বিবেক একটি তরমুজ কিনে নিয়ে বাসায় ফিরছিলো। দামের কারণেই কিনা- তরমুজ বর্তমানে খুবই আলোচিত এক নাম। তরমুজ কেন কেজি দরে বিক্রি হয় ইত্যাদি নানান অভিযোগ ক্রেতাদের। কিন্তু বিবেক তার ছোটবেলা থেকে তরমুজ কেজি দরেই বিক্রি হতে দেখে আসছে। আরও অনেক আগে হয়ত পিচ হিসেবে বিক্রি হত। আসলে কেজি দরে বিক্রি হওয়াটাই তো ন্যায্যতা।
তরমুজের কদর আজীবন থেকেই। ছোটবেলায় এ বাড়ী ও বাড়ী তরমুজের সিজনে শনির পূজো হতো। প্রাসাদের মধ্যে সিঙ্গাড়ার সাইজের এক পিচ তরমুজ থাকতো। তখন তরমুজের কেজি ছিল পাঁচ টাকা, এখন চল্লিশ টাকা। এখনই বরং শনির পূজো বা হরিরলুটের প্রাসাদে তরমুজের পিচের আকারটা একটু বড় হয়েছে, কারণ, মানুষের সামর্থ বেড়েছে।
এসব সাত সতেরো চিন্তা করতে করতে বিশাল সাইজের একটা তরমুজ নিয়ে বাসায় ফিরছে বিবেক। কেটে দেখে এনেছে, বেশ লাল টকটকে একটা তরমুজ। বাসায় মানুষ মাত্র চারজন- দুই সন্তান আর স্বামী-স্ত্রী, এতবড় তরমুজ সবাই মিলে প্রচুর পরিমাণ খাওয়া যাবে।
হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটে যায়- পলিথিন ছিঁড়ে তরমুজটা গড়িয়ে পড়ে পিচের রাস্তায়। পড়ে কিছুটা ফেটে গিয়ে গড়িয়ে মাঝ রাস্তায় চলে যায়। বিবেক কিছু বুঝে ওঠার আগেই তরমুজটাকে চাপা দিয়ে খুলনাগামী একটি গাড়ি চলে যায়। তরমুজের আর কোনো অস্তিত্ব থাকে না, বিবেক অসহায়ের মতো ছিন্নভিন্ন হয়ে রাস্তায় ছিটিয়ে থাকা তরমুজের দিকে চেয়ে থাকে। একটা তরমুজ কেনার টাকা সঞ্চয় করতে তার একমাস লেগেছে, সেই তরমুজটা কিনা এভাবে গোল্লায় গেলো! বাসায় ছেলেমেয়েকে বলে এসেছে তরমুজের কথা, ওরা তো অপেক্ষা করে আছে। এখন কী করা যায়? সাপ্তাহিক কিস্তিতে তরমুজ কেনার সুযোগ থাকলে এখন সে তা-ই করত! খুবই অসহায় লাগছে। কারো কথা মাথায় আসছে না, যার কাছ থেকে দুইশো টাকা ধার করা যায়। বিপাকে পড়লে কেউ টাকা দিতে চায় না। দোকানটা যখন জমজমাট ছিল তখন টাকা চাইলে মানুষ দিত, কিন্তু করোনা অতিমারির পরে তার ছোট্ট মিষ্টির দোকানটা খুব আর চলে না, তাছাড়া পাশেই একটা বড় দোকান হওয়ায় মানুষ এখন সেই দোকানে যায়। তাও বিবেকের বাবা পরিতোষ ময়রার রসগোল্লার নাম ছিল বলে বংশের জোরে এখনও দোকানটা একটু যা চলে। ব্যবসায় বিবেকের কোনো কালেই মনোযোগ নেই, তাই শুধু করোনার কারণে নয়, পরিতোষ ময়রা মারা যাবার পর থেকেই দোকানটা আস্তে আস্তে তলাতে থাকে। এখন একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
জীবীকা নির্বাহ কতটা কঠিন সেটি মূলত বিবেক পিতা মারা যাওয়ার পর বুঝতে পেরেছে, এর আগে সে একরকম গায়ে বাতাস লাগিয়েই বেড়িয়েছে, পিতার কাছ থেকে ব্যবসাটা ঠিকমতো বুঝে রাখেনি, আবার পড়াশোনা করে চাকরি বাকরির দিকেও যেতে পারেনি। এখন একরকম অথৈ সাগরে পড়ার উপক্রম। যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় ছোট ছোট পেশায় যারা জীবন বাঁচাচ্ছে তারা জানে যে, পেশাগত সুনাম ধরে রাখা কতটা কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ।
এখন আর কিছু করার নেই। মানুষ তাকে ময়রা হিসেবে চেনেনি, আবার বড় পুঁজি নিয়ে ভালো কারিগর বসিয়ে বড় দোকান দেবার সামার্থও তার নেই, ফলে পরিতোষ ময়রা এক বছর মারা না যেতেই জীবীকার সংকট তৈরি হয়ে গিয়েছে। মাত্র দু’শো টাকা ধার দিতেও তার ওপর আস্থা রাখছে না মানুষ!
