ঈশ্বরকে সাথে নিয়ে মানুষের জীবন জিম্মি করে ব্যবসা: এই ছেলেটা বাঁচবে তো?

follow-upnews
0 0

জীবন-মৃত্যু


বন্ধু তাপস এর সাথে গত দুইদিন ধরে ওর এলাকার একটি ছেলের চিকিৎসা নিয়ে দৌঁড়াচ্ছি। চিকিৎসা ব্যবস্থায় নৈরাজ্য এবং সাধারণ জনগণের হতাশা কোন পর্যায়ে গেছে সেটি বুঝানোর জন্য এ লেখা, পাশাপাশি জাফর ইকবাল স্যার বা এরকম আরো যাদের উপর পূর্বে হামলা হয়েছে সেসব হামলার সাথে এসব নৈরাজ্য যে বিচ্ছিন্ন নয় তাও আপাতত পরোক্ষভাবে বলা।

ছেলেটার বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপায়। ছেলেটার বলতে গেলে ওরকমভাবে কেউ নেই। পিতা আছেন—তিনি ওর উপরই নির্ভরশীল। নারকেল গাছ থেকে পড়ে গিয়ে ভয়াবহ ইনজুরড হয় ও। ওর সমবয়সী বন্ধুরা ওকে নিয়ে ছুটেছে, ছুটছে।
প্রথমে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছে, সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে। জেলা সদর হাসপাতালে পা ভাঙ্গা বা পায়ের অপারেশন করার মতো চিকিৎসাও যে নেই এটা তো দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ভয়ঙ্কর একটা দিক—তবে সেটি এই মুহূর্তে ভিন্ন আলোচনা। ঢাকা মেডিকেলে এনে যেটা হলো—কী হলো তা বলার আগে—প্রথমেই বলে নিতে হবে যে ঢাকা মেডিকেল আর কতো মানুষের চিকিৎসা একা দেবে! কিন্তু এর চেয়ে বড় কথা কেউ হাসপাতালে আসলে তাকে তো চিকিৎসা দিতেই হবে যেকোনো মূল্যে, নাকি?
ঢাকা মেডিকেল ছেলেটির পা অপারেশন করল, কিন্তু সবকিছু সমন্বিতভাবে করল না বা করতে পারল না, এরপর বলে দিল, “এখানে ইনটেনসিভ কেয়ার নেই, অন্যত্র নিতে হবে।” আহত ছেলেটির বন্ধুরা তখন কী করবে? ধীরে ধীরে ওরা দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে যায়। ঐ অবস্থায় করবেই বা কী! টাকা নেই, রোগীর অবস্থা ক্রমাগতভাবে খারাপ হচ্ছে।
দালাল চক্র ওদের নিয়ে যায় পপুলার হাসপাতালে। দুঃস্থ রোগী শুনে সেখান থেকে বলা হয়—এখানে অনেক খরচ। অাপনারা অমুক হাসপাতালে নিয়ে যান। এরপর দালাল চক্র ওদের নিয়ে গেল ধানমন্ডির ইডেন মাল্টিকেয়ার নামে একটি হাসপাতালে।
ট্রিটমেন্টের এই পর্যায় থেকে আমার সংযুক্তি। গত শুক্রবার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের পূর্ণমিলনী, ১১টার দিকে তাপস বিষয়টা আমাকে জানায়। চিকিৎসা করানো বিষয়ে অামার ভালোমন্দ অভিজ্ঞতা আছে যথেষ্ট, কারণ, পরিবারের অনেকের চিকিৎসা আমাকে করাতে হয়েছে বিভিন্ন সময়ে, তাছাড়া যুক্তও হয়েছি অনেক সময় অনেকে চিকিৎসার প্রয়োজনে। গেলাম ঐ হাসপাতালে। ইতোমধ্যে সেখানে দুইদিন অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু রোগী সম্পর্কে কেনো আপডেট নেই।
