অলিয়ার রহমান খান ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার শিরগ্রামে ১৯৫০ সালের ১৭ জুন বিখ্যাত খান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ওয়াজেদ আলী খান ও মায়ের নাম শুকুরুন নেছা। ৫ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে অলিয়ার রহমান ছিলেন চতুর্থ। শৈশবে মাতা-পিতা, বড় ভাই-বোনদের স্নেহ-আদরে লালিত হয়েছেন অলিয়ার রহমান। আদর করে সবাই তাকে ডাকতো ‘মুন্নু’। শৈশবে গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে শিক্ষাজীবন শুরু হয়। এরপর পাঁচ বছর বয়শে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় শিরগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। সে সময় অবশ্য বিদ্যালয়টিকে পাঠশালা বলা হতো।
সভ্য শান্ত চেহারার অধিকারী অলিয়ার রহমান ভেতরে ভেতরে খুব ডানপিঠেও ছিলেন। অনেক সময় স্কুল ফাঁকি দিয়ে খেলাধুলা করতে চলে যেতেন। হাডুডু-গোল্লাছুট, ফুটবল, ডুবসাঁতার ইত্যাদি নানান রকমের খেলায় মেতে থাকতেন। ছোটবেলা থেকেই গরীব-দু:খী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন অকৃত্রিমভাবে। ৪র্থ-৫ম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময় থেকেই তিনি সহপাঠীদের বাড়িতে নিয়ে আসতেন। সবাইকে সাথে নিয়ে একযোগে খাবার খেয়ে তিনি খুব মজা পেতেন। কার মমতাময়ী মা-ও তার সকল ধরনের জ্বালা-যন্ত্রণা হাসিমুখে মেনে নিতেন। তিনি খুবই বন্ধুবৎসল এবং মানবিক একজন মানুষ। মাঝে মাঝে বাবার চোখ এড়িয়ে ধানের গোলা কেটে গরীব বন্ধুদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন।
শিরগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে তিনি বোয়ালমারি কলেজে ভর্তি হন। তখন সমগ্র জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ছাত্র সমাজের ভেতরে এই আন্দোলনের তিব্রতা ছিল বেশি। ১৯৬৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দল সমূহের জাতীয় সম্মেলনে নির্বাচনী কমিটিতে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবী পেশ করেন। প্রস্তাবিত ৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। অখণ্ড পাকিস্তানের পটভূমিতে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর যে শাসনতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক এবং প্রতিরক্ষা বিষয়ে যে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং একটি নতুন রাষ্ট্রের সূচনা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি যে অবহেলা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা বারে বারে প্রদর্শন করছিল, তা সংশোধনের জন্য ছয় দফা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল।
ছয় দফার ডামাডোল শুনতে শুনতে অলিয়ার রহমানের কলেজ জীবন পার হচ্ছিল। এ সময় দেশের সকল জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের এ বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ৭ জুন ১৯৬৬ পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে হরতাল ডাকা হয়েছিল তা বানচালের জন্য পুলিশ ও ইপিআর গুলি চালালে কমপক্ষে ১১ জন মানুষ নিহত হয়েছিল। এতে আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে উঠেছিল। এভাবে দেশ যখন ছয় দফা আন্দোলনে টালমাটাল এরকম একটা সময়ে ১৯৬৭-১৯৬৮ মেয়াদে বোয়ালমারী কলেজের প্রথম ছাত্র-ছাত্রী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অলিয়ার রহমান ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতি সচেতন ছিলেন এবং রাজনীতি করতেন। তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের ভোটে বোয়ালমারী ছাত্র-ছাত্রী সংসদের জিএস নির্বাচিত হন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে দায়ের করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগ নেতা ও পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেছিল। ১৯৬৮ সালের প্রথম ভাগে দায়ের করা এই মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, শেখ মুজিব ও অন্যান্যরা ভারতের সাথে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই মামলাটির পূর্ণ নাম ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য মামলা। তবে এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবেই বেশি পরিচিত, কারণ মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল যে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় কথিত ষড়যন্ত্রটি শুরু হয়েছিল। ১৯ জুন (১৯৬৮) মামলার বিচার শুরু হয়। শেখ মুজিব নিজেকে নির্দোষ দাবী করে আদালতে লিখিত বিবৃতি দেন। এই বিবৃতি পত্রিকায় পড়ে দেশবাসী শেখ মুজিবের পক্ষে সোচ্চার হতে শুরু করে।
শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও তার মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবীতে আন্দোলন বেগবান হতে থাকে। ছাত্র সমাজ ছয় দফা দাবীর সমর্থনে ১১ দফা দাবী উত্থাপন করে। ১১ দফা দাবী আদায় করার জন্য বোয়ালমারীতেও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল। অলিয়ার রহমান বোয়ালমারীতে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা ছিলেন। ছাত্র-জনতা, কৃষক-শ্রমিক সহ সমাজের সকল স্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করাতে এ আন্দোলন তীব্রতর হতে হতে শেষ পর্যন্ত ’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবের সম্মানে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক সভার আয়োজন করে। লাখো জনতার এই সম্মেলনে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়। উপাধি ঘোষণা দিয়েছিলেন তোফায়েল আহমেদ। এ সভায় রাখা বক্তৃতায় শেখ মুজিব ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগার দফা দাবির পক্ষে তার পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন।
শেখ মুজিবুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি লাভ করায় পূর্ব দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে আন্দোলনের তীব্রতা আরো বাড়তে থাকে। বোয়ালমারী-আলফাডাঙ্গা অঞ্চলের ছাত্র আন্দোলনকে আরো এগিয়ে নেওয়ার জন্য অলিয়ার রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অলিয়ার রহমান খান তার জন্মভূমি শিরগ্রামে গিয়ে বাঙালি জাতিয়তাবাদের পক্ষের সকলের দ্বারে দ্বারে ঘুরে জনগণের মধ্যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা লক্ষ করলেন। এরই ধারাবাহিকতায় এলো ১৯৭০-এর নির্বাচন। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন— “দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে আমাকে ফাঁসির কাষ্ঠ থেকে বের করে এনেছে। তাদের সাথে আমি বেঈমানি করতে পারি না।
১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু বেতার ও টেলিভিশনে নির্বাচনী ভাষণ দেন। নানান ধরনের ষড়যন্ত্র এবং প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যথা সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পূর্ব বাঙলার আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনে জয়লাভ করে নির্বাচনের ইতিহাসে বিশেষ এক বিজয় অর্জন করে। নির্বাচনের কিছুদিন পূর্বে (১২ নভেম্বর) পূর্ব বাঙলার দক্ষিণাঞ্চলে এক ভয়াবহ ঘুর্ণীঝড়ে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক লোক প্রাণ হারায়। বঙ্গবন্ধু দুর্গত এলাকায় দলের পক্ষ থেকে ব্যাপক ত্রাণ ততপরতা চালান। একইসাথে নির্বাচনের মূল তারিখ অপরিবর্তীত রেখে দুর্গত এলাকার আসনগুলোতে ১৯৭১-এর ১৭ জানুয়ারি নির্বাচন আয়োজনের দাবী করেন। এ সময় দুর্গত মানুষদের প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অবহেলা এবং উপেক্ষায় ক্ষুব্ধ শেখ মুজিব তদানীন্তন শাহবাগ হোটেলে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেন— “ঘুর্ণীঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে নিহত ১০ লাখ লোকের মতো আরো ১০ লাখ প্রাণ দিয়ে হলেও আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার আদায় করে নেব।”
নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ব্যারিস্টার সালাউদ্দিন আহমেদ-এর সমর্থনে নির্বাচনী প্রচারে অলিয়ার রহমান খান অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বোয়ালমারী-আলফাডাঙ্গার আওয়ামী বিরোধীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নির্বাচনী প্রচার এবং জয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা শোনার পর ফরিদপুরের সর্বত্র ভীষণ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ফরিদপুরে স্বাধীন বাংলা ছাত্র পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এই প্রচারের অংশ হিসেবে ১০ মার্চ অম্বিকা ময়দানে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি নেওয়ার লক্ষে বিশাল ছাত্র-গণ জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সভার ফরিদপুর জেলা এবং মহাকুমার নেতারা বক্তব্য রাখেন। ফরিদপুর থেকে নির্বাচিত সাংসদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের মধ্যে জনাব শামসুদ্দিন মোল্যা, ইমামউদ্দিন আহমেদ, এ্যাডভোকেট হায়দার হোসেন, এ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন ও আওয়ামী লীগ নেতা এসএম নুরুন্নবী বক্তৃতা করেছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা, ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সৈয়দ কবিরুল আলম মাও।
বক্তাদের বক্তব্য থেকে সেদিনই একটা ঘোষণা এসেছিল— ফরিদপুরের প্রশাসন আর পাকিস্তান সরকারের কথা মতো চলবে না। প্রশাসন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা মতো চলবে। এর বাইরে কেউ যদি বাঙলার মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে, সে যদি সরকারি অফিসারও হয়, তাহলে সেই অফিসারকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে জনতার ময়দানে বিচার করা হবে। একইসাথে আরো ঘোষণা এল যে, পাকিস্তানের নামে কোনো রাস্তাঘাট এবং প্রতিষ্ঠানের নাম থাকতে পারবে না। সেদিনই সিদ্ধান্ত হয়— জিন্নাহ এভিনিউর নাম হবে মুজিব সড়ক, আজম মার্কেটের নাম হবে তিতুমীর বাজার, কায়েদে আজম লাইব্রেরির নাম হবে শেরে-ই-বাংলা সাধারণ পাঠাগার, টেপাখোলা লেকের নাম হবে সোহরাওয়ার্দী সরোবর। এই ঘোষণার পর উপস্থিত জনতা দু’হাত তুলে সমর্থন দেয়। সভা শেষে অম্বিকা ময়দানে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।” শুনে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন অলিয়ার রহমান খান। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। অন্তবর্তীকালীন সময়ে ভারতের কল্যাণী শরণার্থী ক্যাম্পে কাজ করেন।
১৯৭১-এর এপ্রিলের শেষ ভাগের কথা— বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক অলিয়ার রহমানের মন ভীষণ অস্থির। দলে দলে লোক দেশ ছেড়ে ভারত যাচ্ছে। কেউ যাচ্ছে শরণার্থী হিসেবে, কেউ যাচ্ছে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে। অলিয়ার রহমান কিছু একটা করার জন্য যখন পড়িমরি করছেন এমন সময় তার হাতে একটি চরমপত্র এলো। পত্রটি পাঠিয়েছিলেন তার চাচাতো ভাই মো: মাহমুুদুল ইসলাম খান। তিনি রেজিস্ট্রি অফিশের টাইপিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। রেজিস্ট্রি অফিশ তখন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একটি কক্ষে চলত। ডিসি অফিসের এক গোপন সূত্রে তিনি জানতে পারেন ফরিদপুরের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের গোপন তালিকা করা হয়েছে। পাকিস্তান আর্মিরা শান্তি কমিটির লোকদের সহায়তায় হিটলিস্ট তৈরি করে। গোপন তালিকায় অলিয়ার রহমানের নাম দেখে উনি একখানা চিঠি লিখে কাদিরদি পর্যন্ত এসে একজন রিক্সালাকে দশ টাকা দিয়ে অলিয়ার রহমানের কাছে পাঠায়। চিঠিটি বিপদের বার্তা হলেও এটি একইসাথে অন্যরকম একটি সুযোগও তৈরি করে দেয়। চিঠিটি হাতে পাওয়ার পর আর দেরী না করে তিনি তার ভগ্নিপতি আশরাফুজ্জামানের কাছে গেলেন ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার জন্য। আশরাফুজ্জামানের এলাকা থেকে আরও ২০ জনের একটি দল তৈরি হলো। দলটি গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য ভারত রওনা হলো।
