ছোটগল্প: বারাউত

follow-upnews
0 0

খ্রিষ্টপূর্ব এক হাজার বছর আগের কথা বলছি। শহরটার নাম বারাউত। ঠিক শহর বলা যাবে না, কারণ, তখনও ঠিক নগর সভ্যতা শুরু হয়নি, তবে প্রাচীন সভ্যতার প্রেক্ষাপটে লোকালয়টিকে শহর বললে সেটি অত্যুক্তিও হবে না। বারাউতের প্রশাসন ব্যবস্থা ছিল খুবই ‘মানবকল্যাণমুখী’, তবে স্বেচ্ছাচারিতা ছিল। প্রশাসনের যখন যা মাথায় আসত তাই বাস্তবায়ন করতে চাইত। দ্বিমত করার কোনো সুযোগ ছিল না। জনগণের কোনো ক্ষমতা ছিল না, তবে জনগণের প্রতি সুদৃষ্টি ছিল প্রশাসনের। রাষ্ট্র প্রধান, আবার তাকে নগর প্রধানও বলা চলে— মাত্র ২২ বর্গকিলোমিটারের একটি সার্বভৌম ভূখণ্ড, প্রধানের নাম উমাউতি বারবার। সীমানা লিখিত, এবং নিচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। পাঁচিল টপকায়ে কেউ ঢোকার চেষ্টা করে না, কারণ, বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করলে তাৎক্ষণিক বিচারে মৃত্যু অবধারিত। তবে এক নগরের লোক অন্য নগরে অনুমতি নিয়ে যেতে পারে। যাবার কারণ দর্শাতে হয়। সীমানায় লেনদেন হয় কেনাবেঁচা হয়, এজন্য বিশেষ ব্যবস্থা আছে। নারী কেনাবেঁচাও চলে।

বারাউতে মাত্র ষোলো হাজার লোক বসবাস করে। সবাই সবাইকে চেনে। বাইশ বর্গকিলোমিটার আবার প্রশাসনিক সুবিধার্তে দশভাগে বিভক্ত। অর্থাৎ প্রত্যেক ভাগে মাত্র ষোলোশো লোকের বসবাস। প্রত্যেকটি ছোট্ট এলাকা নিয়ন্ত্রণের জন্য রয়েছে একজন করে সর্দার এবং তার পঁচাত্তর জন্য সহযোগী। খুন খারাবি, ডাকাতি, চুরি নেই, তবে ভয়ঙ্কর পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে। নারীদের কোনো ক্ষমতা নেই। একটা অদ্ভুত বিষয় সেখানে রয়েছে— অবিবাহিত নারীরা যে কোনো পুরুষের সাথে মিলিত হতে পারে, তবে নিয়মটি একপেশে, সেটি সংগঠিত হতে পারে শুধু পুরুষের ইচ্ছায় । নারীটির মতামত নেওয়ার একটি বিধান থাকলেও কার্যত সেটি মানা হয় না। ফলে বারাউতে মূলত কোনো কুমারী নারী পাওয়া যায় না। প্রশাসক শ্রেণির লোকেদের অবশ্য আলাদা হেরেম রয়েছে, সেখানে অবশ্য পূর্ণ বয়স্ক নারীদের আনা হয় না। শিশুমেয়েদের এনে লালনপালন করে বড় কর হয়, যাতে কুমারীত্ব নিশ্চিত করা যায়। রাজা (বারাউতে রাজাকে বলা হয় উবার) মূলত এইসব মেয়েদের সাথেই মিলিত হয়। মজার (ভযঙ্কর) বিষয় হচ্ছে— উবার কোনো নারীর সাথে দ্বিতীয়বার মিলিত হয় না। উবার মিলিত হবার পর ঐ মেয়েটির জায়গা হয় একটি সরকারি বেশ্যাখানায়। সরকারি বলতে উবারের পাইক পেয়াদারাই বেশ্যাখানাটি চালায়। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে সবচেয়ে বেশি অর্থ আসে এই বেশ্যাখানা থেকে। বেশ্যালয়ের নারীরা পায় শুধু থাকা আর খাওয়া, অসুস্থ হলে চিকিৎসা করা হয়, তবে সে চিকিৎসা নিছক কবিরাজি ছাড়া কিছু নয়। মারণ রোগ হলে মৃত্যু তাদের অবধারিত।   

যৌন ছোঁয়াছে রোগ সম্পর্কে প্রশাসনের কোনো ধারণা ছিল না। কোনো নারী এভাবে অসুস্থ হলে তাকে অভিষপ্ত নারী হিসেবে গণ্য করে পুড়িয়ে ফেলা হত। পুরুষদের এ ধরনের কোনো রোগ হলেও তার জন্য সংশ্লিষ্ট নারীটিকেই দায়ী করা হত। পুরুষটির কাছে শোনা হত যে, সম্প্রতি সে কোন নারীর সাথে মিলিত হয়েছে। এরপর ঐ নারীটিকে পুড়িয়ে মারা হত। নারীদের বলার কিছু ছিল না, কেউ প্রতিবাদ করলে বিচারে তার তাৎক্ষণিক মৃত্যু নিশ্চিত।

