Headlines

ছোটগল্প: ক্ষুধা ।। হাসনা হেনা

ক্ষুধা

ঝাপসা চোখে নদীর দিকে তাকায় সফর আলী। বুঝতে চেষ্টা করে ঠিক কোথায় ছিলো তাঁর বসত ভিটে, কোথায় ছিলো ধানী জমি। কিন্তু কিছুতেই বোঝে ওঠতে পারে না সে ।থৈ থৈ করছে জল। অদ্ভুত রকমের বিষাদী বাতাস সফরের ঘোরলাগা মনে টোকা মেরে চলে যায়। সফরের ভেতরটায় কেমন যেন হাহাকার ।ঈষাণ কোণে মেঘের ঘনঘটা। ক্ষুধার্ত একটা কাক, কা কা করে সফর আলীর মাথার উপর দিয়ে সাঁই করে উড়ে গেল। সফর আলীর বুকটাও কেমন যেন হু-হু করে উঠলো। কিছু সময় পর পর সফরের মনে হয় বুকের বিরাণ ভিটায় জোরসে ঝড়ো বাতাস বয় ।

সফরের বউ মাজেদা হা-হুতাশ করে আর কাঁদে। হায় …আল্লাহ্ একি হয়ে গেল! গোলায় ধান ছিলো। মাঁচা ভর্তি ছিলো কত রকমের সব্জি। খোয়াড় ভর্তি হাসঁ, মুরগী ছিলো কিছুই রক্ষা করতে পারেনি । রাতের আঁধারে রাক্ষুসী নদী সবটুকুই গিলে নিয়েছে। কোনো রকম ছ’ছেলে মেয়ে সহ উঁচু রাস্তায় এসে আশ্রয় নিয়েছে।

উঁচু রাস্তার উপর ভেড়ার পালের মত বসতি গড়েছেন ওদের মতই কয়েক শো সহায় সম্বলহীন লোক। আহা! সফর কী যেন বিড় বিড় করে! ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে বেশ কিছু গবাদী পশুর মৃতদেহ স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে। আবারও আকাশে তাকিয়ে প্রলাপ বকে সফর। সাহায্য চায় স্রষ্টার কাছে। সফর তার নিজের দুটোগরু—কাজলা আর সাজলার শরীরে একবার হাত বুলায় আর বলে আহা..রে, ভাগ্যিস তোদের রক্ষে কইরতে পাইরলাম।

দুশ্চিন্তায় চোখে আন্ধার দেখে সফর, গরম লোহাকে যেমন পিটাতে থাকে কামার, অমন সফর আলীর কলিজায় কেউ পিটায় আর পিটায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে একাই প্রলাপ বকে সফর আহা রে ….আমার প্রিয় গাঁ তোক ছাইড়া কই যামু? আর এইহানে থাইকাই বা কী কইরবো? অনাহারে আর অাধপেট খাইয়া আর কত? সফর আলী ভারি গলায় বউকে বলে এভাবে তো আর চলবার পারে না রে বউ।

পোলা মাইয়াগেের মুখের দিকি চাওন যায় না। এইহানে থাইকা আর কি হইবো? সব তো রাক্ষুসী গিইল্যা খাইল। মাজেদার চোখে টলমল করছে জল। মাজেদার কুলে ঘুমন্ত, ছয় মাসের মেয়ে রূপা। দু’ফোঁটা চোখের জল মাজেদার গাল বেয়ে টুপ করে রূপার কপালে পড়েছে। রূপা ঘুম ভেঙে চিৎকার করছে ওদিকে মাজেদার কোনো খেয়াল নেই। নির্বাক মাজেদা অবাক তাকিয়ে রয় সফর আলীর মুখের দিকে।

