Headlines

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাচন কমিশনকে প্রদত্ত স্মারকপত্র

শাহরিয়ার কবির

প্রাণতোষ তালুকদার, ঢাকা সংবাদদাতা

শাহরিয়ার কবির

অবাধ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে গত ২৩ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে নির্বাচন কমিশনকে প্রদত্ত স্মারকপত্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার সমীপে প্রদান করেন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র নেতৃবৃন্দ।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার সমীপে প্রদান করা স্মারকপত্রে উল্লেখ ছিল–

আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে অবাধ, স্বচ্ছ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে এ বিষয়ে জানবার জন্য গত তিন মাসে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকা, বিশেষভাবে যেখানে ধর্মীয় সংঘ্যালঘু সম্প্রদায়ের বেশি ভোটার রয়েছেন সেগুলো সফর করে অত্যন্ত উদ্বেগজনক পরিস্থিতি অবলোকন করেছেন। একদিকে নির্বাচনী প্রচারণার আড়ালে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত এবং তাদের সহযোগী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তিসমূহ বিভিন্ন ধরনের নাশকতার চক্রান্ত করছে। অপরদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় নির্বাচনকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের আশঙ্কায় আতঙ্কের ভেতর দিনযাপন করছেন।

‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ প্রতিষ্ঠার পর সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। এর ভেতর সবচেয়ে সহিংস ছিল ২০০১ সালের ১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের যুদ্ধাপরাধী-মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তি অধ্যুষিত ৪ দলীয় জোটের সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়, বিশেষভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর যে নৃশংস নির্যাতন, হত্যা ও গৃহে অগ্নিসংযোগ সহ যাবতীয় সন্ত্রাসী কার্যক্রম করেছে, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তা ছিল নজিরবিহীন। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ও আমরা দেখেছি ২০০১ সালের মতো ব্যাপকভাবে না হলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাজার হাজার হিন্দু পরিবার আক্রান্ত হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা অগ্রাহ্য করে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য।

আমরা ১৯৯৬-এর সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে রাজাকারমুক্ত সংসদের দাবিতে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অভিযাত্রা’ নামে ব্যাপক প্রচারাভিযান পরিচালনা করছি, সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি নির্বাচকমন্ডলীকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধকরণের জন্য। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আমরা তদন্ত করে দেখেছি দেশের ৯২টি নির্বাচনী এলাকায় সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভোটারের সংখ্যা শতকরা ১২ ভাগ থেকে ৪৮ ভাগ পর্যন্ত, যার অধিকাংশ ঝুঁকিপূর্ণ। অবাধ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনের নিকট আমাদের দাবি–

১) ঝুঁকিপূর্ণ সকল নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচকমন্ডলীর সার্বিক নিরাপত্তার জন্য পূর্বাহ্নে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নির্বাচনমন্ডলীকে হুমকি প্রদানকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

২) জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র আমাদের সংবিধানের পরিপন্থী হওয়ার কারণে ২০১৩ সালে উচ্চতর আদালত এবং নির্বাচন কমিশন জামায়াতকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য ঘোষণা করেছে। দলীয়ভাবে নির্বাচন না করলেও ২০১৩ সালের পর যাবতীয় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা স্বতন্ত্রভাবে কিংবা অন্য দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন এবং কিছু এলাকায় জয়ীও হয়েছেন। জামায়াতের সকল স্তরের নেতা ও সদস্য দলীয় গঠনতন্ত্রের প্রতি অন্য যে কোনও দলের নেতাকর্মীদের তুলনায় বেশি অনুগত। নির্বাচনী প্রচারণায় তারা দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মওদুদিবাদী দর্শন এবং দলের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও কর্মসূচি প্রচার করেন, যা বাংলাদেশের সংবিধান এবং উচ্চতর আদালতের রায়ের পরিপন্থী। নির্বাচন কমিশনের প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি– যে গঠনতন্ত্র বা দলিল আমাদের সংবিধানবিরোধী সে গঠনতন্ত্রের অনুসারীদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য ঘোষণা করুন। জামায়াতের গঠনতন্ত্র ধর্মনির্বিশেষে সকল মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদায় বিশ্বাস করে না। জামায়াতের গঠনতন্ত্র নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদায় বিশ্বাস করে না। এ ধরনের গঠনতন্ত্রের অনুসারী কোনও ব্যক্তি যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তা হবে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে লেখা আমাদের মহান সংবিধানের চরম অবমাননার শামিল।

