শহীদজননী জাহানারা ইমামের ৮৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গতকাল ‘শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের ২৫ বছর’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও ‘মুক্তিযুদ্ধের শহীদস্মৃতি পুরস্কার’ এক সভার আয়োজন করে। ঢাকার ধানমণ্ডীর ডাব্লিউভিএ মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন ঘাতক দালাল নিমূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, জাতীয় প্রেসকাবের সভাপতি মো: শফিউর রহমান, নির্মূল কমিটির সহ সম্পাদক ডা, নূজহাত চৌধুরী এবং কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মুক্তিযোদ্ধা সিনিয়র সাংবদিক কামাল লোহানী।
সূচনা বক্তব্যে শাহরিয়ার কবির বলেন, “তাদের (হেফাজতের) দাবী মানতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোথায় যাবে? সরকারের উচিত সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে শফির বিরুদ্ধে মামলা করা। ২০১৩ সালের ৫মে শাপলা চত্বরে সংগঠিত তাণ্ডবের এক নম্বর হুকুমের আসামী হওয়ার কথা শফির, কিন্তু আমরা তার বিরুদ্ধে সরকারকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখলাম না। রাজনীতিতে কৌশল থাকবে কিন্তু কৌশল করতে গিয়ে এত ছাড় দিলে সবকিছু ভুলুণ্ঠিত হবে। তাদের কে ছাড় দেওয়া হচ্ছে কিন্তু হেফাজত তাদের ১৩ দফা থেকে সরে আসছে না।”
তিনি আরো বলেন, “জঙ্গিবাদ আমাদের সমাজে শুধু বিচরণই করছে না, তারা লড়াই ঘোষণা করেছে। আমাদেরকেও লড়াই করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে একত্রিত হয়ে লড়াই করতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক, লেখক মুনতাসীর মামুন বলেন, “নির্মূল কমিটি পঁচিশ বছর ধরে একটি লক্ষ সামনে রেখে আন্দোলন চালিয়ে গেছে, এটি পৃথিবীতে বিরল। রাজনীতিবিদরা বিচ্যুত হলেও আমরা বিচ্যুত হইনি। ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের জন্য নিমূল কমিটিই প্রথম দাবী তুলেছিল। আমাদের দাবী অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে, তবে অনেক ক্ষেত্রে দেরি হয়েছে এবং তার জন্য জনগণকে মূল্য দিতে হয়েছে।”
তিনি আরো বলেন, “মুফতি হান্নানের সাথে শাহরিয়ার কবিরের নেওয়া ইন্টারভিউতে মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিতে উঠে এসেছে যে হাওয়া ভবন একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলায় জড়িত ছিল। এই আহমদ শফি প্রথম নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দকে মুরতাদ ঘোষণা করেছিল, এখন বাঙ্গালী মুসলমান সবাইকে মুরতাদ ঘোষণা করতে চাইছে, কারণ, তারা দেশটাকে পাকিস্তান বানাতে চায়। শফিরা শাপলা চত্বরে আন্দোলনে গিয়েছিল, গাছপালা উপড়ে ফেলছিল সরকার উৎখাতের জন্য, এখন সেই শফিরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে গম ঠুকরে খাচ্ছে। তারা এখন গম খাওয়ার রাজনীতি করছে। শফিরা এখন আওয়ামী লীগের পোষা কাক হয়েছে। আমাদের দেশে গম খাওয়ার লোক বেড়ে যাচ্ছে, বুদ্ধিজীবিরাও এখন আর আন্দোলনে নামে না।”
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, “শিক্ষা ব্যবস্থার যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে ভবিষ্যত প্রজন্মের ভবিষ্যত উজ্জ্বল হওয়া কঠিন।” গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি বলেন, “গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সরকার কর্তৃক যতটুকু খর্বিত হয় তার চেয়ে অনেক বেশি তারা বাঁধা থাকে বহুজাতিক কোম্পানিদের কাছে। মোবাইল কোম্পানিগুলো জনগণের সাথে ঔপনিবেশিক আচরণ করছে, কিন্তু কোনো মোবাইল কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনো গণমাধ্যম প্রতিবেদন করার মত ক্ষমতা বা ইচ্ছা রাখে না।”
শফিদের হুমকি ধমকিতে ঘাবড়ানো কিছু নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন। মাত্র দশ হাজার শিক্ষক বুদ্ধিজীবি রাস্তায় নামলে অনেক বড় কাজ হয়ে যাবে বলে তিনি জোর দিয়ে বলেন। চায়নার কমিউনিস্ট পার্টি মাত্র ৭জন শুরু করেছিল বলে তিনি প্রসঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করেন।
