ্ধকে ভয়াবহ করে তোলার পেছনে, জাতীয় গর্ববোধ, অন্ধ ঐতিহ্যপ্রীতি ইত্যাদির অবদান সর্বাধিক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন ইটালি, জার্মানির নয় শুধু— প্রতিটি রাষ্ট্র সচেতনতায়, এই ধরনের জাতি-আশ্রিত এবং ঐতিহ্য-আশ্রিত নানারকমের অন্ধ বিশ্বাস পোষণ করে রেখেছে। অন্ধ বিশ্বাস থেকেই একগুঁয়ে মনোভঙ্গির উতপত্তি। রাষ্ট্রের ভিত্তি যার ওপর প্রতিষ্ঠিত সে বিশ্বাসের বিপরীত কোন বিষয়ে শিক্ষাব্যবস্থা রাষ্ট্র চলতে দিতে পারে না। অল্প কিছুদিন আগেও মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ডারউইনের আবিষ্কার পড়তে দেয়া হত না, কেননা বাইবেলে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে যে মত প্রচলিত আছে ডারউইনের আবিষ্কারকে সত্যের কাছাকাছি স্বীকার করে নিলেও বাইবেলের মত সত্য হিসেবে আর টিকছে না। প্রাচ্যের দেশসমূহে এই বদ্ধ সংস্কারের প্রভাব অনেক বেশি। রাষ্ট্রীয় দর্শনের সাথে কোন শিক্ষণীয় বিষয়ের সামান্য গরমিল হলেই সেগুলোর পঠন-পাঠন এবং চর্চা বন্ধ করে দেয়া হয়। সব বিষয়ে অবস্থা এরকম দাঁড়িয়েছে যে আধুনিক রাষ্ট্র শিক্ষার পুরো দায়িত্ব গ্রহণ না করলে একদিকে যেমন চলে না— আবার অন্যদিকে রাষ্ট্র শিক্ষাদর্শনকে রাষ্ট্রদর্শনের ছাঁচে বাঁকাতে গিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেকগুলো সমস্যার সৃষ্টি করেছে। গোটা শিক্ষাব্যবস্থা এখন একটা প্রচণ্ড রকমের সংকটের সন্মুখীন। রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে প্রকৃত শিক্ষার একটা বিরোধ রয়েছে। আবার প্রতিটি রাষ্ট্রের শিক্ষার আলাদা রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি মানব জাতির সহজ সম্বন্ধকে অনেকাংশে আাঁটো-সাঁটো করে তুলেছে। একেক জাতিমানব ইতিহাসকে একেকভাবে ব্যাখ্যা এবং বিচার করে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে এর কোনটিই হয়ত সত্যি নয়। কিন্তু এই প্রিয় মিথ্যা প্রতীতি নিয়ে প্রতিটি জাতির গর্বের অন্ত নেই। এই অহেতুক ভেদবুদ্ধি মানুষে মানুষে অবারিত সম্পর্কের পথ রুদ্ধ করে রেখেছে।
এ ছাড়াও শিক্ষাব্যবস্থা ভিন্নদিক দিয়েও সংকটের সন্মুখীন হয়েছে। কারিগরি এবং যন্ত্রবিজ্ঞানে শিক্ষিত ছাত্রগণ সমাজের মানব সম্পর্ক নির্ণয়ের বিষয়ে অজ্ঞই থেকে যান। অনেক সময় এই কারিগরি এবং যান্ত্রিক প্রযুক্তিবিদ্যার শিক্ষার্থী মানবজাতির কল্যাণ-অকল্যাণ নিয়ে চিন্তা করার কোন অবকাশই পান না। তাদের কোন কাজের জন্য যে মানবজাতির কিছু যায় আসে, এ বিষয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না। আর তার অবকাশও নেই। অন্যদিকে মানববাদী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রয়োগের কারণে মানুষের সমাজের স্থুল সুক্ষ্ম কি পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তা প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাবে ব্যাখ্যা বিচার করে সাধারণের কাছে বোধগম্য