এবার (২০২৩) সাহিত্যে নোবেল পেলেন নরওয়েজিয়ান বহুমাত্রিক সাহিত্যিক জন ফসে

follow-upnews
0 0

জন ফসে, পুরো নাম জন ওলাভ ফসে (জন্মঃ ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯, হাউজসুন্ড, নরওয়ে), উপন্যাস, নাটক, কবিতা, শিশুদের বই এবং প্রবন্ধের নরওয়েজিয়ান লেখক তিনি, যিনি একজন প্রশিক্ষক এবং একজন অনুবাদক হিসেবেও কাজ করেছেন। তিনি ২০২৩ সালে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ‘তার উদ্ভাবনী নাটক এবং গদ্যের জন্য, যা অকথ্যকে কণ্ঠ দেয়।’

ফসে নরওয়ের স্ট্র্যান্ডেবারমের কাছে একটি গ্রামীণ খামারে বেড়ে ওঠেন, যেখানে তার দাদা-দাদি একটি বাড়িতে থাকতেন, এবং তিনি, তার বাবা-মা এবং দুই বোন অন্যটিতে থাকতেন। তার বাবা স্ট্র্যান্ডেবার্ম কোঅপারেটিভের একজন ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন, এটি ছিলো মূলত একটি স্থানীয় মুদি দোকান, এবং তার মা ছিলেন একজন তত্ত্বাবধায়ক (কেয়ার গিভার)। ফসেকে বড় করা হয়েছিলো একজন লুথেরান হিসেবে (ধর্মযাজক মার্টিন  লুথারের অনুসারী), যদিও পরে তিনি নাস্তিক হয়ে একটি ব্যান্ডে যোগ দিয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন। নিজের অ্যাকাউন্টে তিনি ১২ বছর বয়স থেকে লিখতে শুরু করেছিলেন— প্রথমে গানের কথা রচনা করতেন এবং পরে কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। ১৯৭৯ সালে ফসে হাই স্কুল থেকে স্নাতক হন এবং বার্গেনে চলে আসেন, যেখানে তিনি গুলা টিডেন্ড পত্রিকার জন্য কাজ শুরু করেন। একই বছর তিনি বাবা হন এবং পরের বছর তিনি তার সন্তানের মাকে বিয়ে করেন। পরবর্তী দশকগুলোতে তিনি আরো দু’বার বিয়ে করেন এবং পাঁচটি সন্তানের জন্ম দেন। পাশাপাশি ১৯৮০-এর দশক জুড়ে তিনি বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন, ১৯৮৭ সালে তুলনামূলক সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৮০-এর দশক জুড়েই ফসে তার প্রথম উপন্যাসগুলো প্রকাশ করেন। যেমন, রাউডট, উপন্যাসটি আত্মহত্যার বিষয়বস্তু নির্ভর। এটিই তার প্রথম উপন্যাস, প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে। ১৯৮৫-তে ‘স্ট্রিংড গিটার’ উপন্যাসটি প্রকাশ পায়। উপন্যাসটি নিজেকে বন্দী করে রাখা একজন মাকে নিয়ে। দু’টি কাজই প্যারড-ডাউন গদ্যের বৈশিষ্ট্যযুক্ত, যার জন্য ফসে পরে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তিনি তার প্রথম কবিতার সংকলন ‘এঙ্গেল মেড ভ্যান আই অজিন’ প্রকাশ করেন ১৯৮৬ সালে, এবং তার প্রথম প্রবন্ধ সংকলন ‘ফ্রা টেলিং ভায়া শোয়িং টিল’ প্রকাশ করেন ১৯৮৯ সালে। এই সময়ের মধ্যে তিনি নিজেকে সমর্থন করার জন্য হর্ডাল্যান্ডের একাডেমি অফ রাইটিং-এর একজন প্রশিক্ষক হয়েছিলেন। ফসে তার নৌসেট (১৯৮৯, বোথহাউস) উপন্যাসটি প্রকাশনার সাথে সাথে তার দেশে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করেন। উপন্যাসটি ৩০ বছর বয়সী একজন যুবককে ঘিরে, যিনি জীবনের সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ হন। যুবকটি তার মায়ের বাড়িতে মায়ের সাথে একাকী থাকেন। সুযোগে একজন প্রাক্তন ব্যান্ডমেটের মুখোমুখি হন। যুবকটি তার এক পুরনো বন্ধুর বিয়ে ব্যাহত করেন। এটি একটি সার্থক ক্রাইম নোভেল।

