লিখেছেন দেবজ্যোতি রুদ্র -৮ মার্চ ২০১৬, মঙ্গলবার
আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ তখনো শুরু হয়নি। পাকি. সেনারা তখনো গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছাতে পারেনি। মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছে কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়নি বা তাদের প্রশিক্ষণও শুরু হয়নি। ঠিক সেই সময়ে বাঙালীর স্বাধীনতার প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করতে এক সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হলো, যার নাম দেয়া হয় আল-বদর।
এপ্রিল মাসের শেষদিকে জামায়াতে এছলামী পাকিস্তান (বর্তমান জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং তাদের ছাত্র সংগঠন এছলামী ছাত্রসংঘ (বর্তমান ইসলামী ছাত্রশিবির) -এর নেতা-কর্মীদের সমন্বয়ে জামালপুরে প্রথম গঠিত হয় আলবদর বাহিনী। প্রধান উদ্দেশ্য ছিল— স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধরত বাঙালিকে পাকিস্তানী ভূয়োদর্শনে বিশ্বাসী করে নিজেদের মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য সাধন; যাতে করে কখনো রাষ্ট্রক্ষমতার স্বাদ না পাওয়া দলটি সামরিক জান্তার হাত ধরে কিছুটা হলেও সুবিধা আদায় করতে পারে।
পাকি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশে বদর বাহিনী সার্বিকভাবে জামায়াতে ইসলামী তথা গোলাম আযমের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো। নেতৃত্ব দিতো ছাত্রসংঘ’র পাকিস্তান সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী, পূর্ব পাকিস্তান সভাপতি আলী আহসান মুজাহিদ ইত্যাদিরা। মূলতঃ স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের খুঁজে বের করা; হিন্দুদের বলপূর্বক মুসলমান বানানো; হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ, ঘর-বাড়ী লুঠ ইত্যাদির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক আতঙ্ক সৃষ্টি করে তাদের ঘর-বাড়ী-জমি দখল করা; সেমিনার ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগবিরোধী প্রচারণা চালানো; জামায়াতী তথা মৌদুদীবাদের প্রচার-প্রসার ঘটানো এবং হানাদারদের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা করা ছিল এদের তৎপরতার মূল দিক। বদর বাহিনীর নৃশংসতা জনমনে ভয়াবহ আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি জেলা ও মহকুমায় জামায়াত ও ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে সশস্ত্র বদর বাহিনী গড়ে ওঠে। সর্বত্র এদের নিজস্ব ক্যাম্প ছিল। এসব ঘাঁটিতে ধরে আনা হতো মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ সমর্থক ও হিন্দুদের। ক্রমাগত নির্যাতনের মধ্য দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হতো, আশপাশের গ্রাম-গঞ্জ লুঠ করা হতো। কিশোরী থেকে বৃদ্ধা যে কোন বয়সী মেয়েদের ধরে নিয়ে পাকি ক্যাম্পে ‘গনিমতের মাল’ হিসেবে পাকি সেনাদের বিকৃত কাম চরিতার্থ করতে সরবরাহ করা হতো।
মুক্তিযুদ্ধ যখন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে, পাকিরা বুঝতে পারে এদেশে তাদের দিন শেষ, তখন এই আল-বদর বাহিনী শুরু করে তাদের ‘বাঙালীর মেরুদণ্ড ভাঙার প্রকল্প’। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সরকারী কর্মকর্তা সহ শিক্ষিত বাঙালী মূলতঃ বদর বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়। পাকি হানাদার বাহিনীর উপদেষ্টা জেনারেল রাও ফরমান আলীর নীল নকশা অনুযায়ী বদর বাহিনী এই ঘৃণ্য তৎপরতা চালিয়েছিল। বিশেষতঃ যুদ্ধশেষের আগের কয়েকটি দিনে ঢাকায় সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যার মর্মান্তিক ঘটনাগুলো এর প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
জামায়াতের আমির গোলাম আযমের সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো বদর বাহিনী। বদর বাহিনীর কেন্দ্রীয় প্রধান ছিলো মতিউর রহমান নিজামী। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ প্রাদেশিক প্রধান। মীর কাশেম আলী তৃতীয় নেতা ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামান প্রধান সংগঠক। জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম বদর বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়।
