সাধ করে কেউ বেশ্যা হয় না। শখের বেশ্যারা রাস্তায় থাকে না। তাদের আছে অন্য জীবন, সে যেমন জীবিকা তার চেয়ে সেখানে অধিক থাকে ভোগ-উপভোগ-আনন্দ।
সেরকম বেশ্যা হতে পারলে বিনামূল্যে সর্বোচ্চ সুখ মেলে। শখের সখিরা জানে এ জীবনে সতীত্বের চেয়ে বড় শাস্তি পৃথিবীতে আর নেই।
মাঠে ঘাঠে পথের ধারে বা বস্তিতে রাত দুপুরে যারা দেহের পসরা সাজায় তাদের বৈশ্যতায় সুখ নেই, জীবন বাঁচানোর দায়।
রাত বারোটা বাজলেই বিজয় দিবস। ডার্কহর্স হয়েও বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের এই দিনে জিতে গিয়েছিলো।
ক্যাম্পাসে হাঁটাহাঁটি করছি। বিজয় উদযাপনের জন্য নয়, যাদের জীবনের বিনিময়ে এ বিজয় তাদের জন্য চোখের পানি ফেলতেও নয়, একটি বিষয় ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই রুম থেকে বেরিয়ে পড়েছি।
কিছু প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো। আচ্ছা ৭১-এ পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার বিরোধিতা বেশি লোকে করেছিলো নাকি স্বাধীনতার পক্ষেই বেশি লোক ছিলো?
স্বাধীনতার পক্ষে যারা ছিলো তাদের মধ্যে অনেকে মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে, আবার অনেকে পাক বাহিনীর অতর্কিত বর্বর হামলায় জীবন দিয়েছিলো। কিন্তু বিরোধিতাকারীরা তো সবাই বেঁচে আছে!
সংখ্যা ত্রিশ লক্ষ হোক আর পয়ত্রিশ লক্ষ হোক— সেটি বড় কথা নয়, বড় কথা হলো মানুষ তার নিজের জীবনটা বিসর্জন দিয়েছিলো!
আবার নিজের কাছে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে। কী দিয়েছিলো? হ্যাঁ, নিজের জীবনটাই দিয়ে দিয়েছিলো। কার জন্য দিয়েছিলো? উত্তরে বলতে হচ্ছে, দিয়েছিলো সেই সব অবিবর্তিত জানোয়ারদের জন্য যারা সেদিন পাক বাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো নিজের মা-বোনদের কাছে! বলতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু এ দেশে এটি সত্য হয়েছে।
সেদিন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এক কোটি মানুষ হয়ত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। হয়ত স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন আরো এক কোটি মানুষ।
স্বাধীনতার বিরোধী পক্ষেও কম মানুষ ছিলো না। অনেকে স্বাধীনতা বোঝে না, তিনবেলা খাওয়া-দাওয়া আর রাতে যেমন তেমন একটা স্ত্রী বা পুরুষ — এই তাদের জীবন। তাই স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ’র বাইরেও একটা পক্ষ ছিলো— ‘কিছুতে কিছু যায় না আসা পক্ষ’ এবং এই পক্ষেই বোধহয় লোক সবচে’ বেশি ছিলো।
সত্য হলো— ৭১-এ পূর্ব পাকিস্তানে রাজাকার (প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাবিরোধী সবাই) এবং মুক্তিযোদ্ধা (স্বাধীনতার পক্ষের সবাই) ছিলো সমান সমান।
যুদ্ধে শুধু মুক্তিযোদ্ধারাই মারা গিয়েছিলো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরের পরিসংখ্যান হলো, বাংলাদেশে স্বাধীনতার পক্ষের লোকের চেয়ে বিপক্ষের লোক সংখ্যায় বেশি হয়ে গেলো।
মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার পক্ষশক্তি সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিলো। অন্যদিকে বিরোধীপক্ষ লুটপাট করে অনেক সম্পদ অর্জন করেছিলো।
স্বাধীন বাংলাদেশে রাজাকারেরা মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিলো। পরবর্তীতে আরো শক্তিশালী হয়েছে।
স্বাধীনতার পরে রাজনৈতিক ক্ষমতা স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি পায়। অপরদিকে বিরোধীরা সংখ্যায় যেমন বেশি, অর্থনৈতিক শক্তিও ছিলো তাদের বেশি। বোনাস হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছিলো সাধারণ ক্ষমা। আর কী চাই? শুরু করে দিলো ষড়যন্ত্র। সফলতা পেতেও সময় লাগেনি।
মাত্র চার বছরের মাথায় ঠিকই তারা দেশটা কেড়ে নিয়েছিলো। ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ যদি হয় বাংলাদেশের বিজয় দিবস, ১৫ আগষ্ট ’৭৫ বাংলাদেশের ‘পরাজয়’ দিবস।
বিজয়ের আনন্দ এবং স্বজন হারানোর বেদনার স্পন্দন থামতে না থামতেই আবার সব হারিয়ে গেলো। কোথায় বিচার-আচার-সভ্যতা-সৌন্দর্য? আবার সেই একই রূপে আবির্ভূত হলো স্বাধনিতার এবং মানব মুক্তির বিরোধীশক্তি।
এবার আর তলোয়ার উঁচিয়ে নামলো না, বুঝে শুনে ’৭১-এর সেই অপূর্ণ থলিটি পূর্ণ করার দিকেই তারা বেশি মনোযোগী হলো, সাথে অজ্ঞতা আর বর্বরতার যত রকমের যত চর্চা করা যায় সবই তারা করলো। এভাবে চলল ’৭৫-এর ১৫ আগষ্ট থেকে ’৯৬ পর্যন্ত।
পরের পাঁচ বছরের গল্পেও এমন কোনো রদবদল ছিলো না, ছিলো শুধু এতদিনে শয্যশিায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্পষ্ট আওয়াজ। কে শোনে তাদের ক্ষীণ কণ্ঠ?
সেদিন বঙ্গবন্ধুর চারপাশ ঘিরে ধরেছিলো চাটুকারের দল, এবার তার কন্যার চারপাশ ঘিরে রাখলো তারাই বা তাদেরই বংশধরেরা। ফলে যা হবার তাই-ই হলো। আবার ফিরে আসলো ঘাতকেরা।
২০০১ থেকে ২০০৬, —সে গল্প সবার জানা। বোমাবাজি আর লুটপাটোর গল্প। মাঝে দুই বছর গেলো দিধা-দ্বন্দ্বে। অবশেষে ২০০৯ থেকে নতুন গল্প। এতদিনে স্বাধীনতার পক্ষে জনবল কিছুটা বেড়েছে। অনেক রাজাকারের বংশধর বিবর্তনের পথ ধরে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে, হচ্ছে। অনেকে মুক্তিযোদ্ধা থেকে রাজাকারও হয়েছে।
নতুন প্রজম্মের কল্যাণে এখন মুক্তিপন্থীদের সংখ্যা রাজাকারদের চেয়ে হয়ত সামান্য বেশি। তবে অর্থনৈতিক শক্তিতে এখনো পিছিয়ে রয়েছে মুক্তিপন্থীরা।
ক্ষমতা মুক্তিপন্থীদের হাতে আছে, সংখ্যাধিক্য আছে, শুভবোধ আছে; এখন অর্থনৈতিক শক্তি অর্জিত হলেই হয়, স্বপ্নের সেই সোনার বাংলা আর বেশি দূরে থাকার কথা নয়। তবে হোঁচট খাওয়ার ভয় আছে বর্তমান সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপে।
ভাবছি এক কাপ চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে আবার রুমে ফিরে যাই। কী জানি কী ভেবে রুমের দিকে না ফিরে ছোট ছোট পায়ে বাংলা একাডেমির দিকে হাঁটতে থাকলাম।
