বিশাল সাদা ক্যানভাসে বীরাঙ্গনা মনোয়ারা বেগম সূঁই-সুতা দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল প্রতিকৃতি ফুঁটিয়ে তুলেছেন। কাজটি করতে তার দুই বছর লেগেছে। কাজটি তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দিতে চান।
বীরাঙ্গনা মনোয়ারা বেগমের জীবনে রয়েছে একটি বেদনাবিধুর ইতিহাস। সে ইতিহাস সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায়। প্রথমে তিনি নির্যাতিত হয়েছেন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। এরপর নিগৃহীত হয়েছেন পরিবারের হাতে— পরিবার, বিশেষ করে পিতা তাকে গ্রহণ করেননি। এরপর ঘাটে ঘাটে, হাতে হাতে বিক্রি হয়েছেন। করুণ এবং একইসাথে কঠিন সে জীবনকাহিনীর শেষ অধ্যায়ে এসে তিনি মুখ খুলেছেন। বীরাঙ্গনা মনোয়ারা বেগম গবেষক ও সাংবাদিক দিব্যেন্দু দ্বীপ-এর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন বর্বরতার সে ইতিহাস।
মনোয়ারা বেগমের বাড়ী ছিল বরিশালের হোসেনপুর গ্রামে। বাবা আব্দুল জব্বার (জবেদ) ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক। বাবার বাড়ি হোসেনপুর গ্রামে হলেও ছোটবেলায় তিনি বড় হয়েছেন তার মায়ের সাথে মাধবপাশার বাদলা গ্রামে। মায়ের আবার বিবাহ হয় গহর খলিফা নামে একজন স্থানীয় ব্যবসায়ীর সাথে। মনোয়ারা বেগম আর দশটা মেয়ের মতো একটি গ্রাম্য স্বাধীন পরিবেশে বড় হয়েছেন। তখন তো বলতে গেলে সবই প্রাকৃতিক— খাদ্য-খাবার, ভ্রমণ, বিনোদন সব কিছুতেই ছিল প্রকৃতির ছোঁয়া। আজকের যান্ত্রিক যুগের মতো জীবন তখন ছিল না। তখন মানুষের সাথে প্রকৃতির এক নিবিড় বসবাস, তবে গ্রামের অন্য সবার মতো তাকেও দেখতে হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সাংসারিক চড়াই উতৎরাই— ঝঞ্জাট। একজন গ্রাম্য কিশোরীর জীবনেও একটি দীর্ঘ গল্প থাকে, মায়ের আবার বিবাহ হওয়ার সে গল্পটাও মনোয়ারার জীবনে নতুন মোড় নিয়েছিল, কিন্তু কৈশোরের সব ঘটনাই তার চাপা পড়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসরদের বর্বরতায়। বীরঙ্গনা মনোয়ারার মুখেই শোনা যাক পাকিস্তানি বাহিনীর সে বর্বরতার কথাঃ
যুদ্ধ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কেও না। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নানান জনের মুখে নানান কথা শুনি। তখন আমার বয়স ষোলো বা সতেরো হবে। আমি তখন মাধবপাশা গ্রামে মায়ের সাথেই ছিলাম। ১৯৭১ সালে আমার প্রথম বাবা ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক। যুদ্ধকালীন সময়ে ওনার খবর তেমন কিছু জানতাম না। যখন যুদ্ধ লাগলো তখন তো চারিদিকে এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ— গোলাগুলি, কে কোথায় পালাবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। পরিবারে আমরা আগের দুই বোন সহ মোট ছয় ভাই-বোন ছিলাম। আমাদের পরিবার মাটির নিচে একটা গর্ত করেছিল পালিয়ে থাকার জন্য। এভাবে মাধবপাশায় অনেকদিন থাকার পর পরিবারে মারাত্মক খাদ্যাভাব দেখা দেয়। পরিবারের ৯জন সদস্যের খাবার যোগান কে দেবে? আমার পরের বাবাই ছিলেন এই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
