ছোটগল্প: অসমাপ্ত // দিব্যেন্দু দ্বীপ

ছোটগল্প: অসমাপ্ত

“তুমি কি আমার সাথে একবার সেক্স করবে, নাকি আমার কাছ থেকে দশ লক্ষ টাকা নেবে?” উত্তরটা প্লাবন মুহূর্তের মধ্যে দিতে পারত, তবু একটু সময় নিয়ে বলল, অবশ্যই আপনার সাথে একবার সেক্স করতে চাই। আচ্ছা, আমরা তাহলে কোথায় যেতে পারি, খুব নিরুব্দেগ হয়ে প্রশ্নটা করে মারুফা? আমার তিনদিন ছুটি আছে, অসুস্থতার কথা বলে রাখব, যাতে ছুটিতে কোনো কাজে অফিশ আমাকে তলব না করে। তুমি তো জানো আমাদের চাকরিতে ছুটি বলে কিছু নেই। প্রশাসনিক চাকরিতে চব্বিশ ঘণ্টাই ডিউটিরত আমরা। আমাদের পিছনে গোয়েন্দা লাগানো থাকে, ফলে খুব গোপনে কোথাও যেতে হবে। যদিও বিষয়টা হয়ত কোনো না কোনোভাবে লিক হয়ে যাবে। তারপরও ঝুঁকিটা আমি নিচ্ছি, তোমার জন্য নিচ্ছি।

প্লাবন কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না, শুধু ঘন ঘন ছাদের দিকে তাকাচ্ছে। মারুফার চোখে চোখ রাখতে ভয় পাচ্ছে। আচ্ছা, আপনার খুব সমস্যা হলে না হয় থাক। তার মানে তুমি টাকা চাচ্ছ? মারুফা প্লাবনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দেয়। ঠিক আছে চলেন! প্লাবন একেবারেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। এক দিনের জন্য আমরা কুয়াকাটা যাবো। তুমি রেন্ট-এ-কার থেকে একটা গাড়ি নাও। গাড়িটা কালো গ্লাসের যেন হয়। যেহেতু শীতকাল, এটা একটা সুবিধা, আমি চাদর মাথায় দিয়ে বসতে পারব। পাশের জেলা পর্যন্ত এখানকার গাড়িতে যাব। পাশের জেলা থেকে নতুন গাড়ি নিয়ে কুয়াকাটা যাব। তুমি ফোন করে হোটেলে রুম বুক করো।

প্লাবন সব ঠিক করতে লেগে যায়। রাত আটটায় ওরা রওনা হবে, যাতে যথাসম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে চলা যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী মারুফা ঝালকাঠী থেকে একটা গাড়ীতে বরিশাল পৌঁছে যায়, প্লাবন আগেই বরিশাল পৌঁছে আরেকটা গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করছিল। বরিশাল থেকে ওরা একই গাড়ীতে ওঠে।

আমাদের জীবনটা বুঝেছো? তোমরা যেভাবে ভাবো, ঠিক সেরকম নয়, হাজারো চোখ আমাদের দিকে তাক করা থাকে। পানের থেকে চুন খসলেই বিপদ। আচ্ছা, বাদ দাও। বলো তোমার স্বপ্ন পূরণ হলো কিনা? প্লাবন কী জবাব দেবে বুঝতে পারছে না, কারণ, স্বপ্ন পূরণ তো আসলে হয়নি, স্বপ্ন পূরণ কি কখনো হয়? স্বপ্ন বরং কেবল পাখা মেলেছে। মারুফা উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে মোবাইলে হেড ফোন লাগিয়ে গান শুনতে থাকে, যেন সাথে কেউ নেই। বিষয়টা এরকম— সে অফিশের সহকারীকে নিয়ে কোনো বিশেষ প্রোগ্রামের শপিং করতে চলেছে। শপিং করেই আবার চলে আসবে, সহকারীর সাথে কথা বলার তো কিছু নেই। প্লাবন একটু বিব্রত বোধ করে। একটু কিছু রোমান্টিক কথা বলার জন্য বিভিন্নভাবে সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করছে, কিন্তু পেরে উঠছে না। অবশেষে কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে মেসেঞ্জারে একটি কবিতা লিখে পাঠায়—