ক) একই কারণে নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক সকল দলকে ঘোষণা করতে হবে তাদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনও সম্পর্ক নেই।

৩) নির্বাচনে ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক প্রচারণা নিষিদ্ধ হলেও জামায়াতে ইসলামী এবং সমচরিত্রের মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক দলগুলো নির্বাচনের সময় ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে। ওয়াজের নামে কিংবা জুম্মার নামাজে খোৎবার সময় তারা রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান করে। তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের সংবিধানের বিরুদ্ধে, নারীদের বিরুদ্ধে, মুক্তচিন্তার মানুষদের বিরুদ্ধে এবং ভিন্ন ধর্মের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালিয়ে নির্বাচনের সময় সন্ত্রাসের জমিন তৈরি করে। নির্বাচনের সময় এ ধরনের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, সংবিধানবিরোধী এবং ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রচারকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনার জন্য আমরা নির্বাচন কমিশন ও সরকারের নিকট আহ্বান জানাচ্ছি। নির্বাচন স্বচ্ছ করতে হলে নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘনকারীদের বিচার ও শাস্তির বিকল্প কিছু নেই।

৪) একাত্তরের গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অপরাধী অর্ধ শতাধিক ব্যক্তিকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত দণ্ড দিয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীরা মৃত্যুর আগে তাদের সন্তান ও উত্তরাধিকারীদের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছে তাদের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য। আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের সন্তান ও পরিবারের সদস্যরা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ক্রমাগত বিষোদগার করছে এবং ’৭১-এর দণ্ডপ্রাপ্ত গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের মহিমান্বিত করছে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি– ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের সন্তান বা পরিবারের অন্যান্য সদস্য, যারা সর্বোচ্চ আদালতের রায় অগ্রাহ্য করছে তাদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য ঘোষণা করা হোক।

৫) কোনও কোনও দল নির্বাচনে ঢালাওভাবে সেনাবাহিনী নিয়োগ এবং তাদের বিচারিক ক্ষমতা প্রদানের দাবি জানিয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার পরিপন্থী বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী গত এক দশক ধরে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর সদস্য হিসেবে বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ দেশে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। সেনাবাহিনীকে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোনও কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হলে তাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিও ক্ষুণœ হবে।

আমরা আশা করব একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, স্বচ্ছ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্যভাবে সম্পন্ন করার স্বার্থে নির্বাচন কমিশন আমাদের দাবি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।

দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলসমূহ এবং নাগরিক সমাজেরও বহু কিছু করণীয় রয়েছে। এ সব ক্ষেত্রে আমরা নির্বাচন কমিশনকে সব রকম সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি প্রদান করছি।

ধন্যবাদান্তে

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষে

Shahriar Kabir

 

 

(শাহরিয়ার কবির)
সভাপতি, কেন্দ্রীয় কার্যনিবার্হী পরিষদ

সংযুক্তঃ
১. একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাচন সংক্রান্ত প্রকাশনাসমূহ– ১) ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শ্বেতপত্র (৩ খন্ড, পৃ: ২৭৬০), ২) একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন : মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অভিযাত্রা (পৃ: ১৯২), ৩) একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন : জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা (পৃ: ৯৬), ৪) জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৮ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি (পৃ: ৯৬), ৫) নির্বাচনকালে সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধে আইনের সংস্কার (পৃ: ৯৬) ও ৬) নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা (পৃ: ১০৪)। প্রামাণ্যচিত্রঃ ১) ২০০১ সালের নির্বাচন সম্পর্কে SOS এবং ২) ২০১৪ সালের নির্বাচন সম্পর্কে Whither Bangladesh.

২. ২৩ অক্টোবর (২০১৮) মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকে অংশগ্রহণকারী একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দের নাম– ১) বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ২) বিচারপতি নিজামুল হক, ৩) মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন (অবঃ) আলমগীর সাত্তার বীরপ্রতীক, ৪) নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অবঃ) মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ, ৫) লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, ৬) অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ৭) শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, ৮) কাজী মুকুল ও ৯) ব্যারিস্টার নাদিয়া চৌধুরী ।