যুদ্ধকালীন সময়ে আমার নানী তখন জামাই বাড়িতে ছিলেন। ভয়ে গ্রাম থেকে মানুষজন সব পালিয়ে যেতে থাকে, পুরো গ্রাম বলতে গেলে প্রায় জনশূন্য হয়ে যায়। সবাই ভাবলো যে, পাকিস্তানি বাহিনী নদী পার হয়ে ওপার (কাউয়ারচর বা চরকাউয়া) যেতে পারবে না। সবার কথা শুনে আমার নানিও আমাকে নিয়ে ওপার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নদীর ওপারে চরকাউয়াতে আমার নানাবাড়ি ছিল। আমি নানি আমার নানা বাড়ির পাশেই বিবাহ হওয়া তার আরেক মেয়ে মানে আমার খালাকে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন। তিনি খুব দ্রুতই বাড়ি যেতে চাচ্ছিলেন। নিরাপদ হবে ভেবে আমি এবং আমার এক সৎ ভাইকে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু আমার এই বাবা ভাইকে ছাড়তে রাজি না হলে তিনি শুধু আমাকে নিয়েই রওনা হন।
তখন গাড়িতে যাওয়ার সুযোগ ছিল না, পথঘাটও ছিলো কাঁচা, কখনো মেঠোপথ, কোথাও সাঁকো বা খেয়া নৌকা, তাই পায়ে হেঁটেই আমাদের যেতে হচ্ছিল। খুব কষ্ট হচ্ছিল, তবে সে কষ্ট মৃত্যুভয়ের চেয়ে বেশি ছিল না। নতুল্লাবাদ (বর্তমানে বাসস্টান্ড) আসতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। একটা বাড়িতে আমরা আশ্রয় নিই। বাড়িটি ছিল জনশূন্য। আমরা সেই বাড়ির গোয়াল ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের সাথে খাবার হিসেবে ছিল মায়ের তৈরি করে দেওয়া চাল ও ডালের ক্ষুধ দিয়ে বানানো এক ধরনের চাপড়ি, যেটিকে বরিশালের স্থানীয় ভাষায় চডা বলে। কোনোমতে কয়টা খেয়ে আমরা ঘুমানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সে ছিল এক ভয়াল রাত। জায়গাটা স্যাঁতসেতে জঙ্গলাকীর্ণ, মশার কামড়, চারিদিকে শিয়ালের ডাক, সাপ ও জোঁকের ভয়। আমাদের সাথে কেউ ছিল না। আমরা ভয়ে ভয়ে একে অপরকে ধরে রাতটা কোনোমতে কাটাই। পরেরদিন ভোরবেলা নানাবাড়ির উদ্দেশ্যে আবার রওনা হই।
বরিশাল শহরে এখন যেখানে জেলাখানা— পিছনে ছিলো ঝোঁপ-জঙ্গল, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আমরা খেয়া ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছাই। সদররোডের কোল ঘেষে এখন যেটি বাংলাবাজার তখন এই বাজারটির নাম ছিল পাকিস্তান বাজার। রহম আলী খাঁ ও হৈজন নামে দুজন লোক নৌকা বাইত। নানি হৈজনকে বললেন, “মোরে একটু ওপার লইয়া যাও।” তখন সকাল ১১টা হবে হয়ত। যাওয়ার পথে রহম আলী খাঁ-এর সাথে আমার নানীর দেখা হয়। এবং তোজুম্বর নামক এক লোক জাল বুনতে ছিল। উনি নানিরে বললেন, নাতিরে লাইয়া কই যাও? শুনলাম গ্রামে নাকি মিলিটারি আইছে!