অর্ধযুগ পরে আজ তোমার কৃপা হলো ঈশ্বর,

একটি দিন স্বর্গ পেলো, জানি এ জীবন নশ্বর।

তবু এখনো সেই পাথরের মূর্তি হয়ে

বসে আছো তুমি ছবির মতো পাশে,

দ্বিধাগ্রস্থ আমি অপেক্ষারত তোমার অনুগ্রহের আশে।

মারুফা মৃদু এবং দীর্ঘস্থায়ী একটা হাসি দিয়ে প্লাবনের দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয়। ডাক্তার যেভাবে শান্ত স্পর্শে রোগীর নাড়ির স্পন্দন দেখে, প্লাবনও সেভাবে মারুফার হাতটা মুঠোয় পুরে নেয়। এ যেন হিমালয় বিজয়! হৃদস্পন্দনের বেগ একশো ছাড়িয়েছে নিশ্চিত। মারুফা তাকিয়েই ছিল, প্লাবন কয়েকবার ঢোক গিলে ঘাড় ঘুরিয়ে মারুফার দিকে তাকাতেই দু’জোড়া চোখ অপলক তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। দু’জনেরই খুব ঘোর লেগেছে। প্লাবন ধীরে ধীরে আবার একটি কবিতা আওড়ায়—

দীর্ঘ এ জীবনে

সাগর সঙ্গমে কেটেছে কত বেলা,

কিন্তু আমি ছিলাম ভীষণ একেলা;

তুমি নও কেউ,

তবু একদিনের বাজিতে  

হৃদয়ে লেগেছে এক জীবনের ঢেউ।

“তুমি কি আমাকে একটা চুমু খাবে” মারুফা ফিসফিসিয়ে প্লাবনকে বলল। বলে একটু লজ্জ্বাও পেল যেন। না, একটু চুমু খাওয়া হলে গেলে আপনি হয়ত বলবেন, কোটা শেষ। তার চেয়ে হাতে রাখি। এবার প্লাবন নিজেই মারুফার হাতটা টেনে নেয়। হাতের পিঠে হাত রাখলেও এতটা শিহরণ জাগে! মারুফার বড় বড় চোখ দু’টো টলমল করছে— প্রেমে, কাল্পনিক পরিপূর্ণতায়।

গাড়ি হোটেলে পৌঁছে গিয়েছে। বাইরে এখনো শীত আছে, মারুফা চাদরটা সামনে একটু বেশি টেনে দিয়ে মাথা ঢেকে নেয়। প্লাবন দ্রুত হোটেলের নিয়ম কানুন সেরে নেয়। স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে তাদের হোটেলে উঠতে হচ্ছে। হঠাৎ মারুফা বলে বসে, আমার জন্য আলাদা রুম নাও, এক রুমে থাকব না। প্লাবন কাছে এসে বলে, স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে হোটেলে উঠছি, আলাদা রুম নিলে ওরা কী ভাববে? যা ভাবে ভাবুক, তুমি না হয় বলো, আমাদের আরেকজন গেস্ট আসবে, তার জন্য একটা রুম লাগবে। আমরা পে করছি, তারা এতকিছু ভাববে না। যথাজ্ঞা। প্লাবন পাশাপাশি দু’টো রুম বুকিং করে— ৩০৭ এবং ৩০৮।  

