বীরাঙ্গনা, তুমি কেন ঈশ্বর হলে না?

আল-আমীন-রেহমান

“ওরা আমাকে সবার সামনে পিটিয়েছে, আমার বিবস্ত্র শরীর দেখে দাঁত বের করে হেসেছে। পানি পানি করে চিৎকার করলে মুখে প্রস্রাব করে দিয়েছে। একটা নারীদেহ যে এমন বীভৎসভাবে বিকৃত ভোগ্য হতে পারে তা বোধ হয় মনোবিজ্ঞানীরাও জানে না।” বলছিলেন একজন বীরাঙ্গনা।

বীরাঙ্গনা শব্দটির দিকে একটু গভীরভাবে তাকালেই বোঝা যায় এটি কী অর্থ বহন করে। বীরের অঙ্গ যার সে-ই বীরাঙ্গনা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ধীরে ধীরে এই মাটিতে সবার মধ্যে একটা অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব দাঁড়িয়ে গেল যে, বীরাঙ্গনা মানেই ধর্ষিতা! যেন ধর্ষিতার প্রতিশব্দ দাঁড়িয়ে গেল বীরাঙ্গনা। দীর্ঘ ত্যাগস্বীকার করা সংগ্রাম বাঙালিকে একটা আস্ত ভূমিসহ স্বাধীনতা দিয়েছিল, কিন্তু শতবর্ষ ধরে লালন করা সংস্কারকে পরিত্রাণ করার শক্তি দেয়নি। না হলে যাদের হাতে নির্মম পাশবিকতায় লাঞ্ছিত হলো, ধর্ষিত হতে হতে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত শরীর নিয়ে হাসপাতাল ভর্তি হয়ে, সুস্থ হয়ে আবার ধর্ষিত হলো, তাদের হাত ধরেই কেউ পাকিস্তান চলে যায়? হ্যাঁ গিয়েছিল, আমাদের বীরাঙ্গনারা।

স্বাধীনতার পরে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে জড়ো করা হলো। নিজ নিজ ঠিকানায় খবর পাঠানো হলো তাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাদের বাপ, ভাই, আত্নীয় আসল। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলো। কিন্তু স্বাধীনতার উল্লাসকে স্তব্ধ করে দিয়ে অনেক বাপ, ভাই এই ধর্ষিতাদের বাড়ি নিয়ে যেতে অপারগতা জানিয়েছিলেন। কারণ, সমাজ নাকি তাদের ত্যাগ করেছে। কি পরিহাস! কি তামাশা! কি নির্মমতা! কি ক্ষুদ্রতা! কি নিমজ্জনের মজ্জাগত এ সমাজ! অনেক বীরাঙ্গনাই বুঝতে পেরেছিলেন তারা ঠিকানা হারিয়েছেন, তাদের আর এ মাটিতে স্থান নেই। সবাই তাদের নষ্টা, ধর্ষিতার নিন্দিত চোখে বাংলার মুক্ত আকাশে আবার ধর্ষণ করবে, এ অপমান সহ্য করার ক্ষমতা তাদের নেই। তার চেয়ে কোনো এক পাকবাহিনীর দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্ত্রী হয়ে পাকিস্তান চলে যাওয়া ঢের ভালো। সেখানে তো আর ধিক্কার দেওয়ার মতো কোনো পরিচিত সমাজ নেই।

হায়রে সমাজ! তোমার জন্ম হয়েছিল আমায় রক্ষা করার জন্য, আর তুমিই কিনা নির্লজ্জ বিকৃত ভক্ষক? একজন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেছিলেন দুটো হাত দিয়ে, আর বীরাঙ্গনা যুদ্ধ করেছেন সমস্ত শরীর দিয়ে। স্বাধীনতার পরও তারা তাদের অন্তঃসত্ত্বা শরীরে বয়ে বেড়িয়েছেন পাপিষ্ঠদের কলুষিত বীর্যের পরিণতি। পরে অবশ্য গর্ভপাতে মুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তি পাননি বাঙালি সমাজের পৌরুষ মানদণ্ডের হাত থেকে। তাই স্বাধীন মাটিতেও তাদের যুদ্ধ চলেছে নিরন্তর। এ যুদ্ধে আর নিজেকে সমর্পিত না করে অনেকেই পাকবাহিনীর সাথে পাকিস্তান চলে যায়। সেখানে গিয়ে তারা তাদের পাসপোর্টে একটানে লিখে দিলেন, ‘জাতীয়তা পাকিস্তানি।’ যে দেশের স্বাধীনতার জন্য মাসের পর মাস ধর্ষিত হলো, বিবস্ত্র দিনরাত কাটালো, স্বাধীনতার সাথেই সাথেই সে দেশের সাথে নাড়ির সম্পর্ক ছেদ করে দিলেন! এমন প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা শুধু তাদেরই ছিল।

হায়রে নারী! তুমি কেন ঈশ্বর হলে না? এ বীরাঙ্গনাদের অনেকেই এখনো বেঁচে আছেন। এ ভূখণ্ডের বাইরে তাদের অনেকেই এখনো দীর্ঘশ্বাসে নিশ্বাস নেয়। সে দীর্ঘশ্বাস শো শো করে ধেয়ে আসে পঁয়তাল্লিশ বছরের স্বাধীন এই দেশের মুক্ত বাতাসে। প্রচণ্ডরকম ভারী করে দেয় এ বাতাসকে। কিন্তু আমরা টের পাই না। এর মধ্যেই প্রতি বছর আনন্দে নিশ্বাস নিয়ে আমরা চিৎকার করে বলি, আজ বিজয় দিবস, আজ ১৬ই ডিসেম্বর!!

#লেখাটি রূপকার্থে মতামতধর্মী, তাই তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি অনভিপ্রেত।