মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও শিক্ষক রমা চৌধুরীর কর্ম ও জীবন

রমা চৌধুরী

১৯৭১


তিনটি শিশু সন্তান এবং বৃদ্ধ মাকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন নিজ ঘরে। হঠাৎ ভোর রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা রমা চৌধুরীর ঘরে হানা দিয়ে তাকে তুলে নিয়ে যায় পাশের একটি ঘরে। সেখানে তাঁর ওপর চলে অমানুসিক নির্যাতন। কোনোভাবে সেদিন তিনি বেনিয়া ও বর্বরদের হাত থেকে পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়েছে এক বুক কষ্ট, গ্লানি এবং অবরুদ্ধ বিক্ষোভ। রমা চৌধুরী ৭৯ বছর বয়সে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত সোমবার মৃত্যুবরণ করেছেন। 

রমা চৌধুরী (১৪ অক্টোবর, ১৯৪১ – ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নির্যাতিত একজন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা শুধু নয়, বলা হয়ে থাকে তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রথম নারী স্নাতোকত্তোর। ১৯৭১ সালের ১৩ মে ভোরে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিজ বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হন। তিনি পাকিস্তানি দোসরদের হাত থেকে পালিয়ে পুকুরে নেমে আত্মরক্ষা করেছিলেন। হানাদাররা গানপাউডার লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় তাঁর ঘরবাড়িসহ যাবতীয় সহায়-সম্পদ। তিনি তাঁর ওপর নির্যাতনের ঘটনা একাত্তরের জননী নামক গ্রন্থে প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও তিনি আরও ১৭টি বিভিন্ন বই লিখেছেন। 

তিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। রমা চৌধুরী ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কর্মজীবন শুরু করেন। পরে দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন।

পুরো জীবনটাই যেন তাঁর দুখগাঁথা—একে একে তাঁর তিন পূত্র সন্তানই মারা যায়। মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের পর ২০ ডিসেম্বর তাঁর বড় ছেলে সাগর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এর ১ মাস ২৮ দিন পর মারা যায় আরেক ছেলে টগর। প্রথম ছেলের মৃত্যুর পর রমা চৌধুরী পাগল প্রায়, টগরকে ওষুধ খাওয়াতে গেলে কোনো কারণে শ্বাসরোধ হয়ে মারা যায়। ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর আরেক ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে পুত্রশোকে তিনি আর কোনোদিন জুতা পায়ে দেননি। খালি পায়ে হেঁটে নিজের লেখা বই বিক্রি করে চলতেন এই নারী।

মুক্তিযুদ্ধের সুবিধাভোগী গ্রুপের অভাব নেই, কিন্তু রমা চৌধুরী এবং রমা চৌধুরিরা কাটিয়েছেন অভাবী এবং অনুল্লিখিত এক জীবন। থাকার জন্য একটি ভালা বাসা পর্যন্ত তাঁর ছিল না। ২০ বছর ধরে লেখ্যবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন রমা চৌধুরী। পেশা বলা কঠিন, বলতে হবে তিনি লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। তিনি প্রথমে একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। বিনিময়ে সম্মানীর বদলে পত্রিকার ৫০টি কপি পেতেন। অনেক ক্ষেত্রে সেই পত্রিকা বিক্রি করেই চলত তাঁর জীবন-জীবিকা। পরে নিজেই নিজের লেখা বই প্রকাশ করে বই ফেরি করতে শুরু করেন। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে বর্তমানে তিনি নিজের ১৫টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। 

২০১৭ সালের শেষ দিকে নিজ বাসায় পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হাড়ের ব্যথাসহ নানা রোগে ভোগার পর ২০১৮ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর সোমবার ভোররাত ৪টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন একাত্তরের এই বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। রমা চৌধুরীর শেষ ইচ্ছা অনুসারে বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে তাঁর সন্তান টুনুর সমাধির পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।