হাসপাতালে কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অামি কিছুক্ষণ ‘ভদ্রভাবে’ খুঁজলাম। কিছু ‘সেক্সি’ মেয়ে রাখা হয়েছে রিসিপশন এবং বিভিন্ন পর্যায়ে, তাঁরা কিছুই বলতে পারে না, প্রয়োজনীয় কিছু বলার চেয়ে ‘অামার’ দৃষ্টির ভাষা বোঝার দিকে তাঁদের মনোযোগ বেশি, কারণ সেভাবেই তাঁরা অভ্যস্ত, সম্ভবত সেজন্যই রাখা হয়েছে তাঁদের। 
বিষয়টি কেউ নারী পুরুষ দিয়ে বিবেচনা করবেন না। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার নামে কী হচ্ছে সেটি বুঝাতে এভাবে বলার প্রয়োজন আছে—অপ্রাসঙ্গিক না।
ওরা মুমূর্ষু রোগীদের কয়েকদিন রেখে, এরপর মরে গেলে টাকা অাদায় করছে, সেই টাকা দিয়ে কিছু ‘সেক্সি’ মেয়ে কিনে এনে বিভিন্ন ডেস্কে বসিয়ে রাখছে। বিভিন্ন কাজে লাগাচ্ছে। চিকিৎসার কাজে লাগাচ্ছে না, কারণ যাদের আনছে চিকিৎসা সম্পর্কে ওদের কোনো ট্রেনিং বা অাগ্রহ নেই—এটা হলপ করে বলা যায়।
ঐ হাসপাতালে দেখলাম—আছে মূলত ঐ মেয়েগুলো আর একটি ‘ইনটেনিসিভ কেয়ার’ নামক জায়গা—যেখানে পাশাপাশি কয়েকজনকে রাখা যায়। পাইক পেয়াদা অতিক্রম করে ইনটেনসিভ কেয়ারে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়ে ফোর্স করার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথমে ম্যানেজারকে ফোন করে রোগীর ‘কেস সামারি’ লিখিত আকারে চাইলাম, মালিক বা এমডির নম্বর চাইলাম।
এভাবে কিছু শক্তি ব্যবহার করে ভেতরে গেলাম, সেখানে ছিলেন ডাক্তারি এপ্রোন পরা এক ভদ্রলোক, বয়স আমার চেয়ে অনেক কম হবে, অারেকজন—যার নাম উজ্জ্বল …—তিনি ভিজিটিং ডাক্তার বলে জানলাম। উনি অস্বাভাবিকভাবে বিভ্রান্ত এবং বিব্রত হয়ে আমাকে অহেতুক ফেস করতে থাকলেন, ভীত-সন্ত্রস্থ মনে হল।
আমি কিছু বলার অাগেই, তাঁর কতজন সাংবাদিক কোথায় পরিচিত আছে সেসব বলতে থাকলেন। অামি তাকে বললাম, আপনি রোগী সম্পর্কে কথা বলেন। কিছুই বলতে পারলেন না উনি। পরে জানলাম, ডাঃ উজ্জ্বল নাকি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সের ডাক্তার।
বেরিয়ে এসে আবার ম্যানেজারকে ফোন দিলাম। ম্যানেজার গরম দিতে গিয়ে পাল্টা গরমে মিইয়ে গেলেন। বললেন, ‘আমি তো বাড়িতে আছি’। বললাম, ‘আপনি এই মুহূর্তে রোগী রিলিজ করার ব্যবস্থা করেন।’
হাসপাতাল থেকে এক লক্ষ আট হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেয়া হলো! সাথে একথাও বলল, আজকে দুপুর ১২টা অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আমরা পুরো দিনের বিল ধরি নাই।
মানে কী?! এটা একটা হোটেল? আমি সর্বমোট আটাশ হাজার টাকা দিতে রাজী হলাম। পূর্বে আঠারো হাজার টাকা দেয়া ছিল। আর দশ হাজার টাকা দিতে চাইলাম। স্বাভাবিকভাবেই ধুন্দুমার বেধে গেল।
