ছোটগল্পঃ হানিমুন // দিব্যেন্দু দ্বীপ

follow-upnews
0 0

পালাতে হবে। পালানো ছাড়া আর কোনো উপায় সামনে দেখছি না। একটি যুতসই ব্যাগ দরকার যাতে দু’জনার অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো ঠিকঠাক এঁটে যায়। দু’জনেই আমরা এ বিষয়ে একমত— বেঁচে থাকাটাই এখন আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। গতকাল যারা আমাদের সাহায্য করেছে তাদের কাছে অবশ্যই আমরা কৃতজ্ঞ। বাঁচা মরার লড়াইয়ের এই উপলক্ষ কিছুতেই শুধু দু’জনে আমরা তৈরি করতে পারতাম না। এজন্য আমাদের শত্রু পক্ষকেও ধন্যবাদ জানানো উচিৎ।
তিনজন বন্ধুর উপস্থিতে বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছে এবং এতে বিয়েটা পুরোপুরি বৈধতা পেয়েছে। আইনটাও বেশ লাগসই, তাই থানা পুলিশ নিয়ে আমাদের খুব বেশি চিন্তা করতে হচ্ছে না; তাছাড়া ওর পিতা আর যাই করুক থানা পুলিশ করতে যাবে না।
একটি ব্যাগের মধ্যে যা যা নেওয়া যায় নিয়েছি, এবং এমন কিছু জিনিসও আমরা নিয়েছি যা প্রয়োজনীয় ভাবতে গেলে আপনাকে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থাটা একবার জেনে নিতে হবে। আমরা যে হানিমুনে যাচ্ছি না একথা আপনারা এতক্ষণে জেনে গিয়েছেন, অবশ্য ব্যাপারটা মাঝে মাঝে সেরকমই হয়ে যাচ্ছে বলে রাখা ভালো। আমরা বিয়ে করেছি মাত্র একদিন হলো, এবং একথাও সত্য যে, গতরাতে আমরা একসাথে ছিলাম। অবশ্য যদি হিন্দু সংস্কৃতির কথা বলেন, তাহলে বিয়ের পরের রাত্রে একসাথে থাকাটা অবশ্যই রীতিসিদ্ধ হয়নি।
এক্ষেত্রে কিছু করারও নেই, কারণ আমরা যাই করি না কেন তা অর্ধেক রীতিবিরুদ্ধ হবে। আমাদের কেউ গ্রহণ করবে না জানতাম, কিন্তু তাই বলে চোর ধাওয়া করার মতো ধাওয়া করবে এমনটি কল্পনা করতে আমাদের কষ্ট হয়েছিলো।
ইতিমধ্যে আমার স্ত্রী ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছে। গতরাতে কেনা মুড়িগুলো সে যে যত্ন করে ব্যাগের এককোণায় ঢুঁকিয়ে দিয়েছে, আমি আড় চোখে তা দেখে নিয়েছি। ‘ওটা নিতে হবে না’ বলে বউকে একটু ধমকিয়ে নেওয়ার চেয়ে বরং মনে হয়েছে আগামীকালই হয়ত ঐ মুড়িগুলো বিশেষ কাজে আসবে। বউকে বুদ্ধিমতী ভাবতে সবারই ভালো লাগার কথা, আমি সুযোগে একটু ভেবে নিলাম। প্লেট দু’খানা নেবারও যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে। ব্যাগের আকৃতি একটু ভাবাচ্ছে বৈকি, তবে এই মুহূর্ত ওটা দশ নম্বর ভাবনার বিষয়ও হতে পারে না।
