ঈশান গোপালপুর গণহত্যা: নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল ২৮ জন নিরীহ মানুষকে

follow-upnews
0 0

১৯৭১-এ পাকিস্তানি বাহিনী এবং এদেশে তাদের দোসরদের দ্বারা যে ভয়াবহ গণহত্যা ঘটেছিলো, তার কিয়দংশও কোথাও সংরক্ষিত হয়নি, বেদনার কথা তো বলাই বাহুল্য। শুধু সংখ্যা বললে আসলে কিছুই বোঝা যায় না, যায় কি? একদল ভয়ার্ত মানুষ— নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ বা যুবা, মৃত্যুভয়ে যে যেদিকে পারে দৌঁড়াচ্ছে, হাঁপাচ্ছে, পিছন ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে … আরেক দল মানুষরূপী হায়েনা অস্ত্র উঁচিয়ে পিছন পিছন ছুটছে, ছোরা চালাচ্ছে, গুলি করছে … লুটিয়ে পড়ছে মানুষ, কেউ কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা যাচ্ছে, কেউ কাঁতরাতে কাঁতরাতে, রক্ত ঝরতে ঝরতে কয়েক ঘণ্টা পরে মারা যাচ্ছে! এরই মধ্যে নারীদের ওপর চালানো হচ্ছে নির্যাতন— অকথ্য নির্যাতন, কোলের শিশু ছুড়ে ফেলে দিয়ে ওরা নারীদের ওপর চালিয়েছিল সব ধরনের বর্বরতা, কোনো শব্দ দিয়ে সে বর্বরতার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। 

এরকমই একটি ভয়াবহ গণহত্যা ঘটেছিলো ফরিদপুরের ঈশান গোপালপুর গ্রামে ঈশান সরকারের বাড়ীতে। ঈশান চন্দ্র সরকারের বাড়ী ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নে একমাত্র জমিদার বংশ। প্রজাবান্ধব জমিদার হিসেবে অঞ্চলে তার খুব সুনাম ছিলো। গড়ে তুলেছিলেন কল্যাণমূলক অনেক প্রতিষ্ঠান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই নিরাপদ ভেবে প্রয়াত ঈশান বাবুর বাড়ীতে অনেক লোক আশ্রয় নিতে শুরু করে। 

বাড়ীর তখনকার স্বত্তাধিকারী আশ্রীত মানুষদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন, অনেক মুক্তিযোদ্ধাও নীরাপদ ভেবে এ বাড়ীতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি গোপন অস্ত্রাগারও গড়ে তোলা হয়েছিলো বাড়ীর একটি গোপন কক্ষে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে একবার ফরিদপুরের রাজাকারেরা বাড়ীটিতে লুটপাটের উদ্দেশ্যে এসেছিলো। বাড়ীর লোকজন এবং গ্রামবাসী প্রতিরোধ করলে তারা পিছু হটে। কিন্তু মনে তারা জিঘাংসা পুষে রেখেছিলো। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ফরিদপুরে প্রবেশ করার পর থেকেই স্থানীয় রাজাকার এবং আলবদর বাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে কোথায় কোথায় হত্যাকাণ্ড চালাতে হবে তার একটি ছক জানায়। মূলত সেই মোতাবেক পাকিস্তানি বাহিনী ফরিদপুরে গণহত্যা পরিচালনা করে।

পাকিস্তানি বাহিনী প্রথম গণহত্যাটি ঘটায় ফরিদপুর শহরের শ্রীঅঙ্গন আশ্রমে। ফরিদপুর শহরে ঢোকার ‍মুখে ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল ফরিদপুরের শ্রীঅঙ্গন মঠে কীর্তনরত হিন্দু সন্ন্যাসীদের ওপর গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যার শিকার হন আটজন সন্ন্যাসী।