শেষ পর্যন্ত রফা হল আঠারো হাজার+বত্রিশ হাজার টাকায়। দুই দিনে ওষুধ বিল করেছে তাঁরা বত্রিশ হাজার টাকা। ঐ টাকাটা দিতেই হলো। ওখান থেকে রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয় ছেলেটির এলাকার এক ভদ্রলোকের (ডিরেক্টর) হাসপাতালে—গ্রিনরোডে অবস্থিত রিলায়েন্স হাসপাতাল।
সন্ধ্যা নাগাদ ওকে ট্রিটমেন্টের আওতায় আনা সম্ভব হলো। অর্থাৎ ঢাকা মেডিকেলে একটি অপারেশন ব্যতীত আর কোনো ট্রিটমেন্ট সে এই পাঁচছয়দিন বিভিন্ন হাসপাতালে ঘোরাঘুরির পরও পায়নি। জানা গেল পোস্ট অপারেশন জটিলতায় ওর শরীরে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হয়েছে, মাথায়ও সামান্য স্ক্রাচ ধরা পড়েছে। রক্তে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ায় রক্ত পাল্টাতে হচ্ছে, আরো অনেক সমস্যা। ছেলেটি এখন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, বলা যায় মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে গেছে।
দায় কার? দেশের একজন নাগরিক সাত দিন ধরে চারটি হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা পেল না—এটা মানা উচিৎ? ধানমন্ডির ঐ (ইডেন মাল্টিকেয়ার) মেডিকেলের কী হবে? কীভাবে তাঁরা এগুলো করে পার পায়? অবশ্য ঐ হাসপাতালটির রিসিপশনের পাশে দেয়ালে শাঁটানো আছে—হাসাপাতালের মালিক মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে কোনো পুরস্কার নিচ্ছেন, পাশে আছেন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক উপাচার্য—এই মুহূর্তে তাঁর নাম মনে করেত পারছিনে।
বলবেন যে এর সাথে জাফর ইকবাল স্যারকে কোপানোর সম্পর্ক কোথায়? ভীষণভাবে সম্পর্ক আছে, আপনারা খুঁজে নেন, বুঝতে পারবেন। অথবা আমি অন্য লেখায় তুলে ধরব কীভাবে কী হচ্ছে এই সমাজে অন্ধকারে, এখন আলোতেও। শুধু শুধু ফেঁসে যাচ্ছে অন্ধ-বিভ্রান্ত হামলাকারী। দোষ কি আসলে ওদের কোনো?

পরিশেষে আবেদন জানাই, ছেলেটি যদি কোনোভাবে বেঁচে যায় তাহলে দীর্ঘদিন ওকে ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখার প্রয়োজন হবে। কেউ কি বিএসএমএমইউ (পিজি হাসপাতাল) হাসপাতালে ব্যবস্থা করতে পারবেন, বা অন্য কোনো সরকারি হাসপাতালে?


দিব্যেন্দু দ্বীপ

 
Next Post

ছোটগল্প: ক্ষুধা ।। হাসনা হেনা

ঝাপসা চোখে নদীর দিকে তাকায় সফর আলী। বুঝতে চেষ্টা করে ঠিক কোথায় ছিলো তাঁর বসত ভিটে, কোথায় ছিলো ধানী জমি। কিন্তু কিছুতেই বোঝে ওঠতে পারে না সে ।থৈ থৈ করছে জল। অদ্ভুত রকমের বিষাদী বাতাস সফরের ঘোরলাগা মনে টোকা মেরে চলে যায়। সফরের ভেতরটায় কেমন যেন হাহাকার ।ঈষাণ কোণে মেঘের ঘনঘটা। […]
ক্ষুধা