গতকাল বিয়ে করে ফেরার পথে টুকিটাকি কিছু জিনিস কিনেছিলাম, আমরা একসঙ্গে থাকার ব্যাপারে খুব বেশি দুশ্চিন্তা তখনও করিনি। গত রাতটা কাটিয়েছি একটা বাসার বারান্দায়, দয়া করে বারান্দাটা একমাসের জন্য ওনারা আমাদের ভাড়া দিয়েছিলেন। বন্দোবস্ত বেশ ভালোই মনে হয়েছিলো। আজকে রাতে আর এখানে থাকব না— বিষয়টি মেনে নিতে খুব কষ্ট হত যদি ঐ বারান্দার পাশে ভোরবেলায় কল চাপার ঘ্যারর ঘ্যারর শব্দ না হত।
টাকাগুলো দু’জনে একসঙ্গে বসে গুণে নেওয়াটা জরুরী। সর্বসাকুল্যে দু’হাজার নয়শো ত্রিশ টাকা আছে। এখন একশো টাকা বাড়িভাড়া দেওয়া মানে আমাদের বাঁচার সম্ভাবনা কমছেকম এক শতাংশ কমিয়ে ফেলা। গতকালকের কেনা কিছু জিনিস অবশ্য থেকে যাচ্ছে। কিছু করার নেই, বরং একশো টাকা দেবার পরও ওনার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। বউকে দেখে আবার ভালো লাগলো, কারণ, সে আমাদের একদিনের বাড়িআলিকে একটুও মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি— অন্তত তিনশো টাকার জিনিসপত্র আমরা রেখে যাচ্ছি যে বিষয়ে এখনকার উদাসিনতা মাত্র কিছুক্ষণ পরেই হয়ত ওনার আর থাকবে না।
আমরা রওনা দিয়েছি। সায়দাবাদ থেকে বাস ধরবো, ওটিই সবচে’ সস্তা স্টেশন। টাকাগুলো দু’জনের কাছে ভাগ করে রেখেছি। আমার স্ত্রী এক হাজার টাকা হাতে পেয়ে অহেতুক সম্মানিত হওয়ার চেয়ে এর মর্মাথ বুঝতেই বেশি তৎপর, এবং টাকাটা কয়টি সহজাত দক্ষতায় গোপনে রেখে দিয়েছে।
রিকশায় চড়াটা বোকামি হবে জেনেও নাজিরবাজার থেকে চল্লিশ টাকা ভাড়ায় রিকশায় উঠলাম। ও আমাকে ধরে বসলো, স্পন্দন বলে দিচ্ছে এটা সে করছে ভয়ে নয়, ভালোবাসার ছোঁয়া বিড়ালেও বুঝতে পারে। আসলে ওর স্নায়ুর জোর আমার চেয়ে যে অনেক বেশি তা আমি গতকালকেই বুঝতে পেরেছি, সত্য বলতে কি হৃদয়ের জোরটাও ওর বেশি। নারী যখন দেয় উজাড় করে দেয়, নিতেও চায় সে সেরকম করে।
– মুক্তা, তুমি কি কিছু ভাবছো?
– কিছু না ভাবার মতো অবস্থায় নিশ্চয় এখন আমরা নেই।
– প্রশ্নটা এর থেকে সুন্দরভাবে করতে না পারার জন্য আমি দুঃখিত।
– আমি বরং খানিকটা সুখ অনুভব করছি। নিশ্চয় তুমি আমার অনুভূতির কথা শুনে হতাশ হলে।
– না, ঠিক তা নয়, তবে তোমার অনুভূতির সন্মানার্থে একটু বিস্মিত হতে হচ্ছে। শোনো, আমি কিন্তু ভাবছি এটাই আমাদের
সবচে’ রোমাঞ্চকর হানিমুন।
– এটা তোমার টাকা বাঁচানোর ফন্দি।
– টাকা না থাকলেও বাঁচানো যায়! একথা জেনে আমাকে আনন্দিত হতে হবে, কারণ, ঐ বাঁচানো টাকা দিয়ে আর না হোক একবেলা ভালো খাওয়া যাবে। আমাদের দু’জনরাই পুষ্টির যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
– তারপরেও আমাদের প্রাণশক্তির কোনো অভাব নেই।
– এই মুহূর্তে ফোনটা ধরলে তুমি বোধহয় বিরক্ত হবে।
– উৎসব, একথা জেনেই আমি তোমাকে বিয়ে করেছি যে, তোমার মধ্যে খানিকটা লুকোচুরি থাকা অসম্ভব নয়। ফোনটা কে করেছে?