১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে আলবদর শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, “আলবদর একটি নাম। একটি বিস্ময়! আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা! যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী, আলবদর সেখানেই। যেখানেই দুষ্কৃতকারী, আলবদর সেখানেই। ভারতীয় চর কিংবা দুষ্কৃতকারীদের কাছে আলবদর সাক্ষাৎ আজরাইল।”
১৯৭১ সালের ৮ নভেম্বর দৈনিক পাকিস্তান আগের দিন ঐতিহাসিক বদর দিবস পালন উপলক্ষে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে এছলামী ছাত্রসংঘের সমাবেশের ওপর প্রতিবেদন ছাপে। পূর্ব পাকিস্তান এছলামী ছাত্রসংঘর সাধারণ সম্পাদক ও বদর নেতা মীর কাশেম আলী বদর দিবসের শপথ হিসেবে তিনটি কর্মসূচি ঘোষণা করে। প্রথমতঃ ভারতের আক্রমণ রুখে দাঁড়ানো; দ্বিতীয়তঃ দুষ্কৃতকারীদের খতম করা এবং তৃতীয়তঃ ইসলামী সমাজ কায়েম করা। জমায়েত শেষে ‘আমাদের রক্তে পাকিস্তান টিকবে’, ‘বীর মুজাহিদ অস্ত্র ধর ভারতকে খতম করো’, ‘মুজাহিদ এগিয়ে চল, কলকাতা দখল করো’ এবং ‘ভারতের চরদের খতম কর’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে ঢাকার রাজপথে মিছিল করে। মিছিল থেকে শাঁখারিবাজার, তাঁতীবাজার এলাকায় ব্যাপক লুঠ চালানো হয়, তখনো ঢাকায় থাকা কয়েকজন পথচারীকে তাড়া করে পিটিয়ে খুন করা হয়।
১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর মীর কাশেম আলী এক বিবৃতিতে ‘সৈনিক হিসেবে প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার জন্য’ সংগঠনের সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানায়। এই সময়কালে প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে বলা হয়েছিল, “শত্রু আশপাশেই রয়েছে। তাই সতর্কতার সঙ্গে কাজ চালাতে হবে। মনে রাখবেন, আপনারা পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্যই কেবল যুদ্ধ করছেন না, এ যুদ্ধ ইসলামের। নমরুদের হাত থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য আমাদের আমিরের (গোলাম আযম) নির্দেশ পালন করুন।”
আলবদরের নৃশংসতার বিবরণ স্বাধীনতার পর পর বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। যে সব চিত্র বিধৃত হয়েছে, তা হিটলারের গোস্টাপো, ভিয়েতনামের মাইলাই কিংবা লেবাননে প্যালেস্টাইনিদের সাবরা শাতিল শিবিরের হত্যাযজ্ঞের চেয়েও হাজার গুণ ভয়াবহ। বদর বাহিনীর হাতে শুধু ঢাকার শত শত বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, অধ্যাপক ও শিল্পীই প্রাণ হারাননি, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে শত শত বিশিষ্ট নাগরিকও রেহাই পাননি। ভিন্নমতাবলম্বীর অনেক আলেমও তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। এসব মর্মন্তুদ ঘটনার অনেক বিবরণ আজও অপ্রকাশিত।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পাশাপাশি আলবদর বাহিনীও পরাজিত হয়। তবে হানাদার বাহিনীর সাথে তারা আত্মসমর্পণ করেনি। মীর কাশেমসহ অন্যরা আত্মগোপন করে। কেউ পালিয়ে পাকিস্তান ও সৌদি আরব সহ অন্য দেশে চলে যায়।
১৯৭৭ সালে মীর কাশেম আলী পুনরায় আত্মপ্রকাশ করে। ইসলামী ছাত্রসংঘকে রূপান্তর করে গড়া হয় ইসলামী ছাত্রশিবির। মীর কাশেম আলী এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। গোলাম আযমের অর্থ সংগ্রহের তহবিলটা একসময় মীর কাশেমের কুক্ষিগত হয়। মীর কাশেম নিজেও অর্থ সংগ্রহে নেমে পড়ে। ছাত্রশিবির সভাপতির পদ ছেড়ে যোগ দেয় সৌদি আরবভিত্তিক এনজিও ‘রাবেতা আলম’ নামক সংস্থায়। যে সংস্থাটি বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সাহায্য-সহযোগিতার কাজে নিয়োজিত থাকার আড়ালে জামায়াত-শিবির প্রতিষ্ঠার কাজ করতে থাকে। তাদের মাধ্যমে আর্থিক যোগানও আসতে থাকে। বাংলাদেশে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে মসজিদ-মাদ্রাসা ধ্বংস করা হয়েছে, বহু মুসলমান নির্যাতিত হয়েছে ইত্যাদি বানোয়াট তথ্য দিয়ে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ সংগ্রহের কাজ শুরু করে মীর কাশেম ও তার দল।
