ছোটগল্প: অবহেলিত

follow-upnews
0 0

ছোট বেলায় আমি ছিলাম খেলা পাগল। একেবারে ছোটবেলার কথা, প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম যখন। খুব ছেলেবেলার কথা কিছু মনে নেই। আট-নয় বছর বয়স পর্ন্ত আমার খাই খাই ছিল। শুধু খেতে চাইতাম। চারটা ডিম সিদ্ধ হয়েছে রান্নার জন্য, কুট্টিকালে একা সেই চারটে ডিমই আমি খেয়ে ফেলেছি, মায়ের কাছে শোনা গল্প।

বড় বোন এবং ছোট ভাইয়ের সাথে বয়সের ব্যবধান তিন বছরের, ফলে সবকিছু নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগেই থাকত। সে অবশ্য খুব বেশি দিনের কথা নয়। বড় বোন বড় হয়ে যায় হঠাৎ। ও আর আমাদের খেলায় খুব একটা আসে না। ছোট ভাইয়ের সাথে মল্লযুদ্ধ হত। ওর সাথে মারামারিটাই ছিল প্রধান খেলা। জিততাম না, কারণ ও আন্ধারে ঘাই দিত। আমি ভেবেচিন্তে মারতে চাইতাম, ফলে হেরে যেতাম।

বাবা বাড়িতে এসে আমাদের নালিশ শোনার আগেই মায়েক কাছে বিভিন্ন বিষয়ে কৈফিয়ত নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। চরম অভাবের সংসারে মনের আভিজাত্য ধরে রাখা যায় না। বাবার বাহিরের আভিজাত্য ঘরে আসার সাথে সাথে লবণে ধরা মাটির দেওয়ালের মত চুরচুর করে ঝরে পড়ত।

বৃষ্টির দিনে কষ্টের সীমা থাকত না। খড়ের ঘরের বিভিন্ন জায়গা থেকে পানি গড়াত। গামলা, বালতি পেতে মা ঠেকানোর চেষ্টা করতেন। কাজ হত না তাতে। খুব বড় পাত্রও ছিল না যা দিয়ে গড়ানো সব পানি ধরা যায়। ঘর কাঁদা কাঁদা হয়ে যেত। আমরা খাটে উঠে বসে থাকতাম। খাটের উপরেও পানি পড়ত। রান্নাঘর এবং বড় ঘরের মাঝখান ভেসে যেত ফুটো ডোঙ্গার পানি পড়ে। চুঙ্গো দিয়ে ফুঁকে ফুঁকে মা চাল-ডাল মিশিয়ে রান্নার চেষ্টা করতেন।

ঘরে কিছু খেসাড়ির ডাল থাকত। বর্ষাকালে উঠোনে ডাঁটা হত। ঐ দিয়ে খিচুড়ি রান্না করতেন। তাই ছিল অমৃত। পেট পুরে খেতাম। বাবা খেতে পারতেন খুব। আমরা এক নাগাড়ে বেশিদিন বাড়িতে থাকতাম না মামা বাড়ি কাছে হওয়ায়। সপ্তাহে দুই তিনদিন মামাবাড়িতে থাকতাম। মামাবাড়ি অনেক বড় ঘর ছিল। দোতলা টিনের ঘরে ইচ্ছেমত দৌড়াদৌড়ি করা যেত। বাবা প্রায়ই সেখানে গিয়ে হাজির হতেন।

মামা বাড়িতে তখন আগের জৌলুস ছিল না, তারপরেও যতটুকু যা ছিল আমাদের তুলনায় সে হাজার গুণ। এভাবে প্রাইমারি স্কুলের দিনগুলো পার হয়েছে, পড়াশুনা বলতে শুধু স্কুলে যাওয়া। মনে নেই, তবে শুনেছি শুরুতে আমি পাঠ নিয়েছি আমার এক মাসির কাছে (এখন যিনি ভারতে থাকেন)। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সময় নাকি প্রধান শিক্ষক আমার পারদর্শীতায় মুগ্ধ হয়ে রোল এক করে দিয়েছিলেন।

ঐ একবারই জীবনে আমি ক্লাসে ফাস্ট হয়েছি। কোনোদিন নিজেকে ভাল ছাত্র ভাবতে পারিনি। প্রাইমারি স্কুলে আমার রোল পাঁচের মধ্যে থাকত। পাঁচের মধ্যে কীভাবে থাকত সেটাই এখন বিস্ময়। প্রকৃতপক্ষেই আমি কিছুই পড়তাম না।

বাবার সাথে তেমন কোনো ঘনিষ্ট স্মৃতি মনে পড়ে না। একটা বিষয় শুধু মনে পড়ে। উনি পোস্ট মাস্টার ছিলেন। গ্রামের পোস্ট অফিসে মাত্র দুই ঘণ্টার দায়িত্ব পালন করতেন। ঐ সময়টুকু আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ ছিল। আমি ক্লাসের ফাঁক খুঁজে ডাকঘরের চারপাশ দিয়ে এমনভাবে ঘোরাঘুরি করতাম যাতে ওনার চোখে পড়া যায়। এমনভাবে করতাম যেন কোন কাজে এসেছি বা এমনিই ঘুরতে এসেছি, উনি না দেখলে কোন ক্ষতি নেই। ডেকে নিয়ে বাবা এক টাকা দিতেন। তখন এক টাকায় অনেক কিছু হত।

আমি বিস্কুট, চানাচুর বা মুড়ি কিনে খেতাম। মাঝে মাঝে কাজের ব্যস্ততার কারণে বাবা আমায় দেখতে পেতেন না। তখন টিনের বেড়ায় কলম দিয়ে ঘসে ঘসে ওনার মনোযোগ অাকর্ণের চেষ্টা করতাম। ওটা করত গিয়ে কোন কোনদিন টিনের ফাঁকে কলম পড়ে আটকে যেত। বিভিন্নভাবে কলম হারিয়ে যেত। কোনোভাবেই একটা কলম এক দিনের বেশি ব্যবহার করতে পারতাম না।

দিদিমার স্কুলে পড়তাম বেলে বেঁচে যেতাম। উনি ব্যাগ থেকে কলম বের করে দিতেন। বাবা দিদিমার কাছে বকা খেতেন আমার কলম থাকে না বলে। সমাপনী পরীক্ষার রেজাল্ট ভাল না হওয়ায় কষ্ট লাগত তবে মেনে নিতাম পরে অনেক ভাল করব নিজের কাছে এমন প্রতিশ্রুতি রেখে, যদিও স্কুলে কোনোদিনই আমি রেজাল্ট ভাল করিনি। -চলবে

Next Post

অবহেলিত দিনগুলি

পূর্ব প্রকাশের পর একটা বয়স পর্যন্ত সন্তানের মা-বাবার প্রতি কোনো মনোযোগ থাকে না, থাকে শুধু আবদার। আবদার করার খুব সুযোগ পেতাম না, বাবা মাকে কাছে পাওয়ার সুযোগ ছিলও খুব কম। বাবা বাইরে বাইরে বেশি খাকতেন। মা চরম অগোছালো এবং চরম অভাবের সংসারে হিমসিম খেতেন। মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন থাকতেন বছরের অর্ধেক সময়, […]