– শশুরবাড়ির লোকজন ভেবেছিলাম, এখন দেখছি শশুর হতে পারতো এমন কারো মেয়ে ফোন করেছে।
– আমার কোনো হবু সতিনের ফোন এখন না ধরাই ভালো, তাতে আমাদের মুড নষ্ট হতে পারে।
– কালকে থেকে তোমাকে বোকা ভাবার চেষ্টা করছি, এবারও তুমি সে সুযোগ দিলে না।
– বিষয়টা আমি উপভোগ করছি ভাবলে তুমি ভুল করবে।
বাস ছাড়তে আরো এক ঘন্টা বাকি, আমরা কি কিছু খেয়ে নেব? প্রশ্ন করতেই মুক্তা বিরক্তির ভাব গোপন করলো না। এখন খাব না, সারারাত্রেও কিছু খাওয়া হবে না। মাত্র আঠারোশো নব্বই টাকা অবশিষ্ট আছে। তোমার কাছে আছে আটশো নব্বই টাকা। ওখানে গিয়ে কী হবে ঠিক নেই, আমাদের উচিৎ টাকা বাঁচিয়ে চলা। ক্ষুধা লাগলে আমরা খাবো না, খেতে হবে যাতে ক্ষুধায় আমরা মারা না যাই সে জন্য। ওর কথা মেনে নিয়ে টাকা কয়টা স্বভাববিরুদ্ধভাবে সাবধানে রেখে দিলাম।
বাস ছাড়ার পর প্রায় এক ঘণ্টা আমরা কোনো কথা বলিনি। তারপরে দু’জনে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে একে অপরকে খ্যাপানোর চেষ্টা করে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়েছি। আমি ঘুম থেকে উঠে ওকে ঘুম দেখলেই বেশি খুশি হতাম, জেগে দেখি ও ওর আস্তো পটলের মতো দু’টো চোখ নিমিষে আমার দিকে তাক করেছে। বিরাট কোনো আবিষ্কার করে ফেলেছে এমন ভাব করে ও বলল, “আমি প্রায় এক ঘণ্টা ধরে তোমাকে দেখছি, এবং আবিষ্কার করেছি ঘুম অবস্থায় তোমাকে একটা ভেড়ার বাচ্চার মতো দেখায়।”
মুক্তা, বিষয়টি কিন্তু আমার কাছে খুব উপভোগ্য হচ্ছে না। কনুই দিয়ে একটু খোঁচা দিয়ে বললাম, বুঝতে পারছি ঘুমন্ত ভেড়ার বাচ্চা দেখার অভ্যাস তোমার বেশ পুরনো, তাই বলে আমাকে ও দলে টেনো না।
একটি দামি হোটেলের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ওরা যাত্রীদের অবকাশের সুযোগ দেয়। আমরা গাড়ি থেকে নেমেছি কিছু খাব না শর্তে। গাড়িতে ওঠার পূর্বে আমরা ফোন বন্ধ রেখেছিলাম, নইলে আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের বিপদে ফেলতে পারতো। আমার মামা শশুর, অর্থাৎ আমার স্ত্রীর মামাকে বাসার ঠিকানা বলে এসেছি ‘আজিমপুর সাফরা মসজিদের পাশে’। এতক্ষণে নিশ্চিত তিনি আমার শ্যালকদের পাঠিয়ে বাসা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। মোবাইল বন্ধ পেয়ে সন্দেহ ঘনীভূত হবে, তবে একথা ভাবা তাদের জন্য দুঃসাধ্য হবে— এমতাবস্থায় পালানোর জায়গা হিসেবে আমরা বেছে নিয়েছি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত।