ছাত্রশিবিরের সভাপতি পদ ছাড়ার ৪ বছরের মাথায় মীর কাশেম আলী ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। বাংলাদেশে জামায়াতিদের কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন সৌদি রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আবদুল হামিদ আল খতিব। গোলাম আযমের ঘনিষ্ঠ বন্ধুটি রাষ্ট্রদূত থাকা অবস্থায় ব্যাংকটির পরিচালক মনোনীত হয়। মীর কাশেম ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান হয়। শুরুতে পরিচালকমণ্ডলী ও শরিয়া কাউন্সিলের সব সদস্যই ছিলো জামায়াতে ইসলামীর মজলিশে শূরার সদস্য। এরা হলো কামালউদ্দিন জাফরী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মুহম্মদ আলী, আবদুল জব্বার, শামসুদ্দিন আহমদ, নুরুল ইসলাম ইত্যাদি। ব্যাংকের একটি জাকাত তহবিল রয়েছে। ব্যাংকের আয়ের শতকরা আড়াই ভাগ যায় জাকাত তহবিলে। এর প্রায় পুরোটাই জামায়াত তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে। এই ব্যাংকের ঋণের সুযোগ-সুবিধা জামায়াতিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এমনকি জামায়াতের বাইরের কোন লোককে কর্মচারীও নিয়োগ করা হয় না। বর্তমানে সরকারী নজরদারীতে আসার পরে সেখানে প্রকাশ্যে নতুন কোন কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া না হলেও, একের পর এক নিজস্ব দলীয় সুপারিশে লোক নিয়োগ চলছেই।
মীর কাশেম আলী ব্যাংকটি গঠনের পর অন্যান্য খাতেও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। ইবনে সিনা ট্রাস্ট, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল, শিক্ষা সব খাতেই বিনিয়োগ করে। বিগত ২০০১-২০০৬ সালের বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি) মর্যাদা নিয়ে বিদেশ সফরও করেছে।
ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মীর কাশেম ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ইবনে সিনা ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা মীর কাশেমের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছে ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যাল, ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতাল ইত্যাদি।
মীর কাশেমের অর্থ দিন দিন এতোই বেড়েছে যে, নানা খাতে অর্থ লগ্নি করেছে। কেয়ারী নামে ১০টি কোম্পানির পরিচালক এই রাজাকার, যাতে শুধু তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানা রয়েছে। এর প্রধান কার্যালয় ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে কেয়ারী প্লাজায়। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার জন্য রয়েছে মীর কাশেমের একক মালিকানাধীন বিলাসবহুল পাঁচটি প্রমোদতরী। এছাড়া কাশেম মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ প্রশ্নবিদ্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি লবিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দুই কোটি ৫০ লাখ ডলার দিয়েছে বলেও অভিযোগ আছে।
ইডেন শিপিং লাইন্সের চেয়ারম্যানও এই খুনী। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাস্ট, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও ফুয়াদ আল খতিব ফাউন্ডেশনের। ইসলামী ব্যাংক স্কুল ও কলেজের অন্যতম উদ্যোক্তাও সে।
১৯৭৭ থেকে ১৯৮৩ সালের স্বল্প সময়ের মধ্যে মীর কাশেম ক্রমেই পরিণত হয় ধনকুবেরে। ১৯৮৩ সাল হতে ক্রমে সম্পদশালী হয়ে ওঠার পেছনে কোন আলাদীনের চেরাগ হয়ত ছিল, তবে বাংলাদেশের মানুষ এই ঘাতকের দিন দিন ফুলে ফেঁপে ওঠার বিষয়টি টের পেতে অনেক সময় নিয়েছে।
প্রসঙ্গতঃ, ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে স্নাতক শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে এছলামী ছাত্রসংঘের কলেজ সভাপতি ছিলো মীর কাশেম আলী।