আবার এর উল্টোচিত্রও আছে। বারাউতে কেউ ক্ষুধায় কাতরায় না, কোনো অর্থনৈতিক বৈষম্যও নেই। কোনো শিশু জন্ম নিলে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব নেয়। আবার কোনোভাবেই তারা জনসংখ্যা বাড়তে দিতে রাজি নয়। ফলে একটা নিষ্ঠুর ব্যবস্থা সেখানে কার্যকর আছে। কারো তৃতীয় সন্তান হলে রাষ্ট্র সে সন্তানটিকে নিয়ে নেয়। রাষ্ট্রের দায়িত্বে শিশুটি বড় হয়। বারো বছর বয়স হলে শিশুটিকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। টাকাটা জমা হয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে, ফলে দুর্ঘটনা ব্যতীত কেউ তৃতীয় সন্তান নেয় না। এক ধরনের প্রাকৃতির জন্মনিরোধক ব্যবস্থা সেখানে রয়েছে। নারীদের প্রতি অনাচার ব্যতীত আর কোনো নৈরাজ্য এই ক্ষুধে রাষ্ট্রটিতে নেই। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে— জ্ঞান চর্চার জন্য তিন ধাপে তিনটি শিক্ষালয় সেখানে আছে। কোনো ডিগ্রি অর্জনের ব্যবস্থা নেই, তবে যুদ্ধবিদ্যা থেকে শুরু করে চিকিৎসাবিদ্যা সেখানে শেখানো হয়, এমনকি বিভিন্ন রাজ্য থেকে শিক্ষক আনার ব্যবস্থা করে প্রশাসন। নারীশিক্ষা অসম্ভব। তবে অনেক নারী রয়েছে যারা তাদের প্রিয় পুরুষের কাছে গোপনে বিদ্যাশিক্ষা করে থাকে। এভাবে একটি সচেতন নারী সমাজও তলে তলে বারাউতে গড়ে উঠেছে। দুএকজন নারী একটু আধটু প্রতিবাদ করতেও শুরু করেছে। হাস্যরসের মাধ্যমে তারা সামান্য প্রতিবাদের ক্ষেত্র তৈরি করে যাতে বিচারের মুখোমুখি না হতে হয়।

নারীদের পোশাক সম্পর্কে অবশ্য রাষ্ট্র এবং পুরুষতন্ত্র উভয়ই ছিল বিশেষভাবে উদাসিন। বারাউতে কোনো মোল্লাতন্ত্র বা পুরুহিততন্ত্র ছিল না, কারণ, তখনও সেখানে কোনো ধর্ম বিকাশ লাভ করেনি। তবে পূজা ছিল, গাছ পূজাটাই প্রধানত ছিল। এছাড়া সূর্য পূজা ছিল। তারা সূর্যাস্তের পূজা করত পশ্চিমদিক ফিরে। ওরা মনে করত— সূর্যাস্তের পূজা করতে থাকলে একসময় আর সূর্যাস্ত যাবে না। ভয় পেত অন্ধকার, এজন্য তারা চাইত সবসময় সূর্য থাক, আলোকিত থাক। নারীদের পোশাকের কথা বলছিলাম— যেহেতু চামড়ার পোশাক ব্যতীত আর কোনো পোশাক তখন ছিল না, ফলে পোশাক সেখানে খুবই দামী বস্তু। একটি পোশাকের মূল্য দিয়ে দিব্যি একজন মানুষের একবছরের খাবার খরচ হয়ে যেত। রাতে একটু শীত পড়লেও বেশি শীত বারাউতে পড়ে না, ফলে প্রাকৃতিক কারণে খুব বেশী পোশাক প্রয়োজনীয় নয়। লজ্জা নিবারণের জন্য পুরুষরা পরে পাতার এক ধরনের পোশাক। শুধু নেতৃত্বস্থানীয় লোকেরা চামড়ার পোশাক পরে।

সামার্থ থাকলেও জনগণের মধ্য থেকে কেউ চামড়ার পোশাক পরে না, তখন তাদের ওপর উচ্চ হারে কর ধার্য হয় বলে। নিজে না পরলেও ধনী অনেকে তার প্রিয় নারীকে চামড়ার পোশাক দেয়, প্রধানত বাঘের চামড়ার। এ পোশাকে নারীদের খুবই সুন্দর লাগে। নারীদের চামড়ার পোশাক পরতে বাধা নেই, নারীদের ওপর কোনো কর ধার্য নেই। তবে কেউ বেশ্যাবৃত্তিতে নিয়োজিত হলে তাকে কর দিতে হয়। নারীরা কোমরে আট ইঞ্চি চওড়া এক টুকরো বাঘের চামড়া জড়ায়, আর বুকে জড়ায় প্রায় একই মাপের একব টুকরো হরিণের চামড়া। যাদের এ সামার্থ নেই, তারা একই ধরনের পাতার পোশাক পরে। বারাউত সম্পর্কে অনেক কথা বলার আছে, তবে আজকে শুধু পোশাকের বিবর্তনের কথাই বলি। হঠাৎ করে বারাউত থেকে তিনশো কিলোমিটার দূরে ওরকম ছোট্ট একটি রাজ্যে একটি রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে রোগটি ক্রমান্বয়ে বারাউতের দিকে এগাতে থাকে।