নব দম্পতির মধ্যে দুশ্চিন্তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। দ্রুতই আমরা আবোল তাবোল গল্পে মনোযোগী হলাম। পাশে স্ত্রী না হয়ে বান্ধবী থাকলে এতক্ষণে একশোবার চুমো খাওয়ার জন্য ঢোঁক গিলতাম, অথচ স্ত্রী বলেই কিনা সুযোগ কজে লাগানোর কথা একবারও মাথায় আসেনি। শেষপর্যন্ত যা হবার তাই হয়েছে। ও আমার দুই গালে চুট চুট করে দুটো চুমো খেয়েছে। এটি অবশ্যই খুব সংকীর্ণ ধারণা— পুরুষ বলে আমাকেই আগে চুমো খেতে হবে। হিসেবনিকেশ করে আমি আবার গাল পেতে দিলাম। এবার চুমু না দিয়ে ও একটা চড় বসিয়ে দিলো। চড়টা খুব মিষ্টি লেগেছে, তাই বলে চড় যে খুব আস্তে দিয়েছে তা কিন্তু নয়। কিছুক্ষণ দুষ্টুমি এবং দুশ্চিন্তা একইসাথে করে মানসিক এবং শারীরিক ক্লান্তিতে আবার আমরা ঘুমিয়ে পড়েছি।
ঘুম থেকে জেগে দেখি সমুদ্র সৈকত হতে আমরা আর মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে। এখন আমাদের একমাত্র গন্তব্য সমুদ্র সৈকত। যেহেতু হোটেলে থাকার মতো যথেষ্ট টাকা হাতে নেই, আয়েস এবং অলসতার কোনো সুযোগ আমাদের সামনে নেই। দশটার দিকে রাসেল এসে আমাদের নিয়ে যাবে। শিক্ষা সফরে কক্সবাজার এসে রাসেলের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। ও এখানে স্থানীয়, মাছের ব্যবসা করে। মাঝে মাঝে আমাকে ফোন দিত, এমনও হয়েছে ও দশবার ফোন দিয়েছে, কিন্তু আমি ফোন রিসিভ করার প্রয়োজন বোধ করিনি। নিয়তীর এমনই রূপ সেই রাসেলই আজকে আমার একমাত্র ভরসা। বয়সে আমার চেয়ে দশ-বারো বছরের ছোট হবে ও। বয়সের ব্যবধান বেশি হওয়াতে সুবিধা হয়েছে— কোনো বিষয়ে খুব বেশি খোঁজ নিতে চাইবে না। আমাদের বর্তমান দীনতার কথা ও জানে না। সত্য হল— আজকে থেকে আমরা ওর উপরেই পুরোপুরি নির্ভরশীল যা ওকে কেনোভাবেই বুঝতে দেওয়া যাবে না। ওকে বলা হয়েছে, আমরা একটা গবেষণার কাজে এসেছি। উপকূলের মানুষ এবং তাদের জীবনযাপন নিয়ে গবেষণা। আমরা এখানে একমাস থাকবো, এবং গবেষণাটাকে জীবন্ত করার জন্য উপকূলের মানুষের সাথে কাজ করে আমরা জীবিকানির্বাহ করবো।
রাসেল প্রথমে খুব আপত্তি করে। ওদের সাথে মাছ ধরা, মাছ শুকানোর মতো সকল কাজ আমরা করবো, ব্যপারটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। বুঝিয়ে বলার পরে রাজি হয়েছে। যেহেতু আমি পড়াশুনা জানি, তাই হিসেবনিকেশের একটা কাজ ওরা আমাকে দিতে চেয়েছে। আমি রাজি হইনি। বেতন ঠিক করে কাজ নিলে সুসম্পর্ক বজায় রাখা কঠিন হবে। আমি ওদের বললাম, আমরা গবেষণার জন্য এসেছি, তাই ধরাবাধা কাজ করা যাবে না, যখন যে কাজ সামনে আসবে করবো। টাকাপয়সা বিশেষ কিছু লাগবে না। সামান্য হাতখরচ, আর দু’জনের খেতে যা লাগে। আমরা চাচ্ছি— কাজটা সততার সাথে করতে। আমাদের শিক্ষককে কথা দিয়ে এসেছি— গবেষণার কাজটা আমরা এখান থেকে জীবিকানির্বাহ করেই করবো। এজন্য আমরা আসার সময় শুধুমাত্র পথখরচটা নিয়ে এসেছি।
