১১ মার্চ ২০১৭ তারিখে ডেইলি স্টার পত্রিকার একটি খবরে বলা হয়েছে, নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেট পরিচালিত মোবাইল কোর্টের বৈধতা নিয়ে করা রিটের রায় খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। রাজউকের একজন নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেট কর্তৃক একজন ব্যবসায়ীকে দেয়া ৩০ দিনের জেলের জের ধরে সেই ব্যবসায়ী মোবাইল কোর্টের বৈধতা নিয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করেন হাইকোর্টে। এতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে : Stating that those provisions of the act that empower executive magistrates to exercise judicial powers are against the fundamental structure of the constitution.
অর্থ্যাৎ, নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক বিচারিক ক্ষমতা অনুশীলন করা একটি অসাংবিধানিক প্রক্রিয়া। বিষয়টি বিশ্লেষন করলে কয়েকটি বিষয় অবশ্যই আলোচনায় আনতে হবে।
আসুন প্রথমে সংবিধানের কতিপয় ধারাতে একটু চোখ বুলিয়ে নিই: সংবিধানের ২২ নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে: রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বচার বভিাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন৷ ১৯৯৯ সালে দায়ের হওয়া মাসদার হোসেন মামলার রায়েও বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ আলাদা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩(১) এ বলা হয়েছে, গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।
আবার অনুচ্ছেদ ৩৫(৩) এ উল্লেখ আছে, ফৌজদারী অপরাধে দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচার লাভের অধিকারী হইবেন।একই অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ ৪ এ বলা হয়েছে, কোন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাইবে না।
উপরিউক্ত ধারাসমূহ মতে ২০০৭ সালে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ হতে পৃথক করা হয়। কিন্তু স্বল্প মাত্রায় কতিপয় অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে আমলে নিয়ে নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেটদের সীমিত বিচারিক ক্ষমতা রাখা হয়েছ ‘মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯’ এর মাধ্যমে। এ আইনের ৭ম ধারায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা পদ্ধতিতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ভ্রাম্যমান আদালত অপরাধীর স্বীকারোক্তি এবং দু’জন স্বাক্ষ্যদানকারীর স্বাক্ষ্যদানের প্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ ২ বৎসর পর্যন্ত তাৎক্ষণিকভাবে জেল অথবা আইনানুযায়ী অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করতে পারেন। আবার এও বলা হয়েছে যে, কোন অপরাধী যদি তা স্বীকার না করে তবে তার উপযুক্ত ব্যখ্যার আলোকে সেই ব্যক্তি অব্যাহতি পেতে পারেন। আর সন্তোষজনক ব্যখ্যা না পাওয়া গেলে ক্ষেত্রবিশেষে ঐ মোবাইল কোর্ট তাকে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার অধীনে মামলা দায়ের সাপেক্ষে সোপর্দ করতে পারেন।
উপরিউক্ত সাংবিধানিক বিধি-বিধানসমূহ এবং মোবাইল কোর্টের বিধানে কিছুটা অসামঞ্জস্য দেখা দেয়াতে অনেকদিন ধরেই মোবাইল কোর্টের বৈধতা নিয়ে বেশ বিতর্ক চলে আসছে। প্রধানত, দুটি যুক্তির আলোকে একে কেউ কেউ অবৈধ বলে আসছেন। প্রথমত, মোবাইল কোর্টে আত্নপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ নেই। কিন্তু মোবাইল কোর্ট আইনে তাৎক্ষণিকভাবে আত্নপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। সীমাবদ্ধতা বলতে এখানে কেবল কোন উকিল (যাকে বাংলায় বলা যেতে পারে আইনগত সাহয্যকারী) নিয়োগ দেবার সুযোগ অপরাধীর থাকছে না। দ্বিতীয় যুক্তিতে বলা হয় যে, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর কীভাবে নির্বাহী বিভাগের একজন প্রতিনিধি বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। দ্বিতীয় যুক্তিটির ব্যখ্যায় যাবার আগে আলোচনা করে নেয়া যাক আমাদের দেশের অপরাধ সংস্কৃতির ধরণ ও কিছু বাস্তবতা নিয়ে।