বারাউতের প্রশাসন কয়েকজন লোক পাঠিয়ে খবর নেওয়ার চেষ্টা করে যে, কীভাবে রোগটি ছড়াচ্ছে। সৈন্যরা এসে খবর দেয়— রোগাক্রান্ত কারো সংস্পর্শে গেলেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে মানুষ। মোট বারোজন সৈন্য খবর আনতে গিয়েছিল, তার মধ্যে মাত্র দুজন ফেরৎ আসতে পেরেছে। বাকীরা রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ঐ দুজন বলে, কিরিবাউ নামের ঐ রাজ্যে রাজা সভাসদ সাথে নিয়ে এবং পর্যাপ্ত খাদ্যখাবার নিয়ে একটি গুহা খুঁড়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। এবং আমরা খবর পেয়েছি যে, তারা ভালো আছে। এ কথা শোনার পর বারাউতের উবারের একটি বুদ্ধি মাথায় আসে। আগে থেকেই জানত, দক্ষিণ দিকে একটু দূরের একটি রাজ্য বিশেষ ধরনের পোশাক বানাতে সক্ষম হয়েছে। সিদ্ধান্ত নেয় তাদের কাছ থেকে পোশাক আনতে হবে। সৈন্যদের বলে দেয়, ঘোষাণা দিয়ে দাও যেন কোনো নারী পুরুষ ঘর থেকে বের না হয়, খাবার এবং প্রয়োজনীয় রসদ তাদের ঘরে পৌঁছে যাবে।

দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে সৈন্যদের জন্য আপদমস্তক ঢাকা বিশেষ ধরনের পোশাক বানানো হয়। মুখের মুখোশটি বানানো হয় খেজুর গাছের দুই পরত ফেতরা দিয়ে, ফলে নিঃশ্বাস নিতে অসুবিধা হয় না। একইসাথে একটি বড় গুহাও তৈরি করা হয়েছে। কিরিবাউয়ের রাজার মতো বারাউতের রাজা স্বার্থপর সিদ্ধান্ত নেয়নি। সে নারীদের ঐ গুহায় পাঠিয়ে দেয়, প্রধানত গর্ভবতী নারী এবং শিশু সন্তান সহ মায়েদের। খবর আসতে থাকে যে আসেপাশের রাজ্যগুলোতে মড়ক লেগেছে। সব মরে ছাপ হয়ে যাচ্ছে। ছয় মাস এভাবে চলার পর রোগের প্রকোপ থামে। সৈন্যরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারে— আশেপাশের রাজ্যের নব্বইভাগ লোকই মারা গিয়েছে, কিন্তু বিশেষ ব্যবস্থার কারণে বারাউতে এ রোগ ঢুকতে পারেনি। এ সফলতায় বারাউতের রাজা খুবই উৎফুল্ল, জনগণও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অনেকে রাজার পূজো করতে থাকে।

রাজা একটি সভা ঢাকে। সভায় রাজা প্রস্তাব করে, নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এই পোশাক আমরা আরো এক বছর চালিয়ে যাব। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই পুরুষরা আপদমস্তক ঢাকা এই পোশাক নিয়ে আপত্তি করতে শুরু করে। এ ধরনের পোশাক পরে চলাফেরা করা, কাজকর্ম করা খুবই অসুবিধা। তাছাড়া গরমও লাগে খুব। ফলে মাত্র এক মাসের মধ্যেই পোশাক নিয়ে রাজাকে আবার সভা ডাকতে হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়— যেহেতু পুরুষদের বাইরে অনেক কাজ করতে হয়, তাই পুরুষরা পোশাকের ক্ষেত্রে স্বাধীন, তবে নারীদের এ পোশাক চালিয়ে যেতে হবে। শুধু চোখ ব্যতীত তাদের শরীরের আর কোনো অংশ দেখা গেলে ছত্রিশটা বেত্রাঘাত করা হবে, আর কোনো নারী এ পোশাক ছাড়া বাইরে বের হলে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। সেই থেকে বারাউতে চালু হয়ে গেল নারীদের বোরখা এবং নেকাব ব্যবস্থা। আজও সেখানে একই নিয়ম চলছে।


শেকস্ রাসেল

লন্ডন, যুক্তরাজ্য

Next Post

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে নির্মূল কমিটির রক্তদান ও বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বিশ্বশান্তি ও মানবতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বিপন্ন প্রকৃতি ও আর্তমানবতার পাশে দাঁড়ানোর ব্রত নিয়ে দেশব্যাপী রক্তদান ও বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির শুভ সূচনা করেছে। অদ্য ১৭ মার্চ কেন্দ্র সহ নির্মূল কমিটির বিভিন্ন শাখা ১০০ ব্যাগ রক্তদান এবং ১০০টি বৃক্ষরোপণের […]
বৃক্ষরোপন কর্মসূচী