দিব্যেন্দু দ্বীপ
রুবেল খাবার দিত। আমি টেবিল পরিষ্কার করতাম। ছাত্রদের খাওয়ার পরে আমরা যারা ক্যান্টিনে টেবিল পরিষ্কার করি তাদের পরিষ্কার বলে ডাকা হয়। ছাত্ররা পরিষ্কার বলে ডাক দিলে আমরা গিয়ে টেবিল পরিষ্কার করে দিই।
বেশিরভাগ ছাত্রই আমাদের নাম জানার প্রয়োজন মনে করে না। যারা খাবার দেয় তাদের নাম অবশ্য ছাত্ররা জেনে নেয়।
বা হাতে একটা বালতি, আর ডান হাতে কোল বালিশের মতো কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে আমি টেবিল থেকে টেবিলে ঘুরে বেড়াই। যারা খাবার দেয় ওদেরও একটা সাধারণ নাম রয়েছে। ওদের মেসিয়ার বলে ডাকা হয়।
মেসিয়াররা পরিষ্কারদের সাথে ভাল ব্যবহার করে না। ক্যান্টিন মালিক এবং বেশিরভাগ ছাত্ররা মেসিয়ার, পরিষ্কার সবার সাথে দুর্ব্যবহার করে, মারধরও করে। মেসিয়াররা পরিষ্কারদের উপর ঝাল মেটাতে পারে। আমরা ঝাল মেটাই কুকুর-বিড়াল সামনে পেলে কষে একটা লাথি মেরে।
কাজ বাবদ ক্যান্টিন মালিক আমাদের কোন টাকা দেয় না, শুধু খাওয়া আর থাকা ছাড়া, খাওয়া মানে যেসব খাবার বেঁচে যায়, থাকা বলতে খাবার টেবিলগুলোতে রাতে শুয়ে থাকা।
পরিষ্কারদের কোন বেতন নেই, তবে মেসিয়ার হতে পারলে কিছু বেতন পাওয়া যায়। পরিষ্কার থেকে মেসিয়ার হতে প্রায় এক বছর লেগে যায়। কেউ কেউ অবশ্য অনেক দ্রুত মেসিয়ার হয়ে যায়। আবার কোনো কারণে মালিক অসন্তুষ্ট হলে মেসিয়ার হওয়া সম্ভব হয় না।
নতুন মেসিয়াররা পরিষ্কারদের উপর বেশী নির্যাতন করে। বয়স্ক একজন পরিষ্কার ছিল, তার সাথেও মেসিয়াররা খারাপ ব্যবহার করত। বয়স কোনো বিষয় নয়, যেহেতু তারা মেসিয়ার তাই পরিষ্কারদের সাথে খারাপ ব্যবহার তারা করবেই। এতে তাদের আনন্দ হয়, কিছুটা হলেও এভাবে তারা মালিকানার স্বাদ উপভোগ করে।
আমাদের ঘুমানোর ব্যবস্থাটা চমৎকার। বাড়িতে ছনের ছাউনি এবং পাতার বেড়া ঘেরা ঘরে শীত-বর্ষায় খুব কষ্টে কাটে। সে তুলনায় এ খুব ভাল আয়োজন। বাড়িতে পিতা-মাতা কষ্ট করে, আবার সুখ অনুভব করে আমাদের ভাল থাকার গল্প শুনে। গল্প কিছু তাই বানিয়েও বলতে হয়।
আমরা চাকরি পেলে তারা পাড়া-প্রতিবেশীকে বলে বেড়ায়। ছেলের চাকরি পাওয়ার কথা বলে তারা অহংকার করতে চায়, এমন নয়, প্রয়োজনেই তারা বলে। ছেলের চাকরির কথা বলাতে বাড়ির পাশের দোকানদার দশ-বিশ টাকার কিছু বাকিতে দিতে আস্থা পায়।
আমরা পরিষ্কাররাও মাঝে মাঝে কিছু নগদ টাকা হাতে পাই, যদিও তা পরিমাণে খুব কম। ছাত্ররা দোকান থেকে কিছু আনতে দিলে ফেরত দুই-চার টাকা থাকলে আমাদের দিয়ে দেয়। সব ছাত্ররা দেয় না। অনেকেই আছে গাঁয়ে হাত বুলিয়ে ফ্রি কাজ করিয়ে নেয়।
পলিটিক্যাল ছাত্ররা আবার অন্য চিজ, তারা কখনো গায় হাত বুলাতে আসে না। ধমক ধামক দেয়, চড়-থাপ্পড় দেয়। তাদের কাজ করে দিতে হয় ভয়ে। আবার মাঝে মাঝে কিছু টাকা-পয়সাও কেউ কেউ দেয়।