আমার নানি বাড়ি ছিল কাওয়ারচর গ্রামের খেয়ে ঘাট থেকে দেড় থেকে দুই কিলোমিটার ভেতরে। আরেকটু ওপার গিয়েই যে আর্মি আছে তা আমরা জানতাম না। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর শুনি যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই গুলি করছে, ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মানুষকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। শুনতে পেলাম আমার নানা বাড়িতেও নাকি আগুন দিয়েছে। আমার নানা বাড়ি যাওয়ার সময় নানি বললেন, “তুই এইহানে পলাইয়া থাক মুই আইতে আছি।” আমার নানা বাড়ির সাথেই মোটা একটা কড়ই গাছ ছিল এবং তার পাশে অনেক জঙ্গল। সেই কড়ই গাছের নিচে আমি চুপ করে বসে থাকি। তখন দেখতে পাই— আমরা নানা বাড়িতেও আগুন জ্বলছে। আমি খুব ভয় পাইচ্ছিলাম। দেখতে পাই— অনেক লোককে একসাথে (১৬/১৭ জন) এক দড়িতে বেঁধে গুলি করে খালে মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী যখন আমার নানাবাড়ি থেকে বের হয়েছে তখনই আমায় দেখে ফেলে। বড় মোটা হাত দিয়ে ওরা আমাকে থাবা দিয়ে ধরে, চুল ধরে দাঁড় করায়। একদিকে আমার নিজের মৃত্যু ভয় অন্যদিকে আমার ভাইয়ের লাশ দেখতে পাচ্ছি। আমার চাচতো ভাই শাহজাহান তালুকদারকে পাকিস্তানি বাহিনী অন্য অনেকের সাথে ঐদিন গুলি করে হত্যা করে। (আমার চাচাতো চাচার বাড়ি ছিল আমার নানা বাড়ির কাছে) এতটাই বিভৎস ছিল সে হত্যাকাণ্ড— ওনার মাথার খুলি উড়ে গিয়ে দূরে পড়ে। মাথার ঘিলু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। পরে শুনেছি আমার আরও দুই চাচতো ভাই মফিজ তালুকদার এবং তাজু তালুকদারকেও পাকিস্তানি বাহিনী ঐদিন হত্যা করে। বাড়িটিকে তখন সবাই চৌকিদার বাড়ি বলে চিনতো। পরে জানতে পারি— এসব দৃশ্য দেখে আমার নানি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন, তারপর একসময় তিনি মারা যান।
বাঁচার জন্য আমি চিৎকার করতে থাকি, বলতে থাকি— আমারে ছাইড়া দেন, নানিরে ডাকতে থাকি— নানি, ও নানি, আমারে ধইরা নিয়ে যাইতেছে। আমাকে জোর করে টানতে টানতে ওরা ওদের বোটে উঠায়। ওদের গান বোটে গিয়ে দেখি সেখানে আরও তিন চারটা মেয়ে। প্রথমে ওরা আমাদেরকে নিয়ে ত্রিশ গোডাউনের পাশে ফোরকান কোয়াটারের (বরিশাল সদর হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের একটি আবাসিক ভবন) দোতালায় উঠায়। জানালা দিয়ে দেখি মাঠ আর মাঠ, এবং অনেক নতুন ইটের স্তুপ।
প্রথম দিন আমাদের কোনো খাওয়া-দাওয়া নাই, আতঙ্কের মধ্যে থাকি— কখন জানি কী হয়! সন্ধ্যার দিকে ওরা আমাদেরকে আলাদা আলাদা করে ভাগ করে নিয়ে যায়। এরপর শুরু হয় আমাদের ওপরে ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন। নির্যাতনের সকল বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়। শুধু একটি ঘটনা বলি— তিন জন পাকিস্তানি আর্মি একসাথে আমাকে বিবস্ত্র করে ফেলে, এরপর একে একে তারা বারংবার আমার ওপর নির্যাতন চালায়। দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকে। আমার মতো অনেক কিশোরী, যুবতী এবং মধ্যবয়সী অনেক নারী ক্যাম্পে বন্দী ছিল।