করে তুলতে পারছে না। তার ফল দাঁড়াচ্ছে, একটি সমাজের মধ্যেই অনেক সমাজ সৃজিত হচ্ছে, অথচ এই অন্তবর্তী সমাজগুলোর মধ্যে কোন সংযোগসূত্র নেই এবং কোন ন্যায় অন্যায়ের জন্য কাউকে দায়ী কারারও কোন পন্থা নেই। রেনেসাঁ পূর্ব-ইউরোপ এবং প্রাচীন পৃথিবীতে যেমন হয়েছিল, তেমনি রাষ্ট্রভিত্তিক, যন্ত্র এবং যান্ত্রিকতাভিত্তিক ও কলভিমানী ব্যক্তিদের অভিমানভিত্তিক অনেকগুলো ডগমা বা বদ্ধ সংস্কার পৃথিবীর শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রভাব বিস্তার করেছে।
ভাবি সুষ্ঠু শিক্ষা দর্শনের মূল কেন্দ্রবিন্দু কি হওয়া উচিত? এককথায়, এর উত্তর দেয়া সহজসাধ্য নয়। সভ্যতার বিস্তার, যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রসার এবং সাক্ষারতার সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রভুত্বপরায়ণ জাতিগুলোর অহংপুষ্ট ধারণায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে। কোন জাতি এককভাবে সভ্যতার একচেটে মুদির দোকানি এই দাবি অদূর কিংবা সুদূর ভবিষ্যতে করতে পারবে না। সভ্যতা কোন দেশ জাতি বা সম্প্রদায় বিশেষের সম্পত্তি নয়— অথচ প্রতিটি তথাকথিত সুসভ্য জাতির মধ্যেই এই সভ্য অভিমান প্রচণ্ডভাবে লক্ষ্য করা যায়। বাইরের দিকে হয়ত দেখা যায় না— গ্লাসিঅরের মত ভেতরের দিকে অনেকদূর সুসংহত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত। মানুষ যা সৃজন করেছে, নিজের বোধ বুদ্ধিকে যতদূর মুক্তি দিতে সম্ভব হয়েছে তা সংকীর্ণ দেশীয়তা আর জাতীয়তার মধ্যে আবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়, অন্যদিকে জৈব প্রয়োজনেই দেশসীমা, জাতিসীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে হচ্ছে। এটা হচ্ছে এই কারণে যে মানবজীবনে চূড়ান্ত লক্ষ্য কি সে বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অক্ষমতা। আগেকার নবী পয়গম্বরেরা মানবজীবনের চরম পরম লক্ষ্য বলতে বুঝতেন পরমসত্তার জ্ঞান। এই কালের মানব জীবনের পরম লক্ষ্য কি? সম্ভবত মানুষের সমস্ত সম্ভাবনা বিকশিত করে তোলাই যদি বলা হয়, আশা করি অন্যায় হবে না। কিন্তু দেশ, জাতি এবং সম্প্রদায় বিভক্ত পৃথিবীতে মানুষের সমস্ত সম্ভবনার বিকাশ সাধন সম্ভব নয়, যেমন উপজাতীয় সমাজে যন্ত্রবিজ্ঞানের কল্পনা করা অসম্ভব ছিল। মানবজাতি এক, তাদের স্বার্থ, কল্যাণ এক এবং অবিচ্ছিন্ন। সমস্ত মানুষকে এক জাতিভুক্ত, গোটা পৃথিবীকে একটা রাষ্ট্রের আওতাভুক্ত, মানুষের সমস্ত প্রবৃত্তিকে কোনরকমের পূর্বসংস্কার ব্যতিরেখে নির্মোহভাবে অস্তিত্বের প্রয়োজনীয় ধরে নিয়ে, জীবন আরো সুন্দর, মানুষ আরো ভাল এবং স্বাধীনতা আরো কাঙ্ক্ষিত ধন— কোনরকমের স্বর্গ-নরকের ভয়ভীতিহীন জীবনের নব দর্শনের মধ্যেই রয়েছে আগামীর মহীয়ান শিক্ষাদর্শনের ইঙ্গিত। মানুষের ভবিষ্যত ভালবাসায় এবং ভালবাসার নব নব সূত্র এবং ক্ষেত্র উদ্ভাবনের মধ্যেই কল্যাণশীল শিক্ষার অঙ্কুর সুপ্ত রয়েছে।
শুনুন …