উপরে উঠে ওরা যে যার রুমে চলে যায়। প্লাবন খুব দ্রুত ফ্রেস হয়ে নিয়েছে। রুমের সাথে প্রশ্বস্ত বেলকনি রয়েছে। পাশাপাশি দুই রুমের ব্যালকনিতে দু’জনে বসলে ঠিক পাশাপাশি বসার মতোই হয়। প্লাবন নিচে গিয়ে ফ্লাক্সে দু’টো কফি, মগ এবং কিছু স্ন্যাকস্ দিয়ে যেতে বলেছে। টি-টেবিলটা টেনে ব্যালকনিতে নিয়ে স্ন্যাকস্ এবং কফি টেবিলে রেখে চেয়ার পেতে বসেছে। অপেক্ষা করছে মারুফা কখন ব্যালকনিতে আসবে। অপেক্ষার অবসান হয়েছে। চোখের বালির বিনোদিনীর মতো ব্লাউজ ছাড়া শাড়ী পেঁচিয়ে ব্যালকনিতে কাপড় নাড়তে এসেছে মারুফা। প্লাবন না দেখার ভাণ করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। সেও তড়িঘড়ি করে কাপড়টা নেড়ে দিয়ে ভেতরে চলে যায়। তাতে কী! আড় চোখে শ্যামলা বর্ণের, আকর্ষণীয়ভাবে একটু স্থুল, ভিজা চুলের, এই মুহূর্তে লাজুক দেবীকে ঠিকই প্লাবন দেখে নিয়েছে।

কয়েক মিনিট না যেতেই দরজায় ঠকঠক শব্দ। প্লাবন দরজা খুলেই দেখে মারুফা দাঁড়িয়ে। কোনো রকম সাজগোজ ছাড়াই ভিজা চুলে অনিন্দ্য সুন্দর লাগছে ওকে। মৃদু হাসিটা যেন ডাগর চোখ দুটিতেও ছড়িয়ে পড়েছে। আকাশ পাতাল এক করে প্লাবন মারুফার সদ্য গোসলের গন্ধ মাখা শরীরটা জড়িয়ে ধরে অধরে দীর্ঘ একটা চুমু বসিয়ে দেয়। মারুফাও নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় না, সমুদ্রের গর্জন ভেসে বেড়ায় নব-প্লাবিত শরীরের প্রতিটি কোণে কোণে। অবশেষে তারা একে অপরকে ছাড়িয়ে নেয় পূজা পর্বের পূর্বে আরও সুরের নেশায়।

বেলকনিতে মুখোমুখি বসে দু’জনে কফিতে চুমুক দিতে দিতে আহত ডাহুক পাখির মতো একে অপরকে দেখতে থাকে। মারুফা স্বেচ্ছায় অপহৃত, ফলে কোনো অভিযোগ নেই। প্লাবনেরও কোনো তাড়াহুড়া নেই, একে অপরের সব আবদার যেন জমছে সঞ্চয় হয়ে অলিখিত কোনো খাতায়। প্লাবন, তোমাকে একটা কথা বলব? বলেন। সত্যি কথা কি জানো— তোমার চুমুর চেয়ে আমার জন্য তোমার কবিতার শক্তি অনেক বেশি। একটা কবিতা বলো। প্লাবন বিড়বিড় করে—

রাক্ষুসে নেশা লুকিয়ে রেখে

কাব্যকথা,

শুধু কবিই জানে

তার বুকে বাজে কত ব্যথা!

তোমারও কি এমন?