প্রতিদিন আমার ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হত। ওরা আমার শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলত, পিঠে এখনো নরপশুদের কামড়ের দাগ রয়েছে । পানি খেতে চাইলে প্রস্রাব করে দিত। কিল, ঘুসি, লাথি মারত, বুট দিয়ে পাড়াত। অকথ্য নির্যাতরে পর কখনো কখনো অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতাম। মাঝে মাঝে ওদের কয়েক জনের নাম শুনতাম— সরফরাজ, মেহেদি খান, ইউনুস খান, জামশেদ হসান, এরকম আরও অনেক নাম। মাঝে মাঝে তাদের নির্যাতনের ভয়ে জ্ঞান ফিরলেও অজ্ঞানের মতো করে পড়ে থাকতাম। ওরা একদিন একজন এসে আমার চুল ধরে দেয়ালের সাথে গুতো দেয়। আমার মাথা অনেকখানি কেটে যায়। সেই দাগ এখনো আমার কপালে আছে। যখনই আয়নার সামনে যাই— মনে করিয়ে দেয় সেই ভয়াল স্মৃতি।
এভাবে ক্যাম্পে প্রায় তিন মাস কেটে যায়। তারপর একদিন হুট করে ওরা আমাকে অন্য একটি সেলে নিয়ে যায়, প্রশ্ন করে— “তুমহারা ভাই কীধার হ্যায়? ম্যায়নেতো সুনা হ্যায় তেরা ভাই মুক্তি হ্যায়, মুঝে বাতাও? অউর তু বোল শেখ মুজিব কো জয় বাংলা।” আমার খালাতো ভাই জালাল মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, সিলেটে চাকরি করতেন। উনি চিঠি পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি সিলেটে মুক্তিবাহিনীতে আছেন। বিষয়টি গোপন থাকে না। স্থানীয় রাজাকারেরা পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে এই খবরটি পৌঁছে দেয়। কিন্তু এসব কিছুই আমি জানতাম না। আমি তাদেরকে বললাম, ভাই, আমি এসবের কিছুই জানি না। পরের দিন আবার টর্চার সেলে নিয়ে যায়। ওরা নিজেরা কী জানি পরামর্শ করে। তারপর আমাকে ওরা নিয়ে যায় পাওয়ার হাউজের (এখনকার ওয়াপদা) টর্চার সেলে। আমাকে টানতে টানতে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়, টর্চার সেলের ভেতরে ঢোকায়। কত মানুষের যে আহাজারি সেখানে! দেখি— কতজনকে ঝুলিয়ে রেখেছে! আমার সামনেই অনেকের পেটের ভেতর বেয়নেট ঢুকিয়ে দেয়। সবাই “ওরে মা, ওরে বাবা” বলে চিৎকার করতে থাকে। কয়েকজন মেয়ের স্তন কেটে দিয়েছে। এসব আমার চোখের সামনেই ঘটেছে। মাঝে মাঝে শুনতে পাই চিৎকার আর গোলাগুলির আওয়াজ। এভাবে ওখানে আমার প্রায় পাঁচ থেকে সাত দিন কাটে। খাবার হিসেবে একটি রুটি দিত শুধু।