হেনরিক ইবসেনের পরে ফসেকেই নরওয়ের সেরা নাট্যকার ভাবা হয়। অথচ ফসে কখনো নাটক লিখবেন ভাবেননি, এবং প্রথমদিকে তিনি এরকম অনেক প্রস্তাব ফিরিয়েও দিয়েছিলেন। এরপর মূলত অর্থাভাবে তিনি নাটক লিখতে শুরু করেন। প্রথম নাটকটি লেখার পরে তিনি কাজটিকে অনেক সহজ বলে বর্ণনা করেন। ফসে বলেন, নাটক লিখতে শুরু করা আমার লেখালেখির জীবনে সবচেয়ে বড় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মঞ্চস্থ করা তার প্রথম কাজটি ছিলো— ওগ অলড্রি স্কাল ভি স্কিলজাস্ট (এন্ড নেভার শ্যাল উই পার্ট), যা  ১৯৯৪ সালে বার্গেনের ন্যাশনাল থিয়েটারে পরিবেশিত হয়েছিলো। এরপর তিনি নামনেট (১৯৯৫, দ্য নেম) সহ অনেক নাটক লেখেন। ফরাসী পরিচালক ক্লদ রেজির ১৯৯৯ সালে ফসের নাটক ‘সামওয়ান ইজ গোয়িং টু কাম ইন’ প্যারিসে মঞ্চায়ন করেন, যা তাকে ইউরোপে পরিচিতি এনে দিয়েছিলো। এই সাফল্যের পরে ফসে প্রাথমিকভাবে নাটক লেখার দিকে মনোনিবেশ করেন। গদ্যের মতো তার মঞ্চের কাজগুলোতেও প্রত্যাশা এবং সন্দেহের দোলাচল এমনভাবে থাকে, যেন চরিত্রগুলো বাস্তবেই বাস করছে।

যদিও ফসে ১৯৯০ এবং ২০০০-এর দশকের বেশিরভাগ সময় নাটক লেখার দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন, তিনি মাঝে মাঝে গদ্যও প্রকাশ করেছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে মেলানকোলিয়া-১ (১৯৯৫, মেলানকোলি-১) এবং মেলানকোলিয়া-২ (১৯৯৬, মেলানকোলি ২)। এ দু’টি রচনা মূলত ১৯ শতকের নরওয়েজিয়ান চিত্রশিল্পী লারসের জীবনের একটি কাল্পনিক রূপ, হার্টারভিগ লারস্, যিনি একসময় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর ফসে মর্গন ওগ কেভেল্ড (২০০০, মর্নিং অ্যান্ড ইভিনিং) উপন্যাসটি লেখেন, এটি এমন একজন ব্যক্তিকে নিয়ে, যিনি তার বাবা-মায়ের আশা নিয়ে ফিরেছিলেন যে তিনি একজন জেলে হবেন, এবং একই ধরনের আখ্যান নির্ভর ‘ডেট এর আলেস’ (২০০৪, অ্যালিস অ্যাট দ্য ফায়ার) লেখেন।

২০১০-এর দশকের শেষের দিকে ফসে ট্রিলজিন (২০১৪, ট্রিলজি) লেখা শুরু করেন, যার মধ্যে রয়েছে অ্যান্ডভাকে (২০০৭, ওয়েকফুলনেস), ওলাভস্ ড্রমার (২০১২, ওলাভস্ ড্রিম), এবং কেভেলসেভড্ (২০১৪,  ক্লান্তি)। গল্পটি তাদের বংশধরদের মাধ্যমে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসে এবং আলিদা নামের এক দম্পতির গল্প বলে। ফসে তার এ কাজের জন্য ২০১৫ সালে নর্ডিক কাউন্সিল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন।