আমরা দু’জনেই দেখতে যথেষ্ট সুন্দর এবং পোশাক পরিচ্ছদও পরিপাটি। যতটুকু বিশ্বাস করাতে চেয়েছি আমাদের কথা ওরা তার চেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছে। যতদূর পারা যায় এখানে আমরা ওদের মতো আচরণ করার চেষ্টা করবো। এখন থেকে পোশাক পরিচ্ছদও যথাসম্ভব এলামেলো এবং অপরিচ্ছন্ন করে ব্যবহার করতে হবে, তবে তার আগে রাসেলের মাধ্যমে প্রচার হওয়া প্রয়োজন যে, আমরা অনেক বড় মানুষ, নইলে আমাদের সাধারণীকরণ কোনো কাজে আসবে না। মানুষ উপরের স্তর হতে নীচের স্তরে নেমে আসা দেখতে পছন্দ করে, নীচু তলার মানুষকে এই সুযোগটি দিলে কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। এটা ওদের সাথে একধরনের ধোকাবাজি যদিও।
ঘরটা আমাদের দু’জনেরই পছন্দ হয়েছে। মূলি বাঁশের বেড়া, উপরে টিন, পাশে ছোট্ট একটা রান্নাঘরও আছে। মাত্র দু’শো টাকা ঘর ভাড়া। এদের সাথে মিশে যেতে পারলে কোনকিছুরই যে অভাব হবে না মুক্তা এটা বুঝতে সময় নিয়েছে মাত্র এক ঘন্টা। আমাকে অবাক করে দিয়ে ও দুপুরের রান্নার আয়োজনও করে ফেলেছে। তাদেরকে বুঝাতে সমর্থ হয়েছে— গবেষণার প্রয়োজনে আমাদের নিজেদেরই রান্না করে খেতে হবে। এখানে আমাদের প্রতিবেশী এবং যারা এখন আমাদের বিস্ময় এবং ভালোবাসার চোখে দেখতে বাধ্য তাদের আতিথেয়তা যাতে আমাদের জন্য বিরক্তির কারণ না হয়, সেজন্য শুরুতেই ও এই গ্রাম্য এবং ঘনিষ্ঠ মানুষগুলোর সাথে আন্তরিক বোঝাপড়া করে নিয়েছে। হাড়ি-পাতিল, লাকড়ি মুহূর্তে সব মিলে গিয়েছে। চাল, মাছ-তরকারিও হাজির। কমপক্ষে সাত দিনের বাজার উপস্থিত। রাসেল এগুলো নিয়ে এসেছে। টাকার কথা কিছু বলতে আমার সাহস হলো না। ওকে ধন্যবাদ দিলাম এবং এই কাজটিই যে এই মুহূর্তে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ ছিলো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ওকে তা বুঝিয়েও দিলাম। একজন শিক্ষিত ভদ্রলোকের প্রশংসায় ও বিগলিত হলো, একইসাথে ওর মাধ্যমে আরো অনেক সুবিধা পাওয়ার পথও প্রশস্ত হলো। সদ্য যৌবনে পা দেওয়া ছেলেটা নববিবাহিত সুন্দরী রমনীর সামনে প্রশংসিত হয়ে একটু বেশিই যেন খুশি হয়েছে। লজ্জ্বাও পেয়েছে।
পরিকল্পনাটা এত সুন্দরভাবে কাজে লাগবে খুব বেশি বোকা না হলে আগে থেকে তা বোঝা সম্ভব ছিলো না। দু’জনার কেউ-ই যেহেতু পুরোপুরি বোকা আমরা নই, তাই যা যা ঘটছে সেসব কিছুর জন্য হাসি, আনন্দ এবং চাপাপড়া দুঃখবোধ আমাদের ছেড়ে যাবে না যতক্ষণ না এখানে আমাদের প্রকৃত জীবন সংগ্রাম শুরু হয়।