বাংলাদেশের অপরাধ সংস্কৃতির ধরন ও সামাজিক অপরাধে ভ্রাম্যমান আদালতের ভুমিকা:
বলা হয়ে থাকে, আইন হলো পোশাকের মতো একটি ব্যপার যা তৈরী করা হয় মানুষের গায়ের মাপে। এর উল্টোটা, অর্থ্যাৎ, পোশাকের মাপ অনুযায়ী যদি মানুষকে কোন পোশাক পরতে বলা হয় তাহলে হয় পোষাকটা ফেটে যাবে অথবা মানুষটাকে বেমানান লাগবে। এতে পোষাকের আসল উদ্দেশ্যই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
বিশ্বের প্রত্যেকটি জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী আইন তৈরী করে থাকে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের যুগ পার করার পর প্রায় সব উপনিবেশিক দেশের আইনি কাঠামো মৌলিক বৃটিশ কাঠামোর ভিত্তিতে দাড়িয়ে থাকলেও পরিবর্তন এসেছে নিজস্ব ভঙ্গিতে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো, কলোনি শাসনের অবসানের পরপরই বৃটিশ ভূমি ব্যবস্থাপনা আইনের ব্যপক সংস্কার আনেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। অবসান ঘটে সুদীর্ঘ ফিউডালিজম তথা সামন্তবাদের। এমন অজস্র উদাহরণ মিলবে সারা পৃথিবীতে। এবার আসি বাংলাদেশের অপরাধ-সংস্কৃতির দিকে। অপরাধকে আইনের দৃষ্টিতে দুই ভাগে ভাগ করা যায়: ফৌজদারী (ক্রিমিনাল) ও দেওয়ানী (সিভিল) অপরাধ।
যুগ যুগ ধরে এসব অপরাধের বিচার চলে আসছে জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যে প্রক্রিয়াটি অনেক বেশী সময় সাপেক্ষ ও জটিলতাপূর্ণ। এ দুই ধরণের অপরাধের বাইরে একটি তৃতীয় মাত্রার অপরাধ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে আমাদের সমাজে। তা হলো সামাজিক অপরাধ (সোস্যাল ক্রাইম)। একটি সমাজের মূল্যবোধ, সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা যত হ্রাস পেতে থাকে, তত বাড়তে থাকে সামাজিক অপরাধের মাত্রা। বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাব, রাজনৈতিক সংস্কৃতির দ্রুত পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সীমিত সম্পদের দ্বন্দ্ব প্রভৃতি নানা কারনে সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষয়িষ্ণুতার ফলে সামাজিক অপরাধের এ ক্রমবৃদ্ধি লক্ষণীয়। আজ তাই ইভটিজিং (যা কিনা ধর্ষন, এসিড নিক্ষেপ বা আত্নহত্যার মত মারাত্নক পরিণতি ডেকে আনে), মাদকাসক্তি, খাদ্য ও অষুধের মত অতি সংবেদনশীল দ্রব্যে ভেজাল দেয়া, সামাজিক নিপীড়ণ ও জননিরাপত্তা, পরিবেশ দূষণসহ অজস্র সামাজিক অপরাধ বেপরোয়াভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।
দিনদিন মারাত্নক এসব অপরাধ বেড়ে যাওয়াটা উন্নয়নশীল জাতি হিসেবে আমাদের টেকসই উন্নয়নের পথে এক বিরাট অন্তরায়। উন্নয়নের প্রাণ হলো সমাজ, সমাজের মানুষ। আর সেখানে সামাজিক অপরাধ সমাজিক শৃঙ্খলাকেই যদি গ্রাস করে নেয়, সেখানে উন্নয়নের ধারণাটিই আসলে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
এসব সামাজিক অপরাধ প্রতিরোধে বর্তমান বিচার ব্যবস্থায় আসলে তেমন কার্যকরী কোন ব্যবস্থা নেই। একটি মেয়ে ইভটিজিং-এর স্বীকার হবার পর একজন অভিভাবক কোন ক্রমেই আইনী প্রক্রিয়ায় যেতে চায় না তার মেয়েটির মান-সম্মানের ভয়ে কিংবা দীর্ঘ, জটিল ও ক্লান্তিকর বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতি অনাস্থার কারণে। একজন ভোক্তা তার ভোক্তা অধিকার আইনের সুরক্ষার কথা আসলে জানেও না। আর জানলেও বিষাক্ত খাবার কিংবা ওষুধের ফলে নীরব বিষাক্তকরণের স্বীকার হয়েও চুপ করে থাকে এই ভেবে যে, থাক, কেউ তো কথা বলে না, আমি একা বলে আর কী হবে? লক্ষ লক্ষ প্রবাসীরা বিমান বন্দরে লাঞ্চনার স্বীকার হয়েও মুখ বুজে, চোখের জল ঝরিয়ে ঈশ্বরের দরবারে নিশ্চুপ বিচার জানিয়ে মাথা নিচু করে চলে আসে। আর ইভটিজিং এর শিকার মেয়েটি কখনও কখনও খুব নীরবে ঝুলে পড়ে সিলিং ফ্যানে বাঁধা দড়িতে।
ঠিক এমনি এক অস্থির সময়ে ভ্রাম্যমান আদালত হয়ে ওঠে জনগণের কাছে আস্থা ও সুবিচারের জায়গা। অতিষ্ট জনগন খুঁজে পায় স্বস্তির জায়গা। আজ বিমান বন্দরে প্রবাসীরা কোন অবিচারের শিকার হলে সাথে সাথে পেয়ে যায় ম্যজিস্ট্রেটের কাছে ‘ন্যয্য বিচার’, আমাদের কোন কন্যা সিলিং ফ্যানে ঝোলার আগেই অনেক ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমান আদালতের ভয়ে এলাকার বখাটেরা গুটিয়ে নেয় তাদের মোক্ষম পৌরুষ। কালো ওষুধ ব্যবসায়ীরা কিংবা অবৈধ প্রিজারভেটিভ ব্যবসায়ীরা আজ তটস্থ আইনী ভীতিতে।