সফর আলী ক্ষীণস্বরে প্রশ্ন করে—কী রে বউ এই রহম ড্যাবড্যাব কইরা চাইয়া আছস ক্যান? কিছু তো বল! মাজেদা আঁচলে চোখ মুছে আর কান্না ভেজা স্বরে বলে আমি আর কী কমু? আপনে যা ভালো বুঝেন তাই করেন। সফর আলী আকাশে তাকায়, বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস মিশে যায় প্রবাহমান বাতাসে। কিছু সময় চুপ থাকার পর সফর আলী আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে শুইনছি ঢাকা শহরে না কি কাম কাইজের অভাব নাই, চল বউ শহরে চইলা যাই, পোলা মাইয়া নিয়া চারটে খেয়ে বাঁইচবার তো পাইরবো। মাজেদা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। মাজেদার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে ব্যথায়। স্বজন, প্রতিবেশী সবার জন্য মন কেমন করে।
সফর আলী ঠিক করে গরু দুটো হাঁটে নিয়ে বিক্রি করে ঢাকা শহরে চলে যাবে—ওখানে গিয়ে একটা রিক্সা কিনে রিক্সা চালাবে ।

ঘুটঘুটে আঁধার, থমথমে পরিবেশ টিপটিপ বৃষ্টি ঝরছে। সফর আলী গভীর চোখে তাকিয়ে থাকে অন্ধকারে। রাতের গভীর আঁধার আরও গম্ভীর করে দেয় সফর আলীর মন। এক কেজী চাল আর কয়েক মুঠো চিড়া মুড়ি সম্বল। তারপর কী হবে? রাজ্যের চিন্তা এসে ভর করেছে সফর আলীর মাথায়। কদিন ধরে ঘুমও বেশ জ্বালাচ্ছে ,নাগালের বাইরেই থাকে। ধরা দিয়েও যেন ধরা দিতে চায় না। ছটফট করতে করতেই ভোর নেমে আসে। ভাবতে ভাবতে শেষ রাতের দিকে চোখের পাতা দুটো কখন যেন এক হয়েছে বুঝতে পারেনি সফর আলী।

হিম হিম ভেজা বাতাস বইছে। দূরে মোল্লা বাড়ির মসজিদ থেকে ভেসে আসছে ফজরের আযানের সুর। মাজেদার সেই অনেক দিনের অভ্যেস ফজরের আযানের পর আর বিছানায় থাকতে পারে না সে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানা ছাড়ে মাজেদা। একচালা ছাপড়া ঘর ছেঁড়া কাপড়ের বেড়া দিয়ে কোনোভাবে মাথাগোজার জায়গা বানিয়েছে সফর আলী। খুপড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে কাজলা, সাজলার খোঁজ করে মাজেদা। কোথাও দেখতে না পেয়ে মাজেদার বুকের ভেতরটায় কেমন ছ্যাঁত করে ওঠে। মুহূর্তেই নিজের ভেতরে তীব্র   ছটফটানি টের পায়। উঁচু গলায় ডাকতে থাকে সফর আলীকে। ও জরির বাপ ওঠেন—আমাগো কাজলা সাজলা নাই। হতভম্ব মুখে প্রশ্ন করে সফর– কী কস বউ? সফর আলী মুহূর্তেই চারপাশে আন্ধার দেখে। আহা! শেষ ভরসা ছিল কাজলা সাজলা। এলোমেলো পায়ে পাগলের মত চারপাশটা খুঁজতে থাকে। নেই কোত্থাও নেই। অনেক দূর পর্যন্ত খুঁজেও কাজলা সাজলাকে পাওয়া গেল না। সবাই ধরেই নিলো—ওরা চুরি হয়ে গেছে।