একদিন হঠাৎ করে অনেক জোরেসোরে প্লেন আসা যাওয়ার শব্দ শুনতে পাই। মনে হচ্ছিল— কিছু একটা হতে চলেছে আজ। কিছুক্ষণ আগে থেকেই সবকিছু যেন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে পরপর বোমার শব্দ শুনতে পাই। মনে হচ্ছিল— এখনই এখানে এসে বোমা পড়বে। শকুনেরা ওড়াউড়ি করছিল। মৃতদেহ খুবলে খেতে পুরো শহর জুড়ে তখন পাকিস্তানি বাহিনীর পাশাপাশি শকুনের দল ছোটাছুটি করত। ওরা বলছিল, “ইহাছে সব চলো, মুক্তি আয়া হ্যায়!” ওরা সবাই আমাদেরকে ফেলে ভয়ে পালায়। ওরা পালাচ্ছে, একইসাথে কারা যেন এদিকে আসছে বুঝতে পারলাম। আমিও এই সুযোগে ওখান থেকে বের হয়ে পালানোর চেষ্টা করি। কিছু দুর যেতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এভাবে প্রায় দুই তিন ঘণ্টা চলতে থাকে। কিছুক্ষণ পর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুনতে পাই। বরিশাল ঐ দিনই শত্রুমুক্ত হয়। তখন কারা যেন আমাকে ধরে নিয়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি করেছিল, তা আর ঠিক মনে নেই।
হাসপাতালে প্রথম চোখ মেলে ‘বাঁচার কী সাধ’ তা নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলব্ধি করতে পারলাম। এখনও আমার মনে পড়ে— ঐখানে একজন মেট্রন দিদি ছিলেন, তার নাম ঠিক মনে নেই, তিনি খুব ভালো ছিলেন। আর একজন হিন্দু সিস্টার ছিলেন— নাম ছিল ইভা। আরও একজন খ্রিস্টান দিদি ছিলেন— নাম ছিল মেরি পলিন। চারিদিক থেকে সবাই শুধু তাদের ডাকাডাকি করতে থাকত ‘সিস্টার সিস্টার’। আমাকে যে ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিল সেখানে আরও নির্যাতিত মেয়েরা ছিল। আমার মনে আছে— পাশের সিটে একটা মেয়েকে একটা স্তন কেটে দিয়েছিল। সে অনেক কষ্ট পেত। আমি প্রায় একমাস ধরে চিকিৎসারত অবস্থায় ছিলাম। এরপর ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকি।
মাঝে মাঝে শুনতে পাই— কারা যেন ‘জয়বাংলা’ স্লোগান তুলে হাসপাতালের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। তখন আমি অনেকটাই সুস্থ ছিলাম। মনে হলো যেন আমার পুর্ণজন্ম হয়েছে। এত কিছুর পরেও আমার বুকে বল আর মুখে হাসি ফুঁটে ওঠে, কারণ, আমি এখন স্বাধীন! বাড়ি ফিরে গেলাম অনেক আশা নিয়ে। ভাবতে থাকলাম– স্বাধীন দেশে আমার বাড়িতে আমি ফিরে যাব স্বাধীনভাবে। আমাকে ধরে নিয়ে যাবার খবর আমার নানি বাড়ি এবং বাবার বাড়ির সবাই জানত। কোন মুখ নিয়ে যাব? সমাজ তো আমাদের এভাবেই ভাবতে শিখিয়েছে। কিন্তু যাবার তো কোনো জায়গা নেই। বাড়ি ছাড়া আর কোথায়ইবা যাব? হাঁটতে হাঁটতে সদর হাসপাতাল থেকে মাধবপাসা বাদলা গ্রামে আমার বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। মনে কত আশা তখন— বাড়িতে যাব! বাবা, মা, ভাই বোনকে দেখব! বাড়ির কাছাকাছি গেলাম, দু’একজন এলাকার লোক আমাকে দেখে কী যেন বলাবলি করছিল। ওদের কথায় পাত্তা না দিয়ে বাড়িতে ঢুকি। আমার বাবা তখন বাড়িতে ছিলেন, উনি একটা চৌকির উপর বসা ছিলেন। আমার মা দৌঁড় দিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু আমার বাবা আমাকে বললেন, “তুই এই বাড়ি অইছস ক্যা, তুই এহনি বাড়ি থ্যাইক্যা বাইর হইয়া যাইবি, মোগ দ্যাশ তোর জন্যি আর না।” আর আমার মাকে বললেন, “যদি তোর মাইয়ারে এ বাড়ি রাখস মুই বাড়ি ছাইড়া চইলা যামু। অহন তুই ঠিক করবি তুই কি করবার চাস।” আমি কাঁদতে ছিলাম। আমার মা-ও শেষে বললেন, “যা মা, তুই অন্য কোথাও চইলা যা।” আমি আমার মাকে বললাম, আমি কোথায় যামু? তিনি আমাকে বললেন, “তুই যদি থাকস, সে আমারে সব পোলাপাইন সহ বাড়ি থ্যাইক্যা বাইর কইরা দিব। এরপর আমি সবার কথা চিন্তা করে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম।”
রাস্তা দিয়ে হাটঁতে থাকি আর চিন্তা করছি— কোথায় যাব, কী করব। আমি কান্না করতে করতে রাস্তা দিয়ে হাটঁতেছিলাম। নানি বাড়িও যেতে পারব না, কারণ, সেখানে ঘরবাড়ি সব পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার নানিও বোধহয় সেখানে আর ছিলেন না। পূর্বেই বলেছি যে, পরে শুনতে পারি উনি মারা গিয়েছেন। তখন আমি বরিশাল সদর রোডের কাছাকাছি, সন্ধ্যা সাতটা আটটার মতো বাজে। দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে ‘কোথায় যাব’ যখন ভাবছি এ সময় একজন অচেনা পুরুষ এসে আমাকে বললেন, “তুমি কোথায় যাবা?” আমি বললাম, “আমার যাওয়ার জায়গা নাই।” লোকটি আমার বাড়ি কোথায় জানতে চাইলেন। আমি বললাম, মাধবপাশা।
এরপর আমি সবকিছু তাকে খুলে বললাম। তিনি সবকিছু শোনার পর আমাকে বললেন, তুমি আমার সাথে চলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়? তিনি বললেন, আমার বাসায়। আসলে আমার যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। মনে ভয় থাকলেও কিছু করার ছিল না। আর চারিদিকে যুদ্ধের এমন ডামাডোলের পরে সবারই তীব্র অভাব অনাটন— সমস্যা, সংকট; কে আমাকে থাকতে দেবে? খেতে দেবে? মন হঠাৎ সায় দিল। লোকটাকে মনে হলো ভালো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপানার বাড়ি কোথায়? তিনি আমাকে বললেন, “আমার বাড়ি বাগেরহাট। আমার এক আত্মীয়কে দেখতে এসেছিলাম এই সদর হাসপাতালে।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম কী? লোকটির নাম ছিল ইজ্জত, বয়স প্রায় আটাশ-ত্রিশ হবে। তিনিও আমার নাম জানতে চাইলেন। আমি বললাম, আমার নাম মনোরা (মনোয়ারা)। আমি তাকে মিঞা ভাই বলে সম্বোধন করলাম। তিনি আমাকে স্টিমারে করে বাগেরহাট নিয়ে গেলেন, সিনেমা হলের (লাইট হল) পিছনে। অনেক মেয়েরা আছে ঐখানে। আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? এরা আমার বোন, খালা … কিন্তু তাদের দেখে আমার একটু অন্যরকম মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমাদের গ্রামের সাধারন বউ মেয়েদের চেয়ে একটু আলাদা তারা।