দুই মাস আগে রুবেল পরিষ্কার থেকে মেসিয়ার হয়েছে। প্রমোশন পেলে সবাই খুশি হয়, হাবভাব বদলে যায়। সরাসরি মেসিয়ারদের চেয়ে যারা প্রমোশন পেয়ে মেসিয়ার হয় তারা পরিষ্কারদের উপর বেশী নির্যাতন করে। রুবেল ব্যতিক্রম, ও সবসময় একই রকম ছিল। মেসিয়ার হলেও ও পরিষ্কারদের সাথে ঘুমাত। অন্য মেসিয়াররা অবশ্য বিষয়টা কখনো ভালভাবে নেয়নি। রুবেল এসব গায় মাখে না।
ও কথা খুব কম বলে, চুপচাপ কাজ করে যায়। নিচের পোস্টে কাজ করলেও রুবেলের সাথে আমার ঘনিষ্টতা ভাল। আমি ওকে রুবেল ভাই বলি, ও শাহিন ভাই বলে। বয়স মনে হয় আমাদের সমানই হবে।
ও লম্বা এবং স্বাস্থ্যবান, আমি লিকলিকে পাতলা এবং খাটো। ও আমাকে শাহিন ভাই ডাকলে শুনতে বেখাপ্পা লাগে। আবার ভালও লাগে, যখন ভাবি একজন মেসিয়ার পরিষ্কারের সাথে ভাই সম্বোধনে কথা বলছে।
রুবেলের কল্যাণে আমি মাঝে মাঝে মেসিয়ার হওয়ার সুযোগ পেতাম। মেসিয়াররা বাজার করে, একেক দিন পালা করে তারা বাজার করতে যায়। দুইজনে বাজার করে। রুবেলের বাজারের দিন আমি ওর সাথে যেতাম। প্রথম দিন এক টাকা কেজি দরে কুমড়ো কেনা দেখে আমার হাসতে হাসতে বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল।
কুমড়াগুলোর একপাশ ভালো একপাশ খারাপ। এভাবে দু’শো টাকার তরকারি দিয়ে দুইশো ছাত্রের সারাদিন খাওয়া হয়ে যায়! তরকারিগুলো দেখে আমার খারাপ লাগে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনগুলোতে বাজার থেকে বাতিল সব জিনিস এনে ছাত্রদের খাওয়ানো হয়। পয়ত্রিশ-চল্লিশ টাকা দিয়ে ছাত্ররা দশ-পনের টাকার খাবার খায়।
এত লাভের সবটা অবশ্য মালিক একা ভোগ করতে পারে না। তার এসব অপকর্মের কথা জেনেও যারা চুপ থাকে, তারা ভাগ পায়, তারা তাকে রক্ষাও করে।
এইসব দলবদ্ধ দুর্বৃত্তপনার ফলে মালিকই শেষ পর্যন্ত লাভবান হয়। ঠকে সাধারণ ছাত্ররা। শুনেছি আমাদের ক্যান্টিন মালিক জমির মিয়া মিরপুরে পাঁচ কাটা জায়গা কিনেছে, কেরানিগঞ্জেও নাকি তার জায়গা আছে।
কিছুদিন ধরে বাজার থেকে এসেই রুবেল টেবিলের উপর শুয়ে পড়ে। আগে থেকেই ও সবসময় হঠাৎ ক্লান্ত হয়ে পড়ত। ঘুমানোর জন্য ক্যান্টিনে টেবিল ভাগ করা থাকে। বড় বড় টেবিল। একজন ঘুমালে আরাম করে ঘুমানো যায়। আমার টেবিলে কোত্থেকে এক ভবঘুরে এসে শুয়ে ছিল। সেদিন সারারাত দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ছিলাম।
সাড়ে পাঁচটা বাজতেই আমাদের উঠে পড়তে হয়। সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত কাজের বিনিময়ে আমরা খাওয়া এবং থাকা পাই।
রুবেল খাওয়া থাকার অতিরিক্ত পাঁচশো টাকা পায়। রুবেলের তিন বছর বয়সে ওর বাবা-মা এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে। খালার কাছে বড় হয়েছে। মাসে পাঁচশো টাকা ও খালার কাছে রাখে।
আগের তুলনায় রুবেল অনেক শুকায়ে গেছে। প্রায়সময় ও দুর্বলতার কথা বলে। “শাহিন ভাই, কিছু ভাল লাগে না, খাইতে মন চায় না। শরীরে কাম-কাজ করবার বল পাই না। কই জামু? খালার অবস্থাতো ভাল না।