বিবেক নিরুপায় হয়ে বাজারের এক কোণায় চুপচাপ বসে থাকে। সেখানে দিনমজুর শ্রণির লোকজন বসে আছে কাজের আশায়। হঠাৎ পাশ্ববর্তী ইউনিয়ন থেকে চেয়ারম্যানের একজন লোক এসে দিনমজুর খুঁজছে। জনা বিশেক দিনমজুরের সাথে বিবেকও মিশে যায়। দু’টো নসিমনে উঠে তারা যাচ্ছে পাশ্ববর্তী ইউনিয়নে খাল পরিষ্কার করতে। একটানা খাল পরিষ্কার করে অন্যান্য শ্রমিকের সাথে বিবেকও চারশো টাকা পায়। খুব কষ্ট হয়েছে, কিন্তু যেভাবেই হোক তার একটা তরমুজ কেনা চাই। ছেলেমেয়ে দু’টো তরমুজের অপেক্ষায় সারাদিন বসে আছে। ঝুমাকে অবশ্য জানিয়ে রেখেছে যে, এক বন্ধুর সাথে তার হাসপাতালে যেতে হচ্ছে, ফেরার সময় তরমুজ নিয়ে ফিরবে, বিকেল হয়ে যাবে।
শিরোমণি বাজারে এসে তিনশো টাকা দিয়ে আগের মতোই একটা তরমুজ কিনে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয় বিবেক। এবার নিষিদ্ধ পলিথিন দু’টো দিয়ে নিয়েছে, ছিঁড়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই। এবারের তরমুজটা কিনে আনন্দ অনেক বেশি হচ্ছে। এই প্রথম সে একান্ত নিজের উপার্জনের টাকা দিয়ে কিছু কিনেছে। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। প্রথম তরমুজটা ওভাবে নষ্ট না হলে আজ এতবড় একটা শিক্ষা হত না। পৃথিবীতে যারা কায়িক পরিশ্রম করে বেঁচে আছে অন্তর থেকে তাদের স্যালুট জানায় বিবেক। বিশেষ কোনে শিক্ষা নাই, দীক্ষা নাই, প্রতিটি দিন যাদের অনিশ্চিত কীভাবে তারা আসলে বেঁচে থাকে? কীসের নেশায় বেঁচে থাকে? একদিনের পরিশ্রমে বিবেক বুঝেছে- এ জীবন সত্যিই খুব কঠিন, অমানবিক। তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনই শেষ কথা নয়, মুক্তি দিতে হবে তাদের, নইলে সভ্যতার এ দাবী নিছক প্রগলভতা ছাড়া আর কিছু নয়।
বাসায় পৌঁছে তরমুজটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে, যেন এটা তার সদ্যজাত সন্তান! অবশেষে একটা তরমুজ নিয়ে ফিরতে সে পেরেছে, সে সফল!