সকালটা বড় শান্ত আর উদাস। হাসি মুখে উঁকি দিচ্ছে লাল টুকটুকে সূর্যটা। মাজেদা আজ বিছানা ছাড়েনি। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না মোটেও। জীবনে এই প্রথমবার শহরে এসে বস্তিতে বসত গড়েছে। শরীরের আর দোষ কোথায়! শরীরমন দুটোর উপর দিয়ে কম তো ধকল যায়নি। শহরের অচেনা অজানা পরিবেশ গিচগিচে বস্তি, মানুষের শোরগোল,গাড়ির শব্দ, এখানে সেখানে ময়লার স্তুপ আর দুর্গন্ধ সব মিলিয়ে মাজেদা বেশ অস্থির সময় কাটাচ্ছে এই কদিন। মাথায় রাজ্যের চিন্তা তার ওপর আবার পেটে দানা পানি পড়ে না ঠিকমতো। সফর আলীর মেজাজটাও সব সময় খিটখিটে হয়ে থাকে। শহরে এসে ঠিকঠাক কোনো কাজ পাচ্ছে না। ভাড়ায় ভ্যান চালিয়ে মহাজনের হাতে তুলে দেয়ার পর যে কটাকা থাকে তা দিয়ে আট সদস্যের সংসারে কিছুই হয় না। বড় মেয়েটাকে এক বাসায় কাজে পাঠিয়েছে । একমাস কাজ করার পর মাইনে পাবে। ছেলে মেয়েরা ক্ষুধায় কাতরায়। এক বেলা খাবার জুটে তো অন্য বেলায় উপোস করতে হয়। মাজেদা এসব দেখে ভেঙে পড়েছে, অস্বস্তিতে ছেলেমেয়ের দিক থেকে চোখ নামিয়ে নেয় সে।

রাতের পান্তা ছিলো, কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ ডলে সকালের নাস্তা হয়েছে। ঘরে চাল নেই, তাই উনুনে পাতিল বসেনি। ছেলেমেয়েরা বাবার পথ চেয়ে আছে, বাবা আসলে রান্না হবে তারপর খাওয়া। কিন্তু সফর আলীর ফেরার নাম নেই। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। ঘনঘনে রোদের দুপুরটা বেড়াল পায়ে হেঁটে যাচ্ছে বিকেলের দিকে। তেজদৃপ্ত রোদের গায়ে মিঠে আমেজ চলে আসছে।

হঠাৎ ,বাইরে খুব শোরগোল, একটা গাড়ি এসে থেমেছে বস্তির বড় রাস্তায়। বস্তির ছেলেমেয়েরা সব ভিড় করেছে গাড়ির কাছে। সফর আলীর ছেলেমেয়েরাও রাস্তার পাশে খেলছিল। বাবাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখেই দৌঁড়ে ঘরে এসে মাকে বলে–
মা দেইখ্যা যাও আমাগো বাবা এক সাহেবের গাড়ি থন নাইমছে। বাবার সাত সুন্দর ফকফকা এক সাহেব আরেক ম্যাম সাহেবও আছে। উনাগেরে লিয়্যা বাবা আমাগো বাড়ির দিক আইসতেছে। মাজেদা হতভম্ব হয়ে উঠে বসে। বিছানা ছেড়ে বারন্দায় এসে দাঁড়ায়।

সফর আলী কাঁশে গলা পরিষ্কার করে—ছেলে মেয়েদের ডাকে ।তার হাতে ব্যাগ ভরতি ফল আর খাবারের প্যাকেট। ঘরের দিকে এগিয়ে আসে সফর আলী। ছেলেমেয়েরা দৌঁড়ে গিয়ে সফরের হাতের প্যাকেটগুলো ঘরে নিয়ে যায় আর জিজ্ঞেস করে–
বাবা এই খাবার গুলাইন আমাগোর লিইগ্যা আইনছো ?
সফর মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সফর—চোখে মুখে তাঁর রাজ্যের ক্লান্তি। মাজেদা বুঝতে পারছে না এসব কী হচ্ছে! সফর আলী একটু কেঁশে, কাঁপা স্বরে বলে– বউ, সাহেব আর ম্যাম সাহেব রে বইসবার দে। মাজেদা চিন্তায় পড়ে যায়, কীসে বসতে দিবে—ঘরে তো কিছুই নেই। সাহেব উঁচু গলায় বলে সফর আলী আমরা বসব না—একটু তাড়া আছে। যে কাজে আসছি সেটা শেষ করো আগে।

মাজেদার বুকের ভেতরটা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠছে। এলোমেলো পায়ে সফর আলীর কাছে গিয়ে হাত চেপে ধরে টেনে নিয়ে একটু দূরে সরে দাঁড়ায় আর সফরের কানের কাছে মুখ নিয়ে খাটো স্বরে প্রশ্ন করে আপনের সাথ যারা আইসছে ইনারা কারা?