আজ মোবাইল কোর্ট প্রচলিত আইনী কাঠামোর বাইরে গিয়েও (অবশ্যই আইনসম্মতভাবে) সামাজিক অপরাধ দমনের এক শক্তিশালী ও জন-নন্দিত হাতিয়ার হয়ে ওঠেছে। আর এর আইনী ভিত্তি স্বরুপ ’মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইনের একেবারে শুরুতে বলা হয়েছে: আইন শৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রমকে কার্যকর ও অধিকতর দক্ষতার সহিত সম্পাদন করবিার জন্য মোবাইল র্কোট পরিচালনার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় বিধান করিবার লক্ষ্যে প্রণীত আইন।
স্পষ্টতই আইনটি আইন শৃঙ্খলা রক্ষার প্রক্রিয়াটিকে অধিক কার্যকর করার উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনটির ধারা-৩ এ বলা হয়েছে,
আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলী র্কাযকর হইবে।
এছাড়াও, এ আইনটির ধারা-২ এ সংজ্ঞায়নে নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেটদের পাশাপাশি জুডিশিয়াল ম্যজিস্ট্রেটদেরকেও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার বিষয়ে এখতিয়ার দেয়া হয়েছে।
এখন প্রশ্ন আসে, যেহেতু বিচার বিভাগ পৃথক, তাহলে বিচারিক ক্ষমতা কেন নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেটদের অধীনে থাকবে? প্রশ্নটি খুবই যৌক্তিক।
এক্ষেত্রে আমার মতামতগুলো হলো: প্রথমত, মোবাইল কোর্ট থাকাটা সমীচীন কিনা? সামাজিক অপরাধ বিশ্লেষনের আলোকে এটি একটি সময়ের দাবি। তার মানে, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে জনগণ চাইলে এটি প্রয়োজনীয় আইনী ও সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে এটিকে স্থায়ী রুপ দেয়া যেতেই পারে। এরকম প্রয়োজন মাফিক বিশেষ বিধান সরকারি চাকরি লাভের অধিকার সংক্রান্ত ২৯ অনুচ্ছেদেও উল্লেখ আছে।
২৯ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: প্রজাতন্ত্ররে কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। ২৯ (২) এ বলা হয়েছে, কেবল র্ধম, গোষ্ঠী, র্বণ, নারী-পুরুষভদে বা জন্মস্থানরে কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্ররে র্কমে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রর্দশন করা যাইবে না।
অথচ অনুচ্ছেদ ২৯(৩)এ বলা হয়েছে, এই অনুচ্ছদেরে কোন কিছুই-
(ক) নাগরকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইত,
(খ) কোন র্ধমীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত র্ধমাবলম্বী বা উপ-সমপ্রদায়ভুক্ত ব্যক্তদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান-সংবলতি যে কোন আইন র্কাযকর করা হইত,
(গ) যে শ্রেণীর কর্মে বশিষে প্রকৃতরি জন্য তাহা নারী বা পুরুষরে পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরুপ যে কোন শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হইত, রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।
দ্বিতীয়ত, মোবাইল কোর্ট কারা পরিচালনা করবে? অবশ্যই আইনগতভাবে এ বিচারিক ক্ষমতা কেবল বিচারিক ম্যজিস্ট্রেটগণ লাভ করেন। কিন্তু, এটি কেবল বিচারিক ম্যজিস্ট্রেটদের অর্পণ করার পূর্বে কতিপয় বিষয়ের আইনী নিশ্চয়তা দেয়া খুব জরুরী যা না দিলে পুরো আইন-শৃঙ্খলা কাঠামো ভেঙ্গে পড়বে।
১)এজলাসের বাইরে বিশাল জনগোষ্ঠীকে সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনাকারী যথেষ্ট সংখ্যক বিচারিক (জুডিশিয়াল) ম্যজিস্ট্রেটের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। সেক্ষেত্রে, এটাও খতিয়ে দেখতে হবে যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক যোগ্য প্রার্থী নিয়োগ দেয়াটা এই মূহুর্তে কতটা বাস্তব সম্মত।
২)বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগ চালু, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা ও যথেষ্ট সংখ্যক আসন সৃষ্টি করা।
৩) নির্বাহী বিভাগকে ঐতিহ্যগতভাবে প্রদান করে আসা কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বাস্তবায়নের সঠিক আইনী ও বাস্তবিক নিশ্চয়তা প্রদান ও তা বাস্তবায়ন করা।