দুপুরে নিকট প্রতিবেশী ছেলেদের নিয়ে আমি একটা টয়লেট তৈরির বন্দোবস্ত করে ফেললাম। টয়লেট তৈরির জন্য বাঁশ, কাঠ এবং মজুরি বাবদ তিনশো টাকা বরাদ্দ হয়েছে। ব্যয় আমাদের আশু উপার্জন হতে নির্বাহ করা হবে। আপাতত মুক্তা টাকাটা দিয়ে আমাদের সাহায্য করতে পারে। ও বিনা বাক্য ব্যয়ে দানবীরের মতো তিনশো টাকা আমাদের দিয়ে দিলো। আমি কাজে বাইরে গেলে এখানে ওকে একা থাকতে হবে, তাই আমার চেয়ে ওকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলাটা অধিক জরুরী। অবশ্য বেশিরভাগ সময় আমরা একসাথে বাইরে যাবো, আমরা যেহেতু ‘গবেষণার কাজে এসেছি’ তাই খেয়ে না খেয়ে দু’জনে একসাথে ঘুরে বেড়ালেও বিষয়টাকে কেউ মন্দভাবে নেবে না।
রাতে ওদের কিছু হিসেবনিকেশের কজে করে দিচ্ছি। মাছধরা সংক্রান্ত অন্য কোনো কাজ আমরা করতে গেলে তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভবনা আছে। রাতে দুইঘন্টা হিসেব করে যদি একশো টাকা এবং রোজ সকালে একগাদা সুস্বাদু তাজা মাছ পাওয়া যায় তাহলে এমন চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা এমতাবস্থায় আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনে।
প্রথমে কাজটি করতে আপত্তি করেছিলাম না বুঝে। আমরা যে এখানে প্রাণ বাঁচাতে এসেছি— ব্যাপারটা গত তিনদিনে একেবারেই ভুলে গিয়েছি। সত্যি বলতে কী— পিছনের ওসব হুমকি-ধুমকি ভোলার জন্য রাতে ফুলকপি দিয়ে টাটকা পোয়া মাছের ঝোলটাই যথেষ্ট। বিকালে বউয়ের হাত ধরে ইনানী বা পতেঙ্গা কোনোখানে ঘুরতেই আমার অসুবিধা হচ্ছে না। মুড়ি-মুড়কি খাওয়ার টাকা যে একেবারে নেই তাওতো নয়, অর্থাৎ ফেরারী হয়েও আমরা হানিমুনর মেজাজেই আছি। অবশ্য মুক্তা আমাদের এ সফরের নাম দিয়েছে ফানিমুন।
আর চারদিন পরে পূর্ণিমা। রহমত চাচাকে আমি এবং রাসেল অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়েছি। প্রথমে মুক্তাকে নিতে রাজি হয়নি, পরে রাজি হয়েছে— গবেষণাটা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং কাজটার জন্য ওরই প্রধানত যাওয়া প্রয়োজন, একথা গভীরভাবে উপলব্ধি করার পরে। এখন দু’জনেই আমরা অপেক্ষা করছি পূর্ণিমার রাতে গীভর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য।


ফেব্রুয়ারি ২০০৭, নিমতলী, ঢাকা

Next Post

ছোটগল্পঃ বিনিময় // দিব্যেন্দু দ্বীপ

সাধ করে কেউ বেশ্যা হয় না। শখের বেশ্যারা রাস্তায় থাকে না। তাদের আছে অন্য জীবন, সে যেমন জীবিকা তার চেয়ে সেখানে অধিক থাকে ভোগ-উপভোগ-আনন্দ। সেরকম বেশ্যা হতে পারলে বিনামূল্যে সর্বোচ্চ সুখ মেলে। শখের সখিরা জানে এ জীবনে সতীত্বের চেয়ে বড় শাস্তি পৃথিবীতে আর নেই। মাঠে ঘাঠে পথের ধারে বা বস্তিতে […]