হতভম্ব সফর আলীর ফ্যাকাসে মুখটা মুহূর্তেই আরও ফ্যাকাসে হয়ে যায়। মাজেদার হাত থেকে এক ঝটকায় নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সাহেব আবার তাড়া দেয় সফর আলীকে। ভেতরটা কেমন করে ওঠে সফর আলীর – মাজেদার দিকে একবার অদ্ভুত চোখে তাকায়। ভেজা কণ্ঠে ছেলেমেয়েদের ডাকে। ছেলেমেয়েরা এসে দাঁড়ায়। সফর আলী কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে ” সাহেব , ম্যামসাহেব দেকেন দেকেন এরা সবাই আমার পোলা মাইয়্যা আপনেগের যাক ইচ্ছি তাক নিতি পারেন । তয় ট্যেকা কলাম তিরিশ হাজারের কম লমু না। নির্বোধ মাজেদা বোকার মত দাঁড়িয়ে কেবল দেখছে । স্বামীকে আবার প্রশ্ন করবে সে সাহস হচ্ছে না।

সফর আলীর ছেলেমেয়েদের একজন একজন করে কাছে ডেকে নিয়ে কথা বলছে সাহেব আর ম্যাম সাহেব। ম্যাম সাহেব বার বার মাজেদার কোলে থাকা সাতমাস বয়সী রূপার দিকে হ্যাংলার মত তাকাচ্ছে। মাজেদার কাছে ব্যাপারটা বেশ এলো মেলো লাগছে। স্বামীর চিন্তিত মলিন মুখটা দেখে বেশ চিন্তা হচ্ছে তাঁর। মনের ভেতর কাঁটার মত খচখচ করছে কিছু প্রশ্ন।

কাঁপা স্বরে ভয়ে ভয়ে সফর আলীকে প্রশ্ন করে মাজেদা– আপনে কিসের দর দাম কইরছেন? সফর আলী ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয় মাজেদাকে। ম্যামসাহেব সাহেবের কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু একটা পরামর্শ করে। সফর আলীকে দায় সারা গলায় বলে,সফর, তোমার স্ত্রীর কুলের মেয়েটিকে খুব পছন্দ হয়েছে আমাদের, আমরা ওকেই নিতে চাই ।
মাজেদার পায়ের নিচের মাটি যেন আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকে। রূপাকে বুকের মধ্যে শক্ত করে ঝাপটে ধরে, উত্তেজিত হয়ে উচ্চস্বরে সফর আলীকে বলে–
আপনের মতলব খান এইবার বুইঝেছি।

আপনে বাপ হইয়্যা নিজের সন্তান বিক্রি কইরবেন?
ক্যামন বাপ আপনে?
মাজেদা চিৎকার করে বলে– 

না খাইয়া মইরা যামু , তয় আমার নাড়িছেঁড়া ধন আমি কাউরো দিতি পাইরমো না। সাহেব ম্যামসাহেব আপনাগের পায়ে পড়ি,আপনেরা অক্ষণ এইহান থন চইলা যান! অক্ষণই যান! আমি আমার সন্তানকে কিছুতেই আপনেগ কাছ দিমো না। সফর আলী মাজেদাকে অনেকভাবে বুঝাতে চেষ্টা করল, কিন্তু মাজেদা কিছুতেই সন্তান বিক্রি করতে রাজি হচ্ছে না ।

সাহেব আবার তাড়া দিচ্ছে সফর আলীকে। সফরের চোখ দুটো দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে। এক হ্যাচকা টানে রূপাকে মাজেদার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ম্যাম সাহেবের কোলে তুলে দেয় সফর। মাজেদা থপাস করে মাটিতে বসে পড়ে। স্বামীর বিরুদ্ধে গিয়ে ম্যাম সাহেবের কোল থেকে নিজের মেয়েকে কেড়ে নিয়ে আসবে সে সাহস ও শক্তি কোনটাই নেই মাজেদার। রূপা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদে। মাজেদা একবার বুক চাপড়ায় একবার মাটি চাপড়ায়, চিৎকার করে কাঁদে ।

