১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনি বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত নীলফামারী জেলার ৬টি উপজেলায় ব্যাপক ও বিভৎস গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানি বাহিনীর এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও বিহারী সম্প্রদায় এ গণহত্যায় নেতৃত্ব দেয়। গণহত্যার সাক্ষী হয়ে সারা জেলায় আজও দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকরব। অনেক বধ্যভূমি বেদখল হয়েছে ভূমিদস্যু এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বিরোধীদের দ্বারা। এই জরিপ কর্মটি পরিচালনা করতে গিয়ে পরিচিত গণহত্য, বধ্যভূমি ও গণকররের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি নতুন বধ্যভূমি ও গণকররের অনুসন্ধান পাওয়া গেছে। এই বধ্যভূমিগুলোতে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক জনগোষ্ঠীকে নিয়ে এসে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। আলোচ্য জরিপে নীলফামারী জেলার নীলফামারী সদর, সৈয়দপুর, ডোমার, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ১৯৭১ সালের সংঘটিত গণহত্যা ও তার নিদর্শন বধ্যভূমি, গণকবর নির্যাতন কেন্দ্র এবং শহিদদের কবর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেগুলো অনুসন্ধান করে তুলে ধরা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক, প্রত্যক্ষদর্শীদের স্মৃতিমূলক লেখা ও সাক্ষাৎকার, মাঠপর্যায়ে তথ্যানুসন্ধান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে রচিত গ্রন্থ এবং মুক্তিযুদ্ধের দলিল পত্রের মাধ্যমে এই জরিপ কাজটি সম্পন্ন করা হয়েছে।
মুনতাসীর মামুন, মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খন্ড-এ মোট ৯০৫টি গণহত্যা, গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রের তালিকা তুলে ধরেছেন যা এ যাবৎকালে সব থেকে বড় সংগ্রহ। কিন্তু সম্পূর্ণ নয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক মামুনসিদ্দিকি এক প্রবদ্ধে কুমিল্লার ৫৫টি গণহত্যা, গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রের তালিকা তুলে ধরেছেন। আহম্মেদ শরীফের প্রবন্ধ বগুড়া : ১৯৭১, গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবর প্রবন্ধে বগুড়ার ৭৩ টি গণহত্যার পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এভাবে যদি প্রত্যেক জেলায় গড়ে ৫০টি গণহত্যা, গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে তাহলে বাংলাদেশে প্রায় ৩২০০টি গণহত্যা, গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতনের নিদর্শন পাওয়ার কথা। তাই আমাদের এখনই সারাদেশে গবেষণা পরিচালনা করা উচিৎ যাতে মুক্তিযুদ্ধের এই সব নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় এবং সংরক্ষণ করা যায়।
নীলফামারী জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা হয়নি। তাই আমারা বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের গ্রন্থে এই জেলার গণহত্যা ও গণহত্যার নিদর্শন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে পারি না। ডা. এম এ হাসনের যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ গ্রন্থে নীলফামারী জেলায় ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যা ও গণহত্যার নিদর্শন বধ্যভূমি, গণকবর ও শহিদের কবর সম্পর্কে তুলে ধরা হয়েছে। এই গ্রন্থে তিনি মোট পাঁচটি বধ্যভূমি ও গণ কবরের কথা তুলে ধরেছেন। সেগুলো হলো- ১. দারুল উলুম মাদরাসা ও সৈয়দপুর হাইস্কুল, ২. গোলাহাট বধ্যভূমি, ৩. সৈয়দপুর টেকনিক্যাল স্কুল বধ্যভূমি। ৪. জলঢাকার কালিগঞ্জ বধ্যভূমি, এবং ৫. সৈয়দপুর গণহত্যা। ড. মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ কোষ দ্বিতীয় খণ্ডে নীলফামারী জেলার ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যা ও গণহত্যার নিদর্শন বধ্যভূমি, গণকবর ও শহিদের কবর সম্পর্কে তুলে ধরা হয়েছে। এই কোষ গ্রন্থে তিনি মোট চারটি বধ্যভূমি ও গণ কবরের কথা তুলে ধরেছেন। সেগুলো হলো ১. গোলাহাট বধ্যভূমি, সৈয়দপুর, ২. দারুল উলুম মাদরসা ও সৈয়দপুর হাইস্কুল বধ্যভূমি, নীলফামারী, ৩. সৈয়দপুর টেকনিক্যাল স্কুল বধ্যভূমি, নীলফামারী, ৪. সৈয়দপুর বধ্যভূমি, নীলফামারী।
এই দুটি গ্রন্থে ১৯৭১ সালের সংঘটিত গণহত্যা ও তার নিদর্শন বধ্যভূমি, গণকবর এবং শহিদদের কবর সম্পর্কে যে তথ্যগুলো পাওয়া গেছে তা নীলফামারী জেলার মুক্তিযুদ্ধে গণ হত্যার ইতিহাস পুর্ণগঠন করা সম্ভব হয়নি। এ জরিপের লক্ষ্য হলো নীলফামারী জেলার মুক্তিযুদ্ধের গণ হত্যার ইতিহাস পুর্ণগঠন করা।
জরিপের কাজটি শেষে নীলফামারী জেলায় গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবর, শহিদ কবর ও নির্যাতন কেন্দ্র উপজেলা প্রতি হিসেবে দেখা যাচ্ছে–
নীলফামারী সদর ১৫টি, সৈয়দপুর ২৬টি, ডোমার ১৪টি, ডিমলা ১৭টি, জলঢাকা ৫টি ও কিশোরগহ্জ ১২টি। কারণ বিগত ৪৬ বছরে অনেক বধ্যভূমি ও গণকবর বিলুপ্ত হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে মৃত্যুবরণ করেছে। যারা জীবিত আছে তাদেরও অনেকে বিস্মৃত হয়েছেন। আবার অনেকেই এ বিষয়গুলো নিয়ে মুখ খুলতে চান না। তাই আমাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত সব বধ্যভূমি, গণকবর, শহীদ কবর ও নির্যাতন কেন্দ্র তুলে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।
# বইটি সংগ্রহ করতে গণহত্যা জাদুঘরের সাথে যোগাযোগ করুন। ঠিকানা: ২৬ সাউথ সেন্ট্রাল রোড, খুলনা।