একাত্তরে পাকসেনাদের প্রধান ক্যাম্প ছিল তখন ফরিদপুর স্টেডিয়ামে। স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে বর্তমান সেটেলম্যান অফিসের নিচতলায় পুরুষদের এবং দোতলায় নারীদের ধরে এনে রাখা হতো। সেখানে অসংখ্য নিরীহ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদে ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হতো। খুব কমসংখ্যক লোকই সেখান থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন। অধিকাংশ মানুকেই অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে স্টেডিয়ামের পূর্ব পাশে একটি গর্তের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়। ফরিদপুরের জেলা কমান্ডার আবুল ফয়েজ শাহ্ নেওয়াজ জানান, স্বাধীনতার পরে স্টেডিয়ামের অভ্যন্তরে একটি বধ্যভূমি আবিস্কৃত হয়। সেখান থেকে মানুষের হাড়-গোড়, কঙ্কাল, মাথার খুলি, নারীদের শাড়ি-কাপড়ের পঁচা টুকরা এবং শাঁখা-চুড়ির সন্ধান মেলে। জায়গাটি দীর্ঘদিন অরক্ষিত ছিল। (জাগোনিউজ, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৫)

ফরিদপুর সদরের ঈশান গোপালপুর গ্রামের গণহত্যাটি সংগঠিত হয় ১৯৭১ সালের ২ মে— ঈশান গোপালপুর গ্রামের স্থানীয় জমিদার ঈশান সরকারের বাড়ীতে আশ্রয় নেওয়া ২৮ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। হত্যাকাণ্ডের পর পাকসেনারা চলে যাওয়ার পর এলাকাবাসী সরকার বাড়ীর পুকুর পাড়ে ২৮ জনের লাশ গণকবর দেয়। 

২০১০ সালের ২ মে শহীদ পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসীর যৌথ উদ্যোগে সেখানে ২৪ শহীদের নামফলক সহ (৪ জনের নাম এখন পর্যন্ত সংগ্রহ করা সক্ষম হয়নি) একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়।

গণহত্যাটি ছিল অত্যন্ত বেদনাবিধুর— প্রথমে আশ্রীত এবং ধৃত ২৮ জন মানুষকে প্রয়াত ঈশান সরকারের বাড়ীর কাছারি ঘরে রাখা হয়। এরপর দু’জন দু’জন করে বের করে পুকুর পাড়ে অবস্থিত একটি নিমগাছ তলায় নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। দু’জন কে যখন হত্যা করা হচ্ছে তখন বাকী ২৬ জন জানালার ফাঁক দিয়ে সে ‍দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে! এভাবে ২৮ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল সেদিন।


বীনা সাজ্জাদ লক্ষ্মী

ঈশান বাড়ী গণহত্যা
ফরিদপুর জেলার সদর উপজেলার ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের ঈশান গোপালপুর গ্রামে প্রয়াত ঈশান সরকারের বাড়ীতে গিয়ে উজ্জ্বল সরকারের (জমিদার বাড়ীর পঞ্চম প্রজন্ম) কাছ থেকে ’৭১-এ সংগঠিত ভয়াবহ গণহত্যা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছেন গণহত্যা স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটি, ফরিদপুরের সদস্য বীনা লক্ষ্মী সাজ্জাদ এবং কমিটির আহ্বায়ক সাজ্জাদুল হক সাজ্জাদ।
Next Post

শহীদ স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটি গঠনের উদ্যোগ

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সারা বাংলাদেশ জুড়ে সংগঠিত হয়েছিলো ইতিহাসের ভয়াবহ সব গণহত্যা। এ পর্যন্ত সারা দেশে পাঁচ হাজারের বেশি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। বেশিরভাগ বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ বসিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি, অনেক বধ্যভূমিতে উঠে গেছে বসতবাড়ী, মসজিদ/মন্দির, অথবা উপর দিয়ে চলে গিয়েছে রাস্তা। কিছুক্ষেত্রে স্মৃতিস্তম্ভ বসানো হলেও সংরক্ষণের অভাবে […]
গণহত্যা স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটি

এগুলো পড়তে পারেন