দূর থেকে ভেসে আসা সুরের টানে পাল তোলা নৌকার মতো এগিয়ে যাচ্ছি। কোথা হতে যেন ভেসে আসছে— “মোরা একটা ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি” —এই গানগুলোকে বাংলার সব মানুষকে একটা ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয়।
আমি স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু এতটুকু বুঝতে পারি— স্বাধীনতার যুদ্ধ, মুক্তির যুদ্ধ কোনোদিন শেষ হয় না। মানুষের মুক্তির সংগ্রাম নিরন্তর।
টিএসসির ভেতর দিয়ে বের হয়ে রাস্তার ডান পাশের ফুটপথ ধরে হাঁটছি। ‘কামনা’ থাকলেও তা অভিজাত, শুধু কৌতূহলে ডানে বায়ে তাকাচ্ছি।
পরমাণু শক্তিকমিশনের সামনে পাঁচিল ঘেষে কী যেন একটা নড়ে উঠলো। ভূত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। হলেও অসুবিধা নেই, ভূতকে আমার ভীতিকর মনে হয়নি কোনোদিন।
হাতের ইশারা বুঝতে পেরে এগিয়ে গেলাম। আপদমস্তক দেখতে লাগলাম। অন্ধের হাতি দেখার মতো দেখছি। ভেতর থেকে বিকৃত ক্ষুধার পরিবর্তে দীর্ঘশ্বাঃস বেরিয়ে আসছে।
শীতের রাতে শরীরে যথেষ্ট কাপড় নেই। পণ্য দেখানোর প্রয়োজন নিশ্চয় রয়েছে, তাই বলে কাপড় থাকলে এত শীতে কেউ আলগা থাকে না।
প্রয়োজন ফুরাবে না, কিন্তু আয়োজন শেষ হবে। দু’এক মাসের মধ্যেই অস্থিচর্মসার একটা আবর্জনায় পরিণত হবে সে। তারপরে তারা কোথায় হারিয়ে যায় কেউ জানে না, জানতে নেই।
সে বিব্রত হচ্ছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক— এখানে তো দেখাশুনার কিছু নেই, দেনদরবারেরও প্রয়োজন নেই। বিনিময় শিরোধার্য কিছু নয়। খুশি হয়ে একটা কিছু দিলেই হয়। সৌরভ নেই, সৌষ্ঠব নেই; অযথা কালক্ষেপণ তো কেউ করে না। এক নিঃশ্বাসের গল্প, ফুরালেই শেষ।
ওরা সাধারণত তুই তোকারি করে, রেগে গেলে গালাগাল দেয়। এই মেয়েটা তো দেখছি একেবারে চুপচাপ। কিছুটা ভয় ভয় করছে।
রাতের টহল পুলিশ আছে, প্রক্টরিয়াল বডির নাইট ডিউটি আছে। ক্যাম্পাসে আশ্রিত অর্ধমৃত এসব মানুষদের তাড়িয়ে বেড়ানো হলো তাদের একমাত্র কাজ।
এতক্ষণে সে মুখ খুলেছে, “আপনি চলে যান।” আমি বললাম, আপনি এসব করেন কেন? এবার রেগে গিয়ে বললো, আপনাদের মতো ভদ্রলোকেরা এসব বুঝবে না। বলেই সে দুই তিন পা এগিয়ে গিয়ে পাঁচিল ঘেষে রাখা কিছু ধরতে গেলো।
আমিও বিদায় নেবার জন্য পিছন ফিরেছি। সামনে এগোতেই কান্নার শব্দ শুনে আবার ফিরলাম। কাপড়ে পুটলি করা কিছু একটা সে বুকে চেপে ধরেছে। এখন তো সে ‘মা’, তাই লজ্জা পাচ্ছে। ধরা গলা বলছে, ‘যান বলছি, ফিরে আসলেন কেন?’
আমি অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছি। পকেট হাতড়িয়ে দেখি সব মিলিয়ে ষাট-সত্তর টাকা আছে। সে নিতে চায় না। “আপনি তো কিছু করেন নাই, আপনি টাকা দ্যান ক্যান?” কিছু না করলে বুঝি টাকা দিতে নেই?
ডিসেম্বর ২০০৯, জগন্নাথ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়