৪)নির্বাহী বিভাগকে মাঠ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে আইনী ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে তার বাস্তবায়নের বিকল্প কার্যকরী ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
৫) সহকারী কমিশনার (ভুমি) পদটির বিকল্প দক্ষ, বাস্তবমুখী পেশাদারী লোকবল তৈরী করা।
৬) সুস্পষ্ট আইনের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব, ক্ষমতা ও কার্যসীমা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে দেয়া ও তা বাস্তবায়নের পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো সৃষ্টি করা।
সবশেষে আসে বিশেষজ্ঞতার প্রশ্ন। একজন নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেট তো আইনের উপর কোন ডিগ্রি নিয়ে চাকরিতে আসে না। তাহলে সে কীভাবে আইন প্রয়োগ করবেন? প্রশ্নটি খুবই যৌক্তিক। কিন্তু কথা হলো আমাদের সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রত্যেকটি স্তরেই কি স্পেসালাইজেশনের ব্যপারটি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে? আর তা করা হলে তো বাংলা সাহিত্যে পড়ে কেউ ব্যাংকে চাকরি করতে পারতো না, কিংবা ৬ মাসের কারিগরী প্রশিক্ষণ নিয়ে কেউ সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের কাজ করতে যেত না।
একই যুক্তি খাটে পুলিশের মত একটি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাঠামো নিয়ে। উন্নত বিশ্বে পুলিশিং-এর জন্য বিশেষ একাডেমি রয়েছে যেখানে খুব প্রাথমিক পর্যায় থেকেই তাদেরকে পেশাদারি পুলিশ হিসেবে গড়ে তোলা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে স্পেশালাইজেশনের সেই জায়গাটি এখনও গড়ে ওঠেনি। তবুও পুলিশ একাডেমিতে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ নিয়েই একজন পুলিশ মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে দক্ষতার সাথেই। তাদের আইন প্রয়োগ নিয়ে তো কোন প্রশ্ন ওঠে না? আমরা উন্নয়নশীল জাতি হিসেবে ক্রমশ স্পেশালাইজেশনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এর জন্য দরকার সময়, অবকাঠামোগত উন্নয়ন আর দক্ষ জনগোষ্ঠী।
একজন বিসিএস (প্রশাসন) এ নিয়োগপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেটও কিন্তু মৌলিক আইন ও প্রশাসন সম্পর্কিত নানারকম উন্নত মানের প্রশিক্ষণ লাভ করে থাকে চাকরি জীবনের শুরুতেই। তাই আপাতত মামলাজট কমানো, তাৎক্ষণিকভাবে অল্প পরিসরে কিছু অপরাধ আমলে নিয়ে তারা বরং বিচার বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সহায়কগোষ্ঠী হিসেবে কাজ করতেই পারে।
স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর হলেও যেহেতু বিচার বিভাগ আলাদা হবার মত একটি সাহসী উদ্যোগ বাংলাদেশ সরকার নিতে পেরেছে, সেহেতু আরেকটু সময় নিয়ে কোন একদিন হয়ত বিচার বিভাগ এক মহীরুহ হয়ে সকল অপরাধ প্রবণতা কমাতে একটি বিশেষায়িত বিভাগ হিসেবে ঠিকই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।
একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে রাতারাতি পরিবর্তন না করে, বরং ধীরগতির একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা মোতাবেক টেকসই সংস্কারই গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে কাম্য। বিচারিক ক্ষমতা যার হাতেই থাকুক না কেন, সুশাসন নিশ্চিত করতে গেলে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় নির্বাহী ক্ষমতার জায়গাটির ভীত দূর্বল করে দিলে প্রকৃতপক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারই দূর্বল হয়ে পড়ে।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ তত্ত্বে কোন ভুল নেই নিশ্চিত। কিন্তু, আইনের শাসন ও সুশাসন নিশ্চিতকল্পে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ যেন আবার লাগামহীন হয়ে না পড়ে সে দিকেও নজর দেয়াটা জরুরী। আর এ বিকেন্দ্রীকরণে নির্বাহী বিভাগের নির্বাহী ক্ষমতার জায়গাটি ক্ষুন্ন করারটা কতটা সমীচীন হবে সে ভাবনার বিষয়টি উন্মুক্ত থাকা উচিৎ প্রত্যেক নাগরিকের কাছে।
প্লাবন ইমদাদ
পি.এইচ.ডি. গবেষক (সোস্যল পলিসি),
Åbo Akademi University, ফিনল্যান্ড।