অলিয়ার রহমান তার দল নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। পথে কোনো যানবাহন নেই, পায়ে হেঁটে যাত্রা করেন। অজানা অচেনা পথ, পথে নানান ধরনের বিপদের হাতছানি। ভাটিয়ারা ঘাট পার হয়ে কালনার ঘাট হয়ে লোহাগড়া, নড়াইল হয়ে যশোরের দিকে রওনা হলেন। নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে ভারতের দিকে যেতে মনে অজানা আশঙ্কা কাজ করছে। পথে তখন হাজার হাজার লোক, প্রচুর মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারত যাচ্ছে। সর্বহারা, একেবারে নি:স্ব হয়ে তারা ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। তাদের মাথায় ছিল ছেঁড়া কাপড়ের পোটলা, কারো কারো কাখে বাচ্চা, পুরুষের কাঁধে ও মাথায় বোঝা। যতটুকু যা পারে সাথে নিয়ে রওনা হয়েছে। জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ দেখে অনেকেই হয়ত শরণার্থীদের এ যাত্রা কিছুটা হলেও দেখেছেন।
ভারত যাওয়ার পথে দিন রাতের কোনো ব্যবধান ছিল না। রাতেও অনেক পথ পাড়ি দিতে হত। কত অচেনা পথ-গ্রাম যে পার হতে হয়েছিল। বৃষ্টি এবং অনেক মানুষের কাঁচা পথ দিয়ে দিয়ে হাঁটায় পথ পিচ্ছিল এবং কর্দমাক্ত হয়ে পড়েছিল। অনেক কষ্ট করে পথ অতিক্রম করতে হচ্ছিল। প্রতিনিয়ত নতুন সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছিল। একটি অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “সীমান্তের কাছাকাছি একটি অব্যবহৃত প্রত্যন্ত গ্রাম্য পথ— অব্যবহৃত রেল পথটি ধরে মাঠ পাড়ি দিয়ে অন্যপ্রান্তে যেতে হবে। রেলপথের উল্টোপথে যে গ্রামটি সেখানে শান্তিকমিটির সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করেছে। ক্যাম্পটি স্থাপন করা হয়েছিল সীমান্ত পাহারা দেবার জন্য এবং ভারতগামী যুবক যুবতীদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করার জন্য। প্রধান সড়ক দিয়ে যেতে হলে ক্যাম্পটি অতিক্রম করে যেতে হয়। অন্য পথটি একটি বিলের মধ্য দিয়ে। বিলে বুক সমান পানি। পাকিস্তানি আর্মি এবং শান্তি কমিটির লোকদের চোখ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য হাজার হাজার লোক বিলের পানির মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করে যাচ্ছে। আমরাও পানিতে নেমে গেলাম। হঠাৎ একটি মেয়ে ঘাড় চেপে উঠে পড়লো। মেয়েটি বলল, ‘আমি আর পারছি না, আমাকে দয়া করে ওপারে নিয়ে যাবেন।’ আমি প্রথমে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু যৌবনের শিহরণকে উপেক্ষা করতে পারলেও, মানবতার ডাক উপেক্ষা করতে পারি নাই। ওপারে গিয়ে মেয়েটি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিল। আজও ঘটনাটি স্মৃতিপটে জ্বলজ্বল করে। আমরা যখন বনগাঁ স্টেশনে পৌঁছাই তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছে। স্টেশনে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। অজানা-অচেনা পথ। হালকা কিছু খাবার খেয়ে স্টেশনে শুয়ে বসে আমরা রাত কাটিয়ে দিলাম।”
“টালিখোলা ইয়থ রিসিপশন ক্যাম্পে আমি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে সাত্তারের সাথে দেখা হয়। প্রাক্তন আর্মি অফিসার সাত্তার ছিলেন আমাদের ভাস্তি জামাই। সাত্তারই টালিখোলায় আমাদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করেছিলেন। শুরু হলো গেরিলা প্রশিক্ষণ। টালিখোলায় ট্রেনিং শেষে আরও উচ্চতর ট্রেনিং-এর জন্য দেরাদুন পাঠানো হয়েছিল। দেরাদুন বসে আমরা জানতে পারি যে, মুজিবনগর সরকার গঠিত (১৭ এপ্রিল) হয়েছে। ট্রেনিং শেষে সাতক্ষীরা সীমান্তে মেজর জলিলের অধীনে আমি যুদ্ধ করি।”
