গ্রাম থেকে বন্ধু আসছে। এদিকে অবিনাশের চলছে চাকরি নিয়ে টানাটানি। মুক্তযুদ্ধ জাদুঘরে একজন বড় মানুষের সাথে ছোটখাটো একটা চাকরি করে ও। অবিনাশ গত বিশ বছরে কমপক্ষে এরকম বিশজন বড় মানুষের সাথে চাকরি করে এখনো নিজের মেধা-বুদ্ধি এবং প্রজ্ঞা অবিনশ্বর করে রাখতে পেরেছে, যদিও পেটে মাঝে মাঝে ভয়ানক টান পড়ে। তারপরও এস্পার ওস্পার করে নিজের স্বপ্নটাকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে ঠিকই। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের এই চাকরিটাও প্রায় যায় যায় অবস্থা। কারণ, স্যার চান অবিনাশের মেধার যতভাবে পারা যায় অবমূল্যায়ন করে, কোনোমতে ডিগ্রি পাশ অফিশের কয়েকজন কম্পিউটার অপারেটরের লেবেলে নামিয়ে এনে স্বস্তায় ব্যবহার করতে।
অবিনাশ লেবেল নিয়ে চিন্তা করে না, কিন্তু স্যার অকাজে তাকে করোনার এ দুর্যোগকালীন সুযোগ নিয়ে স্বস্তায় ব্যবহার করছে, এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। অবিনাশকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে- ছাড়ছেও না, ধরছেও না। অবিনাশ মূলত অফিসে এসেছে বিষয়টি বুঝতে। গ্রামের বন্ধু অবশ্য জানে যে, অবিনাশ অমুকের সহকর্মী হিসেবে খুবই দাপটে আছে। দাপটটা অবিনাশের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা এবং সুকর্মের ফসল হলেও সেটিকে অন্যের ছত্র হিসেবে দেখিয়ে নিজেকে থাকতে হচ্ছে তার ছায়ায়। স্যার যেমনই চাক না কেন অবিনাশ নিজের লেখালেখি ঠিক রেখেই স্যারকে সময় দিয়েছে। আন্তরিকভাবেই সময় দিয়েছে, কিন্তু তাতে কী হবে! স্যার যে ওকে ঠিকমতে ব্যবহার করতে পারছে না তাতেই আছে বেজায় খেপে। এদিকে অবিনাশ খেপে আছে ওর মেধা যোগ্যতার অবমূল্যায়ন করায়।
অনেকক্ষণ স্যারের সামনে বসে থাকার পরও স্যার কোনো কথা না বলায় অবিনাশ লাজ লজ্জ্বার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করে, “পত্রিকার কাজের কী অবস্থা, স্যার।” স্যার খুব নির্লিপ্তভাবে জবাব দেয়। অবিনাশ বুঝতে পেরেছে যে, পাইক পেয়াদা দিয়ে যেটুকু দরকার স্যারের তা হয়ে যাচ্ছে। না হলেও অবিনাশের কাছে প্রমাণ করতে হবে যে, সে না থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। অবিনাশ খুব অখুশি নয়, কারণ, বিভিন্ন কৌশলে তাকে প্রায়ই অপমানজনক অবস্থায় ফেলা হচ্ছিল মেরুদণ্ড শুরুতেই ভেঙে দিতে। এসব স্যারেরা এটাই করেন— কিছু চাটুকার এবং কিছু মেরুদণ্ডহীন প্রাণী নিয়ে চলতে পছন্দ করেন। চাকরিটা যে আর নেই, অবিনাশ তা বুঝতে পেরেছে, এবং কেন জানি তাতে একটুও খারাপ লাগছে না, যদিও চলবে কীভাবে সেটি মোটেও নিশ্চিত নয়, এমনকি এই মুহূর্তে বন্ধুকে নিয়ে বাসায় ফেরার টাকাটাই নেই।
তারপরও মুখে একটা হাসি সৃষ্টি করে বেরিয়ে এসে গ্রামের স্কুলের বন্ধুকে বলে, বন্ধু একটু দেরি হয়ে গেল! দুপুরও তো হয়ে গেল। চল, নিচে গিয়ে খাই। বিরানি খাবি? অফিসের নিচের দোকানের কাচ্চি বিরানিটা খুব ভালো। রায়হান বিরানির কথা শুনে একগাল সরল হাসি দিয়ে বলে, ওহ! বেতন পেয়েছিস বুঝি আজ? আমারে কিছু টাকা এই মাসে ধার দিবি বলেছিলি কিন্তু। অবিনাশ মুখে দিগুণ হাসি তুলে বলে, আরে বলছি যখন দেব। চল, আগে তো খাই।
নিচে নেমেই রায়হানকে একটু অন্যদিকে পাঠাতে পকেটের শেষ বিশ টাকার নোটটা দিয়ে বলে, বন্ধু কিছু মনে না করলে একটা বেনসন সিগারেট নিয়ে আয় তো, আমার খুব বাথরুম পেয়েছে, আবার উপরে যেতে হবে। কৌশলে রায়হানকে একটি দূরের দোকান দেখিয়ে দিয়ে অফিসের নিচের বিরানির দোকানের মামাকে বলে রাখে— মামা, খাওয়ার পরে টাকা চাইয়েন নান কিন্তু, গ্রাম থেকে দোস্ত আসছে, এখনও বেতন পাইনি। গণমানুষের সাথে অবিনাশের খুব ভালো সম্পর্ক, তাই বিরানির দোকানীর বুঝতে মোটেও কষ্ট হয় না।
রায়হান সিগারেটটা দিয়ে বলে, তুই কি খাওয়ার আগেই সিগারেট খাবি? একটু খাই, খুব চাপ যাচ্ছে কিনা —একথা বলেই খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে অবিনাশ সিগারেটটা ধরায়। বিরানি দুই প্লেট সামনে চলে এসেছে। রায়হান খুব ক্ষুূধার্ত আবার খাবারটাও দেখতে খুব লোভনীয়, তাই হাত চালাতে আর দেরি করেনি। অবিনাশের মাথায় জীবন বাস্তবতা নিয়ে এই মুহূর্তে একটি কবিতা ঘুরঘুর করছে, সেটি মোবাইলে টুকটুক করে লিখছে, আর সিগারেট টানছে—
যে জীবন রেঙেছে বোধে,
পরিপক্ব এক বরেণ্য নারীর
প্রমে লুকায়িত
যৌবন আমার নাগাল
পায় না আর সেধে,
এসব অর্বাচীনতার
আর কি কোনো সাধ্য আছে
আমায় কভু রোধে?
অবিনাশ সিগারেটের ফিল্টারটা টোকা দিয়ে বাইরে ফেলে বিরিনির মাংসটা রায়হানের প্লেটে তুলে দিয়ে বলে, বন্ধু, একটু হজমে সমস্যা হচ্ছে, তাই মাংসটা কিছুদিন ধরে খাচ্ছি না। অবিনাশ তৈলাক্ত ভাতের প্লেটে অনিচ্ছায় হাত নাড়াতে নাড়াতে প্রাণভরে স্কুলের বন্ধু রায়হানের খাওয়া দেখতে থাকে—
শূন্যে যার সুখ ভাসে,
অবিরাম স্বপ্ন আসে,
তাকে কে ঠকায়?
কে না জানে
পৃথিবীর ঈশ্বরও তো চলে
এমনই এক কবির ইশারায়।