রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলার ৪টি গ্রামে পাহাড়িদের ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এতে ২ শতাধিক বাড়ি পুড়ে গেছে। আগুনে পুড়ে মারা গেছেন গুণাবালা চাকমা (৭০) নামে এক বৃদ্ধা। নিখোঁজ রয়েছেন আরো ৩ জন। শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টার সময় অগ্নিসংযোগ শুরু হয়। চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে উপজেলা প্রশাসন থেকে দুপুর ১২টায় ১৪৪ ধারা জারি করলেও এই ধারা ভঙ্গ করে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিনটিলাপাড়া, মানিকজোর ছড়া, বাত্যাপাড়া, বড় আদাম গ্রামে পাহাড়িদের ঘরগুলোতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এ ঘটনার জন্য বাঙালিদের দায়ী করেছেন পাহাড়িরা। অগ্নিসংযোগের সময় ৩ বাঙালিকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে পাহাড়িরা। এরা হলেন মো. শরীফ (২৮), মো. সবুজ (৩০) ও মো. আবুল খায়ের (৩৭)।
লংগদু থানার ওসি মমিনুল ইসলাম জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ায় প্রশাসন ১৪৪ জারি করে। অপরাধীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানান, লংদুর বাসিন্দা মো. নুরুল ইসলামের লাশ গত বৃহস্পতিবার সকালে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার চার মাইল এলাকায় পাওয়া যায়। তার লাশ নিয়ে শুক্রবার সকালে মিছিল সহকারে লংগদু সদর মাঠে আনা হচ্ছিল। এ সময় ৪/৫ হাজার বাঙালি মিছিল সহকারে সদরের দিকে আসতে থাকে।
মিছিলটি কাত্তল তলার জেএসএস (জনসংহতি সমিতি) অফিসের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তারা ভাঙচুর শুরু করে।
এ সময়ই গুজব ছড়ানো হয় মানিকজোরপাড়ায় দুটি বাঙালি ঘরে আগুন দেয়া হয়েছে। এর পরপরই বাঙালিরা বিক্ষুব্ধ হয়ে দলবদ্ধভাবে পাহাড়ি গ্রামে প্রবেশ করে পাহাড়িদের বাড়িঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চালায়।
তিনটিলার বাসিন্দা ও স্থানীয় জেএসএস নেতা মনিশংকর চাকমা বলেন, আমার ঘর সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। দুপুর ১২টার দিকে ১৪৪ ধারা জারির পরও দুপুর দুটা পর্যন্ত বড় আদাম, বাত্যাপাড়ায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। চার গ্রামে ২ শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে। এগুলো সবই পাহাড়িদের। লংগদু ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের বাড়িতে এক বৃদ্ধা আগুনে পুড়ে মারা গেছে।
লংগদু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কুলিন মিত্র চাকমা বলেন, এ ঘটনায় আড়াইশ’ ঘর পুড়ে গেছে। এটি আরো বাড়তে পারে। আমার বাড়িতে আশ্রয় নিতে এসে গুণাবালা চাকমা বাড়ির ভেতর আগুনে পুড়ে মারা গেছে। ৩ জনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
লংগদু উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. তোফাজ্জল হোসেন বলেন, মোটরসাইকেল চালক নিহতের প্রতিবাদে শুক্রবার সকালে সমঅধিকার আন্দোলন (বাঙালিভিত্তিক সংগঠন), বাঙালি ছাত্র পরিষদ মিছিল বের করে। মিছিলের মধ্যে গুজব ছড়ানো হয়। এর থেকে ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে। কতটি ঘর পুড়ে গেছে এ তথ্য এখনো আমার কাছে নেই।
এদিকে অভিযোগ অস্বীকার করে সমঅধিকার আন্দোলন রাঙ্গামাটি জেলার সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কামাল বলেন, শুক্রবার লংগদুতে তাদের কোনো কর্মসূচি ছিল না। আমি শুনেছি প্রতিবাদী মিছিলের ওপর গুলতি দিয়ে হামলা চালানো হয়। এ থেকে অগ্নিসংযোগের সূত্রপাত হয়েছে। এ ঘটনার নিন্দা, অগ্নিসংযোগকারীদের শাস্তি, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের দাবি জানান এ সমঅধিকার নেতা।
রাঙ্গামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) মোহাম্মদ সাফিউল সারোয়ার ঘটনাস্থল থেকে বলেন, মোটরসাইকেল চালক নুরুল ইসলামের লাশ নিয়ে শোক মিছিল থেকে এই ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে। শোক মিছিলটি বাত্যাপাড়া থেকে রাঙ্গামাটি সদরের দিকে আসছিল। আসার পথে মিছিলটি তিনটিলা এলাকায় প্রবেশ করতেই মিছিল থেকে পাহাড়িদের ঘর বাড়িতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ার শেলও ছোড়ে। পরে মিছিলকারীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে পাহাড়িদের ঘরে হামলা চালায়। মোট কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা এখনো নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। আমি যে এলাকায় পরিদর্শন করেছি সেখানে ২০-৩০টির মতো পোড়া ঘর দেখেছি তবে এটি নির্দিষ্ট নয়। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তিন জনকে আটক করা হয়েছে।
১৪৪ ধারা ও উপজেলা প্রশাসনের জরুরি সভা: ঘটনার পরবর্তী দুপুর আড়াইটার দিকে পরিস্থিতি নিয়ে লংগদু উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জরুরি সভা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) প্রকাশ কান্তি চৌধুরী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) মোহাম্মদ সাফিউল সারোয়ার, লংগদু সেনা জোন কমান্ডার আবদুল আলীম চৌধুরী, বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত লংগদু) তাজুল ইসলাম, আটারকছড়ার ইউপি চেয়ারম্যান মঙ্গল কান্তি চাকমা উপস্থিত ছিলেন। সভায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা, এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হওয়া, অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা বহাল থাকবে।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি সড়কের খাগড়াছড়ি সদর থানার চার মাইল এলাকার মূল সড়কের পাশে মো. নুরুল ইসলামের লাশ পাওয়া যায়। তিনি মোটরসাইকেলে ভাড়ায় যাত্রী নিয়ে লংগদু থেকে খাগড়াছড়ি গিয়েছিলেন।
খাগড়াছড়ি থানার ওসি তারেক মোহাম্মদ হান্নান বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে সড়কের পাশে শুয়ে থাকা অবস্থায় নুরুল ইসলামের মরদেহ পাওয়া যায়। তবে মোটরসাইকেলটি পাওয়া যায়নি। এটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। হত্যা না দুর্ঘটনা তা নিশ্চিত নয় তবে তার শরীরে জখমের চিহ্ন রয়েছে।