যাইহোক, আমাকে নিয়ে গিয়ে একটা কাঠের টুলের উপর বসালেন। তারপর তারা যেন কী কথা বলছিল! এর মধ্যে একটা মেয়ে এসে আমার নাম জানতে চাইলো। “তুমি কি খাইছো? যাও হাত মুখ ধুয়ে আসো?” আমার জন্য ডিম ভাত নিয়ে আসে। আসলে তখনও আমি বুঝতে পারিনি যে, আমার সাথে পরের জীবনে কী হতে চলেছে! জীবনের আরেক অভিশপ্ত অধ্যায় শুরু হতে চলেছিল তখন। সেদিন আমাকে রেখে ঐ ইজ্জত লোকটা সেখান থেকে চলে যায়। আমাকে বলে যায়— তুমি এখানে থাকো, আমি কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মিঞা ভাই কোথায় যান? সে বললো, চিন্তা কইরো না, কিছুক্ষণ পর চলে আসবে। তারপর থেকে ঘন্টা যায়, রাত যায় দিন আসে, কিন্তু ইজ্জত ভাই আর ফিরে আসেনি। পরে জানতে পারি— সে আমাকে ওখানে বিক্রি করে দিয়ে গিয়েছিল।
ইজ্জত আমাকে যার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল তার নাম মালা। পরে আমি জানতে পেরেছিলাম যে, মাত্র অল্প কয়টা টাকার বিনিময়ে ইজ্জত আমাকে এখানে বিক্রি করে দিয়েছিল! তারপর ওরা বুঝিয়ে শুনিয়ে ভয় দেখিয়ে ঐ রাস্তায় আমাকে চলতে বলে, এবং বাধ্য করে। এক সময় আমি ওদের হাতের পুতুল হয়ে যাই। কারণ, আমার পালানোর কোনো জায়গা ছিল না এবং সুযোগও ছিল না। ওখানকার গেটে পাহারাদার থাকতো, ইচ্ছে করলেই বের হওয়া যেত না। সহজে কেউ পালাতে পারত না।
এভাবে হাত বদল হয়ে বাগেরহাট, খুলনা, মাদারীপুর, তারপর ফরিদপুর কালিবাড়ীতে। কালিবাড়ীতে থাকতে আমার এক মেয়ে হয়। কার ঔরসে মেয়েটা হয় সেকথা পরে কখনও আপনাকে বলব। বাচ্চাটা একটু বড় হওয়ার পর আমি বরিশালে আমার মাকে দেখতে যাই। তখন আমার বাবা মারা গিয়েছেন। মাকে সব কথা খুলে বলে বললাম, “আমার জীবনটা এমন হত না যদি তোমরা আমাকে সেদিন আশ্রয় দিতে।” মা বললেন, আমি অসহায় ছিলাম। কারণ, উনি তো তোমার আপন বাবা ছিলেন না। তোমাকে কোলে করে নিয়ে আমি দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হয়েছিলাম। (বিষয়টা আমি তখন পর্যন্ত জানতাম না) তোমার আসল বাবার বাড়ি ছিল হোসেনপুর, গাভা রামচন্দ্রপুর, বরিশাল। তোমার বাবার নাম ছিল— আব্দুল জব্বার, এলাকায় তাকে সবাই যবেদ বলে ডাকত। যদিও তৎকালীন সময়ে এটা বরিশালের অধীনে ছিল, পরে বিভক্ত হয়ে এখন ঝালকাঠির অধীনে। তোমার বাবার বাড়ি আর আমার বাবার বাড়ি একসাথে, কারণ, তোমার বাবা আমার আপন খালাতো ভাই। তিনি ভারতে মিলিটারির চাকরি করতেন, আমার খোঁজ খবর নিতেন না। আমাদের এক সময় ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। মা আরও বলে গেলেন— “তখন আমি যুবতী, আমার বাবা ছিলেন না, বড় ভাই ছিলেন না, তখন বাধ্য হয়ে আমার মা আমাকে অন্য জায়গায় বিয়ে দেন। তারপর থেকে এই বাদলা গ্রামে তোমাকে নিয়ে আমি আবার সংসার শুরু করি। তোমার এই বাবার নাম ছিল গহর খলিফা।”