সাহেব সফর আলীর হাতে ত্রিশ হাজার টাকা গুজে দিয়ে রূপাকে নিয়ে দ্রুতপায়ে চলে যায়। মাজেদা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে , সাহেব আর ম্যাম সাহেবের চলে যাওয়া দেখে। মাজেদার কান্না প্রতিধ্বনি তুলে শহরের কোলাহলের সাথে মিশে যায়। ছেলেমেয়েরা চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে মাজেদাকে। ভেজা কণ্ঠে প্রশ্ন করে– মা, আমাগো বইনেরে সাহেব কই লইয়া যায়? আমাগো বইন আর কোনো দিন আমাগের কাছে আইবো না? মাজেদা নির্বাক নিঃশ্চুপ হয়ে যায়। রূপার নিঃষ্পাপ মুখটা বার বার মাজেদার চোখের সামনে ভাসে, আবার কোথায় যেন মিলিয়ে যায় ।

খোলা দরজায় এসে উদাস হাওয়া খেলা করে আপন মনে, কখনও দোল খেলে মাজেদার এলো চুলে, বারান্দায় থ মেরে বসে আছে নির্বাক নিথর মাজেদা। সন্ধ্যে নেমেছে রাজ্যের বিষণ্নতা নিয়ে। চারপাশে জ্বলে উঠেছে নিয়ন বাতি। মিটি মিটি জ্বলছে সন্ধ্যা তারা। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘেরা উঁকি মেরে মাজেদার দু:খে ,সমব্যথী হতে চাইছে। পাশের ঘরের নিলার মা কাজ থেকে ফিরে ছেলে মেয়ের সাথে একচোট চিল্লাচিল্লি শেষে মাজেদার পাশে এসে বসে। মাজেদার চোখের পানিতে শাড়ির আঁচল পুরোটা ভিজে একসা হয়ে আছে । চোখ দুটো ফোলা ফোলা। নিলার মা সমবেদনার হাত রাখে মাজেদার কাঁধে। ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে মাজেদা—আহারে আমার কলিজার টুকরা , আহারে আমার রূপা!

“কান্দিস না বইন, আমাগের মত গরীবের ক্ষুধা ছাড়া আর কিচ্ছু নাই! গরীবের অত মায়া থাইকতে নাই। নিজেরে সামলা বইন, শক্ত হ। তোর মাইয়া বড় লোকের ঘরে ভালা থাকবো ভালা খাইবো অত চিন্তা করিস না।”

মাথায় গামছা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ,পরনের লুঙ্গিটা এক হাতে ধরে, স্টেশনের পাশে এলোমেলো পায়ে হাঁটে সফর আলী। বুকটা কেমন খা খা করে। মেয়ের মুখটা কিছুতেই ভুলতে পারে না সে। বাসায় ফিরবে কোন মুখে বউকে কী বলে সান্ত্বনা দিবে ভেবে পায় না।মাথায় অসহনীয় যন্ত্রণা, স্টেশনের পাশে গামছা বিছিয়ে শুয়ে পড়ে সফর। আকাশের দিকে তাকিয়ে একাই প্রলাপ বকে..হায়রে ক্ষুধা, হায়রে পেট। ট্রেন আসে ট্রেন যায়, কত ব্যস্ত এই শহর! কত লোকের হুড়োহুড়ি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে সফর। কলিজার আঁচড় কাঁটে সোনালী দিনের স্মৃতি ।মনে পড়ে যায় ফেলে আসা নিজের গ্রাম, নিজের বসত ভিটে। স্বজন, প্রতিবেশী, উঠোনময় ছেলেমেয়েদের খুনসুটি আর মাজেদার হাসি খুশি মুখটা।

 


হাসনা হেনা   Hasna Hena