প্রিয়, প্লাবিত হও

দেখে নাও তোমার জন্য

সত্যিই আমি কেমন।

প্লাবন, এখন কি সমুদ্র সৈকতে যাওয়া যেতে পারে? চলেন যাই। মারুফা ঘোমটা দেওয়ার মতো করে চাদরটা মাথায় জড়িয়ে নেয়। মারুফা বড় অফিসার, ফলে কেউ দেখে চিনে ফেললে বড় বিপদ। খুব সতর্কভাবে চলতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে সৈকতে ভীড় নেই। দূর সমুদ্র হতে শো শো শব্দ ভেসে আসছে। অল্প আলোয় কাছে দূরে দু’একজন মানুষ চোখে পড়ছে। মারুফার কিছুটা ভয় ভয় লাগছে। ভয়কে জয় করে কোনো কথা না বলে সৈকতে একটি খাটিয়ায় গা এলিয়ে দেয় সে। চোখ বুঝে থাকে। পাশে প্লাবন দাঁড়িয়ে। বুঝতে পারছে না ও কী করবে। দুরু দুরু বুকে প্লাবন ধীরে ধীরে বলে, আমার ইচ্ছে করছে আপনার পাশে শুয়ে পড়তে। মারুফা কোনো কথা না বলে একটু পাশ ফিরে শুয়ে জায়গা করে দেয়। প্লাবনও কোনো কথা না বলে শুয়ে পড়ে। সমুদ্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে ঠিক পায়ের কাছে। ব্যবধান ঘুচে যায় প্রকৃতির আচ্ছাদনে। আচ্ছন্ন দু’জনে মুখোমুখি হয়— দোঁহের হৃদয় দোঁহে পান করে, যেন এক সমুদ্র অমৃতসুধা সঞ্চিত ছিল প্রিয়ার সুপ্ত পয়োধরে। সম্বিত ফিরে মারুফা আঁচল ঠিক করে নেয়। প্লাবন, শোনো, তোমার কবিতাই শুধু ভালো, তুমি নও। একটা কবিতা বলে এই পর্ব শেষ করো। প্লাবন, পুলকিত সমুদ্রের মতো তরঙ্গায়িত হয়ে বলে যায়—

তোমার নবযৌবনে আমার নতুন জীবন,

জ্যোস্নাশোভিত রাত, সমুদ্র সৈকত,

পাড়ভাঙ্গা ঢেউয়ের পুন:পুন গর্জন,

অভ্রান্ত পথিক আমি মেনে নিয়েছি

তোমাতে পরাজয়,

তোমার নিকশিত তবু নিত্য

পদ্মরাগে সুবিশাল এ প্রকৃতি ছাপিয়ে

অবিশ্রান্ত এক পরিব্রাজকের গোপন আশ্রয়।

শেষ নয়, প্রিয়, এ যেন কিছুতেই শেষ না হয়।

মারুফা কোনো কথা না বলে উঠে একটু হেলেদুলে হাঁটতে থাকে। প্রকৃতি এবং প্রেমিকের যুগল মাদকতায় তার শরীর মন ভরে উঠেছে কাণায় কাণায়, তবু নারী কোনো কথা না কয়! হাঁটতে হাঁটতে সৈকতের কোল ঘেষে একটা টং চায়ের দোকানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। প্লাবন তাকে শুধু অনুসরণ করতে থাকে। প্লাবন, একটা সিগারেট ধরিয়ে আনো, আমি খাব। আপনি কি কখনো সিগারেট খেয়েছেন? খাই না, তবে খেতে জানি, তুমি আনো। প্লাবন দু’টো সিগারেট ধরিয়ে আনে। একটা ভাঙা পিলারের উপর বসে নীরবে দু’জনে সিগারেট টানতে থাকে।

অনেকক্ষণ চুপ থেকে মারুফা আবার একই প্রশ্ন করে, “তুমি কি দশ লক্ষ টাকা নিবা, নাকি আমার সাথে একবার সেক্স করবা?” প্লাবন আঙ্গুলে আঙ্গুল গেঁথে মারুফার হাতটা ধরে। এরপর ফিসফিসিয়ে বলে—

পৃথিবী ফুরিয়ে যাক,

তবু আমার আকাশটা চাই।

তুমি এবং আমি

আমরা জানি— পৃথিবীতে

মানুষের আজ বড়ই দু:সময়।

মুক্তি চাই,

প্রিয়, তোমাতে আমি শুধু মুক্তি চাই।