মায়ের কাছে এই প্রথম আমার জীবনকাহিনীর একটা অংশ শুনলাম। মা-ও শুনলেন আমার জীবনের পরবর্তী অধ্যায়গুলো। পরে আমি আবার চলে আসি ফরিদপুরে। আমার মাঝে মাঝেই এই ভেবে অনেক মন খারাপ হত— জীবনে কী না হয়ে গেল! এইভাবেই কি বাকী জীবন চলবে? তারপর একদিন একজন ভালো মানুষ এক পুলিশের সাথে আমার পরিচয় হয়। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি আমার ওখানে ডিউটি করতেন, আর আমার মন খারাপ দেখে মাঝে মাঝে আমাকে জিজ্ঞেস করতেন— “কী হয়েছে তোমার? সারাক্ষণ মন খারাপ থাকে কেন?” তারপর একদিন সবকিছু তাকে খুলে বললাম। তিনি সব কিছু শুনে আমাকে বিয়ে করলেন। তার সাথেই এতদিন সংসার করছি। তিনি ছিলেন আমার কাছে একজন ফেরেস্তার মতো মানুষ। কারণ, সে আমাকে বিয়ে করে বাইরে নিয়ে আসে, সমাজে উঠায়, আমাকে বউয়ের সম্মান, আর আমার মেয়েকে বাবার সম্মান দেয়! এমন মানুষ বোধহয় পৃথিবীতে কমই হয়।
তবে সেই সুখও বেশীদিন টেকেনি। তিনি মারা গিয়েছেন প্রায় চব্বিশ বছর হলো। তারপর থেকে এই টিনের রুমটাতে একাই থাকি। আপনারা মনে করতে পারেন যে, কেন আমি এতদিন মুখ খুলি নাই। স্বামী, সমাজ, মেয়ে এবং নাতি নাতনিদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি সব কথা বুকে জমা রেখেছিলাম। সমাজের অদৃশ্য শৃঙ্খল আমার পায়ে পরানো ছিল। এজন্য আমি মুখ খুলি নাই। আর কেউ তো খুঁজতে খুঁজতে আমার কাছে আসেও নাই। আপনি এসেছেন, এবং আপনাকে আমার খুব আন্তরিক মনে হয়েছে, এজন্য সবকিছু খুলে বললাম।
কিন্তু অবশেষে একটা কষ্ট এখনও আমার বুকে বিঁধে— আমি যেমন আমার বাবার আদর, ভালোবাসা পাইনি, আমার মেয়েটাও প্রকৃত পিতৃ-পরিচয় পায়নি। আমার নিজের বাবার কিছু ছোট ছোট স্মৃতি মনে পড়ে, আমার মেয়েটার তো সেটুকুও নেই। আর জীবনে ঘটে যাওয়া এ দুর্যোগগুলো (আসলে দুর্যোগ নয়, মানুষের এবং সমাজের অদৃশ্য বর্বরতা), যা সমাজ সংসার মেনে নিতে পারেনি আজও, অথচ এ ঘটনাগুলোর জন্য আমি দায়ি নই। ১৯৭১-এ দেশ স্বাধীন হবার পর একজন মেনে নিয়েছিলেন— সে মহামানবের নাম ছিল শেখ মুজিবুর রহমান। যে সকল বীরাঙ্গনা নারীদের বাড়ি ঢোকার দরজা ছিল না, তাদের জন্য তিনি দরজা দিয়ে গেছেন আমাদেরকে সন্তান সম্মোধন করে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরই আমাদের ঠিকানা।
বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বড় কোনো মহামানব হতে পারে না। তিনি আমাদের পিতার নাম দিতে বলেছেন ‘শেখ মুজিবুর রহমান’। তাই মুজিব বর্ষ উপলক্ষে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমি অন্তরের সবটুকু ভালোবাসা নিংড়ে সুঁইসুতো দিয়ে সাদা ক্যানভাসে ফুঁটিয়ে তুলেছি সে মহামানবের প্রতিকৃতি। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। এই ছবির মধ্যে মিশে আছে আমার অন্তর্জ্বালা, বিরহ-বেদনা এবং একটি ইতিহাস ও আদর্শিক সে যুদ্ধ— মুক্তিযুদ্ধ।
কত দুঃখ বেদনা
গ্লানির কথা
লুকানো থাকে
মানুষের মনে, গোপনে,
তবু তারা বেঁচে থাকে
সব সয়ে আভরণে!