অনেক সমালোচক ফসের সেপ্টোলজিকে তার ম্যাগনাম ওপাস (সেরা রচনা) বলেছেন। ফসে ২০১২ সালে নাটক লেখা থেকে বিরতির শুরুতে সাত খণ্ডের উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। এই সাত খণ্ডের উপন্যাসই ফসের সেপ্টোলজি। এসময় তিনি মদ্যপান বন্ধ করেন, রোমান ক্যাথলিক ধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং তার তৃতীয় স্ত্রীকে বিয়ে করেন।

২০২০ সালে ফসে আবার নাটক লেখায় মনোনিবেশ করেন। এবং এ সময় তার লেখা সকল নাটক নরওয়েজিয়ান থিয়েটারে পরিবেশিত হয়। ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয় ফসের অন্যতম সেরা উপন্যাস কেভিটলেইক (অ্যা শাইনিং), যেখানে একজন ড্রাইভার নিজেকে নওয়েজিয়ান জঙ্গলে হারিয়ে ফেলেন। যেতে যেতে তিনি জঙ্গলের অনেক গভীরে চলে যান। বোকামী হচ্ছে জেনেও তিনি ফিরে না এসে যেতে থাকেন। জীবন এবং মৃত্য নিয়ে এটি একটি অসাধারণ উপন্যাস।

মৌলিক সাহিত্য রচনার পাশাপাশি ফসে অনুবাদের কাজও উপভোগ করেছেন। তিনি অস্ট্রিয়ান কবি জর্জ ট্রাকলের সেবাস্টিয়ান আই ড্রাম (২০১৯, সেবাস্টিয়ান ড্রিমিং) এবং অস্ট্রিয়ান কবি রেইনার মারিয়া রিল্কের ডুইনো-এলিজিয়ার (২০২২, টেন এলিজিস), সহ নাইনর্স্কে এবং আরো তার প্রিয় লেখকদের কাজ অনুবাদ করেছেন। ফসের শিশুদের বইয়ের মধ্যে রয়েছে ডাইরেহেগেন হার্ডানগার (১৯৯৩, হার্ডেনজার চিড়িয়াখানা), কান্ট (২০০৫), এবং স্পেলেজেন্তা (২০০৯, প্লে গার্ল)।


২০১১ সাল থেকে ফসকে গ্রোটেন দেওয়া হয়েছে, এটি নরওয়েজিয়ান রাষ্ট্রের মালিকানাধীন একটি সম্মানজনক বাসস্থান এবং অসলো শহরের কেন্দ্রস্থলে রয়্যাল প্যালেসের প্রাঙ্গনে অবস্থিত। নরওয়েজিয়ান শিল্প ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য নরওয়ের রাজার কাছ থেকে বিশেষভাবে এই সম্মানে ভূষিত একজন ব্যক্তির স্থায়ী বাসস্থান হিসাবে গ্রোটেন দেওয়া হয়।


ফলোআপ নিউজ ডেস্ক

Next Post

এক নতুন বাংলাদেশ // অগ্নি বিহঙ্গ

আজানের পাশে বাজে ‘দুর্গে দুর্গে — দুর্গতিনাশিনী’, মনে আফশোস জাগে এইখানে আগে কেন আসিনি।   বিদ্বেষ-বিভ্রাট নিয়ে আমিও ছিলাম ঐ একই দলে, খবর পাইনি— কত পানি মাঝে বয়ে গেছে রূপসার জলে।   হিসেব রাখিনি ত্রিশ লক্ষ শহীদের হাহাকার, কত রক্ত নিয়েছে পাক বাহিনী ও তার দোসর রাজাকার!   বাঙালিকে তবু […]
বাংলাদেশ