দেশ স্বাধীন হবার পর কিছুদিন উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়িয়ে মুক্ত বাতাস গায়ে মেখে অলিয়ার রহমান ১৯৭২ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সার্জেন্ট জহুরুল হক হল-এর ৪০৪ নম্বর কক্ষে থাকতাম। সমাজ বিজ্ঞানে পড়াকালীন সময়ে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জেষ্ঠ্যপুত্র শেখ কামালের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। শেখ কামালের কথা বলতে গিয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। জহুরুল হক হল-এর সামনে, মধুর ক্যান্টিনে, রমনা পার্কে বা রেসকোর্স (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) ময়দানের খোলা ময়দানে বসে আমরা আড্ডা দিতাম।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অলিয়ার রহমান বলেন, “একবার আমরা— ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতারা উদ্যোগ নিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করব। সে মোতাবেক বঙ্গভবন থেকে কনফার্ম হলো। এ প্রসঙ্গে এর আগের একটি ঘটনা বলা দরকার। [বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন বোয়ালমারীতে। বঙ্গবন্ধুর আগম উপলক্ষ্যে যে আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়েছিল, সে কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলাম আমি। সে সময় ঘটনা পরম্পরায় আমার নামটা বঙ্গবন্ধুর কানে গিয়েছিল।] আমাদের জন্য বঙ্গভবন থেকে গাড়ি পাঠানো হয়েছিল। প্রয়োজনীয় চেক-আপ সেরে বঙ্গভবনের সবুর লনের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি—
১৯৭৯ সালের ৭ অক্টোবর ফরিদপুর শহরের নিকটবর্তী গ্রাম কমরপুরে জন্ম নেওয়া শাহজাদী বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পড়াশুনা শেষ করে চাকরি নিয়েছিলেন ১৯৭৬ সালে একটি হোশিয়ারি কোম্পানিতে। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর ২য় বিপ্লব– দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগের জন্য ফরিদপুর ফিরে আসেন।
১৯৮৭ সালে কবির পরিবারের বলিষ্ঠ আকবর কবির মহোদয়ের অনুরোধে পল্লী প্রগতি সহায়ক সমিতির হাল ধরেন। তিনি পপসস-এ যোগ দিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, বনায়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করেন।
১৯৯২ সালে পপসস-এর ঘুরে দাঁড়ানোর এক বিশাল কর্মযজ্ঞের অংশ হিসেবে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন। সেই থেকে পপসস-এর নবজাগরণ ঘটে। জনাব অলিয়ার রহমান খান-এর যোগ্য নেতৃত্বে পপসস একটি মডেল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। দীর্ঘ ত্রিশ-পয়ত্রিশ বছর ধরে তিনি মানব সম্পদের উন্নয়ন ঘটিয়ে তিনি বেকারত্ব দূরীকরণে কাজ করে যাচ্ছেন।
পপসস-এ কর্মরত সকলে মিলে একটি পরিবার যেন! অলিয়ার রহমান খান তার প্রাণের প্রতিষ্ঠান পপসস-এর সকলকে একই বৃন্তে ধরে রেখে অভিভাবকের আসন পেয়েছেন।
পাশাপাশি তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত রয়েছেন। ফরিদপুর চেম্বার অব কমার্স, রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব, পরিচর্যা হাসপাতাল লি:, এডাব, মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা, ফেমা, ইউনেস্কো ক্লাব, ক্যাব ইত্যাদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন বা দিচ্ছেন।
সমাজসেবামূলক কাজের সাথে জড়িত থাকায় তিনি মাদার তেরেসা, নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌলা, মহাত্মাগান্ধী ইত্যাদি স্বর্ণপদকে ভূষিত হয়েছেন। তিনি এখনও জাতির জনকের ঘোষিত সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে চলেছেন।