শহীদ জায়া শ্যামলী নামরিন চৌধুরী নির্মূল কমিটির বর্তমান সভাপতি শাহরিয়ার কবির এবং সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুলকে জাহানারা ইমামের ডান এবং বাম হাত উল্লেখ করে বলেন, “যুদ্ধাপরাধের বিচার শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলন ছাড়া হত না। জাহানারা ইমামের সাথে সবসময় ছিলেন দেশনেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, হচ্ছে, তবে অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠনে আমরা এখনো সফল হইনি। আশার বিষয়, তরুণ প্রজন্ম নির্মূল কমিটিতে যুক্ত হচ্ছে, তারা হাল ধরছে।”
জাতীয় প্রেস কাবের সভাপতি মো: শফিউর রহমান বলেন, “অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মানাবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলে, কিন্তু জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাদের কোনো কথা নেই। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আমাদের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা নিয়েও কোনোদিন কোনো কথা বলেনি। দেশে এখন জঙ্গিবাদ-পাকিস্তানবাদ চোখ রাঙ্গাচ্ছে, ফলে দ্বিধাগ্রস্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দুঃখজনক হচ্ছে দেশে সাংবাদিকেরাও এখন অনেক ধনী হয়ে গেছে, তারা টাকা পাচার করছে, বিদেশে বাড়ি বানাচ্ছে। এভাবে চলতে পারে না। আবার আমাদের একত্রিত হয়ে আন্দোলনে নামতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এমপি বলেন, “’৭৫ এর পর বাংলাদেশ আবার অন্ধকার বলয়ে ঢুকে পড়েছে। বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে শিক্ষা জীবন তথা সমাজ জীবন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার আন্দোলন নির্মূল কমিটিই শুরু করেছিল। ১৯৯১ সালে গণআদালত প্রতিষ্ঠা করে বিচারক নিয়োগ করে গণরায় দেওয়া হয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নির্মূল কমিটির এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। জাহানারা ইমামের শুরু করা আন্দোলন এবং বর্তমান নির্মূল কমিটি হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগের প্রধান অঙ্গিকার ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার। জনগণ সে কারণেই ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছে। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত সংসদের প্রথম অধিবেশনেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী তোলা হয়েছিল। সেই সময় খালেদা জিয়া সংসদে অনুপস্থিত থেকে প্রমাণ করেছিলেন যে তিনি আসলে যুদ্ধাপরাধীদের দোসর।”
তিনি আরো বলেন, “শুধু জামায়াত নিষিদ্ধ করলে হবে না, বিএনপি থাকলেও জঙ্গি নির্মূল হবে না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ হবে না। বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে জঙ্গীর সঙ্গী উল্লেখ করে তিনি বিএনপি কে জঙ্গী তৈরির কারখানা বলে উল্লেখ করেন।”
সর্বশেষ অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে সাংবাদিক কামাল লোহানী বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, “খালেদাজিয়া ক্ষমতায় থাকাকালীন জাহানারা ইমামকে নিপীড়িত হয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। আমাদের ২৪ জনের বিরুদ্ধে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা করেছিলেন। এগুলো ভুলে গেলে হবে না।”
জাহানার ইমামের লেখা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটিকে একটি অসাধারণ বই হিসেবে তিনি আখ্যায়িত করেন এবং বইটিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দালনের একটি নিয়ামক শক্তি হিসেবে দেখেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে জনাব লোহানী সাঈদীর বিচার সমাপ্ত না হওয়ার বিষয়টিকে উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেন। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে তিনি বলেন, “শুভশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা দশ হাজার একত্রিত থাকলেই হবে। বাংলাদেশ হারিয়ে যাবে না অন্ধকারে।”