শাহিন ভাই, “আমি মনে হয় আর বেশিদিন বাঁচব না।” আমি ওকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিতাম। দেখতে পেতাম, ওর চোখ ছলছল করছে, চোখের পানি লুকানোর জন্য ও উঠে চলে যেত।
পরের দিন পরামর্শ করে আমরা ক্যান্টিনের কাজ ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কয়েকদিন পরে আমরা একটা ফার্মে কাজ নিলাম। আমাদের কাজ হল, ইলেক্ট্রিশিয়ানদের হেল্প করা।
কাজটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ডিউটি কম। আমরা দশটা-সাতটা ডিউটি করি। কোম্পানি বিভিন্ন জায়গায় ফিটিংসের কাজ কন্ট্রাক্ট নেয়। আমরা জিনিসপত্র নিয়ে ইলেক্ট্রিশিয়ানদের সাথে যাই।
কাজটা কঠিন হলেও ক্যান্টিন বয় হওয়ার চেয়ে ভাল। সারাদিন “পরিষ্কার পরিষ্কার” ডাক শোনার চেয়ে না খেয়ে মরাও ভাল।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টিন, কত মেধাবী মানুষ সেখানে! ক্যান্টিন বয়দের নাম লিখে গলায় একটা কার্ড ঝুলিয়ে দিলেইতো হয়, নাম ধরে সবাই ডাকতে পারে।
ছেড়ে এসেছি, এখন আর ওসব নিয়ে ভাবতে চাই না। আমার বর্তমান বেতন মাসে ছয় হাজার টাকা, দেখতে একটু বড়সড় বলে রুবেল ভাইয়ের বেতন মাসে আট হাজার টাকা।
বেতনের অর্ধেক আমি বাড়িতে পাঠাই। রুবেল খাওয়া-থাকা বাদে বাড়তি টাকাটা আগের মত ওর খালার কাছে জমা রাখে।
ইদানিং রুবেল শরীরে একেবারেই বল পাচ্ছে না। ভারি যন্ত্র টেনে তুলতে গেলে ধপাস করে পড়ে যায়। রোজ বসের ধমক খাচ্ছে। কয়েকদিন হল ও আর কোনো ভারি কাজ করতে পারছে না। খাবার-টাবার এনে দেয়ার কাজ করছে শুধু।
আজকে ও ভীষণ জ্বর নিয়ে অফিসে এসেছে। দুপুরে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায়। কথা জড়ায়ে গেছে। নয়ন আর আমি ধরাধরি করে মহাখালি একটা হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।
চিকিৎসার জন্য মানেজার স্যার দুই হাজার টাকা বেতন অগ্রিম দিয়েছে। ডাক্তার টেস্ট লিখে দিয়েছে। টেস্টগুলো করতে দিয়ে রুবেলকে ওর খালার বাসায় রেখে এসেছি।
রাত চারটার সময় হঠাৎ একটা কল আসে। রুবেলের খালা ধরা গলায় আমাকে যেতে বলে। এত রাতে মিরপুর থেকে বাসাবো যাওয়ার কোনো গাড়ি পাওয়া যাবে না।
সিএঞ্জিতে যাওয়ার মতো টাকা মানিব্যাগে নেই। মাথায় আসল, মাটির ব্যাংকের কথা। এক আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে টাকাগুলো দুই পকেটে ভরে নিয়ে দৌঁড় দিলাম। কাউকে জাগালাম না। দরজা খোলাই থাকল।
বাসা চিনতে কষ্ট হয়েছে। গেটের কাছে গিয়ে আবার ফিরে আসলাম। নিচে দাঁড়িয়ে কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কান্নার এ শব্দ আমার কাছে অপরিচিত নয়। মাকে দেখেছিলাম এভাবে একবার কাঁদতে।
অনেকক্ষণ নিচে দাঁড়িয়ে থাকলাম। রুবেলের নিষ্পাপ মুখখানি চোখের সামনে টানিয়ে নিয়ে ভূতের মত হাঁটতে থাকলাম আবার।
# গল্পটি ২০০৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হল-এ বসে লেখা।